মিসরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে দুটি উড়োজাহাজ লিজে নিয়ে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা গচ্চা দেওয়ার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। ভবিষ্যতে আর এই কায়দায় লিজে কোনো উড়োজাহাজ নেওয়া হবে না। সেই জন্য লিজিং পলিসি তৈরি করা হয়েছে যাতে বিমানের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। গতকাল বুধবার বিমানবন্দরে বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ট্রেনিং সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল।
বিমানে দুর্নীতির বিষয়ে মতবিনিময় সভায় সংস্থার এমডি বলেছেন, নানা অনিয়ম ও চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে গত এক বছরে নানা অনিয়মের কারণে ২০২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। তার মধ্যে ১৭৮ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫২ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আর সোনা পাচারের সঙ্গে জড়িত ১৩ জনকে বরখাস্ত করা ছাড়াও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
মতবিনিময় সভায় এমডির আগে বক্তব্য রাখেন সংস্থার পরিচালক (পরিকল্পনা) এয়ার কমোডর (অব.) মো. মাহবুব জাহান খান, পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশনস) ক্যাপ্টেন সিদ্দিকুর রহমান, গ্রাহকসেবার পরিচালক মো. সিদ্দিকুর রহমান, বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ যাহিদ হোসেন, পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) এয়ার কমোডর মৃধা মো. একরামুজ্জামান, চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার মো. নওসাদ হোসেন, চিফ অব ফ্লাইট সেফটি ক্যাপ্টেন এনামুল হক তালুকদার, বিএফসিসির মহাব্যবস্থাপক শামসুল করিম, মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকার প্রমুখ। তারা সবাই নিজ নিজ বিভাগের পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে মতামত দেন। এ সময় সাংবাদিকরা তাদের মতামত তুলে ধরে বিমানকে আরও গণমাধ্যমবান্ধব হওয়ার পরামর্শ দেন।
বিমানের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইনসের জনসংযোগ শাখাকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ আসে সাংবাদিকদের কাছ থেকে। প্রয়োজনে আউটসোর্সিং করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পক্ষেও মত দেন তারা।পরিচালকদের বক্তব্যের পর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কথা বলেন। তিনি বলেন, বিমান পর্যায়ক্রমে লিজের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনছে। এ কারণে এবারের কোনো এয়ারক্রাফট লিজ না নিয়ে নিজস্ব এয়ারক্রাফট দিয়েই হজ ফ্লাইট পরিচালনা করবে। যাওয়া-আসা মিলিয়ে ৬৫টি করে মোট ১৩০টি ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে। হজের প্রথম ফ্লাইট যাবে ৫ জুন। এসব ফ্লাইট শুধু হজযাত্রী পরিবহন করবে। জেট ফুয়েলের দাম বাড়লেও নতুন করে বিমানের ভাড়া বাড়ানো হবে না।
বিমান এমডি জানান, ইস্তাম্বুল হয়ে ২৮ জুন থেকে টরেন্টো ফ্লাইট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এখনো টিকিট বিক্রির বিষয়টি সমাধান করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, ‘বিলিং অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্ল্যানিং (এজেন্সি) হয়নি, এ কারণে এজেন্সির মাধ্যমে টিকিট বিক্রি শুরু হচ্ছে না। টিকিট ছাড়তে পারছি না। সমন্বয়ের জন্য যে বিজনেস লাইসেন্স লাগে, সেটি এখনো পাইনি। এসব না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছি। শুধু ওয়েবসাইটে টিকিট দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা সম্ভব না। ’
পরিচালক এয়ার কমোডর মাহবুব জাহান খান বলেন, ‘করোনা সময়েও বিমান লাভ করেছে। কার্গো ব্যবসা করে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। কোনো এয়ারক্রাফট বিক্রি করতে হয়নি। কাউকে ছাঁটাই করতে হয়নি। অথচ বিশ্বের অনেক নামিদামি এয়ারলাইনস কর্মী ছাঁটাই ও উড়োজাহাজ বিক্রি করে দিয়েছে। অনেকে দেউলিয়া হয়ে গেছে। ’
বলাকায় দুদকের অভিযান : গতকাল বেলা ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত দুদক উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন ও সহকারী পরিচালক জেসমিন আক্তারের সমন্বয়ে একটি দল বলাকা অফিসে অভিযান চালায়।
এ বিষয়ে দুদকের তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, অভিযানকালে তারা ইজিপ্ট এয়ারের দুই উড়োজাহাজ লিজসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। এর পাশাপাশি যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের বর্তমান অবস্থান ও কার কতটুকু দায়িত্ব ছিল সে সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছেন। অভিযোগসংশ্লিষ্ট নথিপত্র দ্রুত দুদকে পাঠানোর অনুরোধ জানায় দুদকের দলটি।
এ বিষয়ে বিমানের এমডি বলেন, যেহেতু বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান হয়েছে। বিষয়টি সংসদীয় কমিটিতে ছিল তারা সেটা দুদকে পাঠিয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের দলটি এসেছে। তিনি বলেন, ‘আমি ২০১৮ সালে বিমানে যোগদান করেছি। এর আগে কয়েকবার তদন্ত হয়েছে। আমি দেখেছি ইজিপ্টের দুটি বিমান ভিয়েতনামের বিমানবন্দরে আছে, সেখানে মেরামত করে ফেরত দেওয়ার কথা। এ জটিলতার মধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। আমিসহ আমাদের একটি টিম নিয়ে মিসরে গিয়েছিলাম। বিশেষ করে ফেরত দেওয়ার যে আলোচনা সেগুলোতে আমি ছিলাম। ’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০১৪ সালে পাঁচ বছরের চুক্তিতে ইজিপ্ট এয়ার থেকে বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর নামে দুটি উড়োজাহাজ লিজ নেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। কিন্তু বছর না যেতেই ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্লাইট পরিচালনার পর একটি উড়োজাহাজের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। উড়োজাহাজটি সচল রাখার জন্য ইজিপ্ট এয়ার থেকেই ভাড়ায় আনা হয় আরেকটি ইঞ্জিন। পরে ওই ইঞ্জিনও নষ্ট হয়ে যায়। ইঞ্জিন মেরামত করতে পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানে। এতসব প্রক্রিয়ায় ইজিপ্ট এয়ার ও মেরামতকারী কোম্পানিকে পাঁচ বছরে বাংলাদেশ বিমানকে দিতে হয়েছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তদন্তে বেরিয়ে আসে এসব তথ্য।