মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৪৯ পূর্বাহ্ন
জে. মনোজ মুকুন্দ নারাভানে, কালের খবর :
ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে যে, কোনো বিপ্লব সমাজ, সরকার এবং বিশ্বকে পুনঃনির্মাণ করেছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্তরে অবিচার থেকে উদ্ভূত হয় বিপ্লব। অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাব এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন- এসবের থেকেই জন্ম নেয় ক্ষোভ-যা ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে। বিপ্লবগুলোও সাধারণত অদ্ভুত মোড় নেয়। একটি প্রতিবাদ সীমিত লক্ষ্য মাথায় রেখে শুরু হতে পারে কিন্তু এর ফলাফল হতে পারে অপ্রত্যাশিত। অনেক সময় বিভিন্ন এজেন্ডা এবং গোপন স্বার্থ প্রায়শই মূল প্রতিবাদকে হাইজ্যাক করে নেয়। দ্য প্রিন্টে একথা লিখেছেন ভারতীয় সেনার একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নারাভানে।
ইতিবাচক ফল: সফল বিপ্লবগুলো বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের দিকে নিয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকান বিপ্লব (১৭৭৫) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দিকে পরিচালিত করেছিল।
মিশ্র ফল: ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে, দেশে একটি প্রজাতন্ত্র গঠনের দিকে পরিচালিত করেছিল, কিন্তু এর ফলে সন্ত্রাসের রাজত্ব এবং শেষ পর্যন্ত নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উত্থান ঘটে। একইভাবে, জর্জিয়া (২০০৩), ইউক্রেন (২০০৪) এবং কিরগিজস্তানে (২০০৫) বিপ্লবগুলো উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং গণতান্ত্রিক লাভ অর্জন করেছে, টেকসই সংস্কার এবং স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে তাদের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য তুলে ধরেছে।
নেতিবাচক ফল: কিছু বিপ্লব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়, যা থেকে জন্ম নেয় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা। উদাহরণস্বরূপ, আরব বসন্ত (২০১০-১২) সিরিয়া এবং লিবিয়ার মতো দেশে গৃহযুদ্ধের দিকে পরিচালিত করেছিল।
বাংলাদেশের বিপ্লব
৫ই আগস্ট, বাংলাদেশে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের ফলে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া বিক্ষোভ বহু বছর ধরে জমে থাকা দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলোর দ্বারা উদ্দীপিত হয়েছিল। যা ক্রমেই একটি পূর্ণ মাত্রার বিপ্লবের রূপ নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য সরকারি চাকরিতে একটি বিতর্কিত কোটা পদ্ধতির পুনঃস্থাপন, বিক্ষোভের একটি প্রধান কারণ ছিল। এই ব্যবস্থাটিকে অনেক শিক্ষার্থী অন্যায্য বলে মনে করেন, বিশেষ করে যখন বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্ব বিদ্যমান। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে সরকারের কঠোর প্রতিক্রিয়া, যার মধ্যে বলপ্রয়োগ এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত ছিল পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, ছাত্রনেতা আবু সাঈদের মৃত্যু আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে অর্থবহ সংলাপের উল্লেখযোগ্য অভাব ছিল। গঠনমূলক সম্পৃক্ততা এবং সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ মোকাবিলা করা হয়তো এই গণবিক্ষোভ রোধ করতে পারতো। বিপ্লব শুধু কোটা পদ্ধতি নিয়ে নয়, দুর্নীতি, স্বচ্ছতার অভাব এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো বিস্তৃত বিষয় নিয়েও ছিল। এই পদ্ধতিগত সমস্যাগুলোকে সক্রিয়ভাবে মোকাবিলা করলে অস্থিরতা প্রশমিত হতে পারতো। একটি সরকার যা ক্রমবর্ধমানভাবে কর্তৃত্ববাদী এবং বাস্তবতা থেকে দূরে, বিক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছিল।
ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা
যদিও বিপ্লবের তাৎক্ষণিক দাবিগুলো উন্নত শাসন এবং সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে, গভীরভাবে বসে থাকা সমস্যাগুলোর জন্য ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। বিক্ষোভের পুনরুত্থান রোধ করতে বর্তমান ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে। আসলে এই বিক্ষোভের পেছনে ছিল দীর্ঘস্থায়ী হতাশা, যা সব সীমা অতিক্রম করে যায়। বাংলাদেশে ছাত্র বিপ্লবের ভবিষ্যৎ আশাপ্রদ, যা উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, অনেকটা পোল্যান্ডে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের মতো (১৯৮০)। বাংলাদেশ এবং পোল্যান্ড উভয় ছাত্র বিক্ষোভে, বিশ্ববিদ্যালয় এবং হোস্টেলগুলো কার্যকলাপ এবং পরিকল্পনার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। দুই দেশের সরকারও কড়া হাতে বিক্ষোভ দমানোর চেষ্টা করেছিল, ফলে বিপুল সংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটে এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে। সামনের দিকে এগোতে হলে বাংলাদেশে সতর্ক নেতৃত্ব এবং প্রতিবাদ উদ্রেককারী অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলোর সমাধানের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। ইতিমধ্যে এই প্রতিবাদ উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে যা দেশের ভবিষ্যৎকে ভালোভাবে গঠন করতে পারে। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অধীনে একটি অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবং এতে সিনিয়র পদে ছাত্র নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই সরকার দেশকে স্থিতিশীল করার জন্য কাজ করছে এবং আন্দোলনকারীদের দাবির সমাধান করছে। নতুন যে অশান্তির খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা প্রমাণ করে পরিস্থিতি এখনো অস্থিতিশীল। ছাত্র আন্দোলনকারীরা তাদের আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখতে এবং দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক পরিবর্তন নিশ্চিত করতে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কথা ভাবছে, অবশ্যই ‘বেগমদের যুদ্ধ’-এর বাইরে গিয়ে। এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিবাদ থেকে সক্রিয় রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার রূপান্তরকে প্রতিফলিত করে। অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও, ভবিষ্যৎ আশার আলো জাগাচ্ছে জনগণের মনে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা এমন একটি চ্যালেঞ্জ যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মোকাবিলা করতে হবে। তরুণ নেতাদের সম্পৃক্ততা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারের জন্ম দেয়। বিপ্লব আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, বেকারত্ব এবং রাজনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার মতো বিষয়গুলোকে তুলে ধরেছে।
ভারতের ওপর প্রভাব
ভারতের যেকোনো প্রতিবেশী দেশে, বিশেষ করে যাদের সঙ্গে দেশটি স্থল সীমান্ত ভাগ করে, যেমন পাকিস্তান বা মিয়ানমার, সবসময় ভারতকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের ছাত্র বিপ্লব ভারতের জন্য বেশ কিছু প্রভাব ফেলে:
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক: এই উত্থান ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে অবনতির দিকে নিয়ে গেছে, যা আগে সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল। ভারত তার দীর্ঘস্থায়ী মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ না করে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করেছে। যদিও ভারত জোর দিয়েছিল যে এই অস্থিরতা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, তবুও সহিংসতার মধ্যে ছাত্র সহ হাজার হাজার ভারতীয় নাগরিকের নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের সুবিধাও করে দিয়েছে দেশটি।
অর্থনৈতিক প্রভাব: এই বিক্ষোভ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ব্যাহত করেছে, ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে প্রভাবিত করেছে। বিশেষ করে সেইসব ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যাদের বাংলাদেশে কোম্পানি রয়েছে।
নিরাপত্তা উদ্বেগ: ভারতে, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে বিক্ষোভের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। তৃতীয় ফ্রন্টের হুমকি সহ যেকোনো আন্তঃসীমান্ত প্রভাব ঠেকাতে ভারতকে পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বিশেষ করে দু’ দেশের সামরিক পর্যায়ে সম্পৃক্ততা প্রয়োজন, কারণ ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
মানবিক এবং সামাজিক প্রভাব: সহিংসতা এবং অস্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশে ভারতীয় প্রবাসীরা উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা মেডিকেল প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েও ভারতে ফিরে আসছে। এর আগে ইউক্রেন (২০২২) এবং সুদান (২০২৩) থেকেও ভারতীয় নাগরিকদের সরিয়ে আনা হয়েছে। এই পরিস্থিতি বিদেশে ভারতীয় নাগরিকদের জন্য আরও ভালো নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার দিকটি তুলে ধরে। বাংলাদেশে ছাত্র বিপ্লব প্রাথমিকভাবে একটি অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও এর প্রভাব ভারতে অনুভূত হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যদের কাছ থেকে ভারত-বাংলাদেশের সকল চুক্তি পর্যালোচনা করার আহ্বান সহ বাংলাদেশে ভারত বিরোধী মনোভাব ভালো লক্ষণ নয়।এই পরিস্থিতির জন্য ভারত সরকারের কাছ থেকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া প্রয়োজন, সমস্ত স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে যোগাযোগের চ্যানেলগুলো উন্মুক্ত রাখা আবশ্যক।
লেখক: ভারতীয় সেনার একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল। যিনি ২৮তম সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।