মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৪০ অপরাহ্ন
কালের খবর : বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে প্রতিদিন পাঁচ হাজার মেট্রিক টনের বেশি ময়লা তৈরি হচ্ছে। শহরটিতে জনসংখ্যা যেমন বাড়ছে মানুষজনের তৈরি ময়লা আবর্জনাও বাড়ছে।
বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি থেকে বের হলেই দেখা যায় রাস্তা ঘাটে ময়লা আবর্জনা। কলার খোসা, কাগজ, প্লাস্টিকের ব্যাগ অথবা বোতল দেখা যাবে না ঢাকায় এমন রাস্তা বা পাড়া খুব কমই আছে।
চলতে পথে খোলা কন্টেইনারের উপচে পড়া আবর্জনাকে নাকে হাত দিয়ে পাশ কাটানো অথবা ময়লা বহনকারী ট্রাক থেকে কিছু উড়ে এসে গায়ে পড়বে কিনা সেই উদ্বেগ নিয়েই রাস্তা চলতে হয় বহু পথচারীকে।
“খুব বিশ্রী লাগে। এগুলো সহ্য করা যায়? কিন্তু কি করবো আমাদের গরীব দেশ। তাই সহ্য করতে হয়”, বলছিলেন ঢাকার রাস্তায় একজন পথচারী।
এই প্রতিবেদনটি তৈরি করতে বাড়ি থেকে বের হয়ে ময়লা আবর্জনার স্তূপ খুঁজতে খুব বেশি দুর যেতে হয়নি। মিরপুরের আবাসিক এলাকার গা ঘেঁষে সিটি কর্পোরেশনের ময়লার রাখার ভাগাড়। দিনের বেলাতেই ট্রাক থেকে ময়লা ঢালা হচ্ছে। গন্ধ শুধু রাস্তায় নয় উঁচু বাড়ি ঘরেও। ড্রেনের পানি ময়লার কারণে রাস্তায় উপচে পড়েছে। পাশেই একটি ঝিলে এত জমে থাকা ময়লা যেন সেগুলোর উপর দিয়ে হেটে যাওয়া যায়। ভ্যানে করে ময়লা সংগ্রহ করে ট্রাকে তুলে দিচ্ছেন পাড়া ভিত্তিক আবর্জনা সংগ্রহকারীরা।
তাদের একজন বলছেন, “আমরা মনে করেন বাসায় বাসায় যাই। বালতি কইরা ঘাড়ে কইরা ময়লা টানি। সব বিল্ডিং থেকে ময়লা আইনা গাড়িতে দিয়া দেই”
সেটি করতে গিয়ে এই কর্মী আবর্জনা কন্টেইনারে ফেলার আগে তা রাস্তাতেই ফেলেছেন। আশপাশে তা থেকে বেছে বেছে বিক্রি করা যাবে এমন ময়লা রেখে দিচ্ছে কয়েকজন।
সিটি কর্পোরেশনের হিসেব মতে ঢাকা শহরে চার হাজারের মতো এমন পাড়া ভিত্তিক কর্মী রয়েছেন যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ময়লা সংগ্রহ করেন। এরা সবাই ছোট ছোট বেসরকারি সংস্থা বা আবাসিক সমিতি গুলো দ্বারা পরিচালিত।
দিনের বেলাতেই তারা ময়লা সংগ্রহ করছেন। যদিও সেটি হওয়ার কথা সন্ধ্যায়। কিন্তু দিনের বেলাতেই হয়।
ঢাকার বাসাবাড়িতে তৈরি হওয়া দৈনিক পাঁচ হাজার মেট্রিক টনের বেশি বর্জ্য সংগ্রহ করে দুই সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু তৈরি হয় আরো বেশি যার হিসেব তাদের কাছে নেই। তারা ধারনা করছেন শহরে তৈরি ময়লার ৮০ শতাংশই তারা পরিষ্কার করেন।
কিন্তু তাহলে ঢাকায় বাড়ি থেকে বের হলেই শহরকে এত আবর্জনাময় মনে হয় কেন?
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এম এ রাজাক বলছেন, “ঢাকার কিছু অদ্ভুত ব্যাপার আছে। এখানে মেইন রোড, লেইন, বাইলেন যেকোনো রাস্তা বলেন সবখানে দোকান, মুদি দোকান, হকার চা বিক্রেতা ফল বিক্রেতা কাচা বাজার রয়েছে। তারা সারাদিন ধরে রাস্তায় ময়লা ফেলতে থাকে। বাসা বাড়ি থেকেও ফেলা হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন সকালে একবার ময়লা পরিষ্কার করে। তারপরেই সারাদিন ধরে ময়লা ফেললে শহরকে তো ময়লা লাগবেই”
কিন্তু ঢাকায় বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন ও তা ফেলার ক্ষেত্রেও ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ঠিকভাবে হচ্ছে না। তার কারণ কি ঢাকার বাসাবাড়িতে তৈরি হওয়া দৈনিক পাঁচ হাজার মেট্রিক টনের বেশি বর্জ্য সংগ্রহ করে দুই সিটি কর্পোরেশন।
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল আলম বলেন, “যারা বাড়ি থেকে কন্টেইনারে নিয়ে যাবে তাদের জন্য আমাদের সময় বেধে দেয়া আছে। সন্ধ্যায় সাতটা থেকে নয়টার মধ্যে। কিন্তু বেশিরভাগ বাসা বাড়ি চায়না রান্না হওয়ার পর দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের বাসায় ময়লা পড়ে থাকুক”
তিনি আরো বলছেন, “বাড়ি থেকে নিয়ে কন্টেইনারেই ফেলার কথা কিন্তু সেটা আমরা করতে পারছি না কারণ ওরা প্লাস্টিক বা অন্যান্য যে বস্তু বিক্রি করা যায় তা বেছে রাখে। আমরা এটাকে বলি ইনফরমাল রিসাইক্লিং। আমরা হিসেব করে দেখেছি ঢাক শহরে প্রায় দেড় লাখ লোক এভাবে জীবিকা নির্বাহ করে। সেটাতো চাইলেই বন্ধ করে দেয়া যাবে না”
কিন্তু তাহলে ঢাকায় রাস্তার মধ্যেই কেনো এখনো ময়লা উপচে পড়া কন্টেইনার?
জবাবে মি আলম বলছেন, “আমরা কন্টেইনারগুলোর জন্য সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন করছি। প্রতি ওয়ার্ড দুটো করে করতে চাই। একটা ঘর থাকবে যেখানে এই কন্টেইনারগুলো চলে যাবে। সেখানে এসব ময়লা বাছাই হবে। কিন্তু দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এতটাই ঘনবসতি যে আমাদের যায়গা নাই। তাই সেগুলো রাস্তাতেই পরে থাকে”
ঢাকার উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ভবিষ্যতবাণী হলো আগামী পাঁচ বছরে তাদের ৬ মিলিয়ন টন আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে। গত এক বছরে তারা আগের বছরের থেকে ২৪ শতাংশ বেশি ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করেছেন।
কিন্তু তাহলে কি একদিন ঢাকা আবর্জনার স্তূপের নিচে চাপা পড়ে যাবে?
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মি: রাজাক এর মতে, পরিচ্ছন্ন হতে ঢাকাকে “ঢাকায় যেকোনো মূল্যেই হোক বর্জ্যের ভলিউম কমিয়ে আনতে হবে। সেটা করা যায় ইনসিনারেটর পাওয়ার প্লান্টের মাধ্যমে। তাতে বর্জ্যের ভলিউম কমবে এবং কিছু বিদ্যুৎ তৈরি হবে”
কিন্তু সেদিকে এগুতে দেখা যাচ্ছে না কর্তৃপক্ষকে। অথচ সরকারি হিসেব মতেই ঢাকায় প্রতিদিন যে পরিমাণে বর্জ্য উৎপাদিত হয় তা থেকে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
তবে তিনি বলছেন মানুষজনের সহায়তা ছাড়া ঢাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দুরূহ ব্যাপার। তিনি একটা উদাহরণ দিয়ে বলছিলেন, “ধরুন কুরবানির ঈদের দিনই চার পাঁচ ঘণ্টার ব্যবধানে চার থেকে পাঁচ হাজার টন যে বর্জ্য তৈরি হয় তা কিন্তু একদিনেই পরিষ্কার হয়ে যায়। তার কারণ হলো নাগরিকরা সমানভাবে সিটি কর্পোরেশনকে সহযোগিতা করে। তারা সবাই উদ্যোগী থাকে সেদিন”
তবে অন্য সময়ের থেকে সিটি কর্পোরেশনগুলোও সেদিন বেশি উদ্যোগী থাকে।
কালের খবর /২০/২/১৮