বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:১৫ পূর্বাহ্ন
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি, কালের খবর ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার পরও রণদাপ্রসাদ সাহা ভোগ বিলাসে ডুবে যাননি। বরং অর্জিত অর্থ মানবকল্যাণে ব্যয় করেছেন। এখানেই অন্যদের চেয়ে রণদা প্রসাদ সাহা আলাদা। ছোট বেলায় মাকে হারিয়েছিলেন। সন্তান জন্মলাভের সময় তার মা মারা যান। যখন সামর্থ্য হয়েছে প্রথমেই তিনি মায়ের স্মৃতি রক্ষার জন্য মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। নারী শিক্ষার প্রতি তার ছিল গভীর আগ্রহ। একে একে প্রতিষ্ঠা করেন ভারতেশ্বরী হোমস, কুমুদিনী কলেজ এবং পিতার নামে দেবেন্দ্র কলেজ। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকা সেনানিবাসে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মেটারনিটি বিভাগের বিল্ডিং স্থাপন করেন। দেশের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্টের পরবর্তী প্রজন্ম প্রতিষ্ঠার মানবিক প্রয়াস-প্রান্তিক অসহায় জনপদে স্বাস্থ্য সেবা প্রদান ও নারী শিক্ষা প্রসারে নিজেদের নিবেদিত রেখেছেন। সংস্থার সেবা কর্মযজ্ঞে যুক্ত হয়েছে কুমুদিনী উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ, কুমুদিনী নার্সিং স্কুল ও কলেজ, রণদাপ্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়। অনগ্রসর মানুষের কল্যাণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কুমুদিনী ট্রেড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট।
কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল (বিডি) লিমিটেডের আয়োজনে বৃহস্পতিবার টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে অবস্থিত কুমুদিনী কমপ্লেক্সে দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা স্মারক স্বর্ণপদক প্রদান ও কুমুদিনীর ৮৬তম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতার মাস। বঙ্গবন্ধুর ২৪ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং জেল জুলুমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভুখ-। দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা ও তার পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাকে ৭১ সালের ৭ মে নারায়ণগঞ্জ কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের প্রধান অফিস থেকে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী ও দেশীয় বর্বর দোসররা অপহরণ করে। তখন থেকেই তারা নিখোঁজ হন। হানাদার বাহিনী তাদের হত্যার পর লাশ গুম করে ফেলে। কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট একটি পরিবারের একনিষ্ঠ নির্ভিক পথ চলার দৃষ্টান্ত। রণদাপ্রসাদ সাহা ও তার পুত্র হত্যার বিচার চলমান। আশা করি ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে। আমি আশা করি কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের উদ্যোগ আরও প্রসারিত হবে। শিক্ষা বিস্তার ও স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে ট্রাস্টটি আগামী দিনেও সফলতার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবে। সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমার বাবা আমাকে এই কুমুদিনী স্কুলে ভর্তি করে দিতে চেয়েছিলেন। হোস্টেলে থেকে পড়ানো আমার মা’র খুব একটা মনপুত ছিল না। এরপর ’৫৮ সালে মার্শাল ল’ হয়। আমার বাবাকে জেলে নিয়ে যায়। এরপর আমার পড়াশুনা এমনিতেই বন্ধ। কাজেই আর আশা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা আজ জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজগুলো বাস্তবায়ন করছি। বিগত দশ বছরে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, তথ্য প্রযুক্তি, অবকাঠামো, বিদ্যুত, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, কূটনৈতিক সাফল্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। আজ বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তবতা। সারাদেশে সড়ক, মহাসড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার, পাতাল সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রেল, নৌ ও যোগাযোগ অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করছি। মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও মাদক নির্মূলে আমাদের সরকার জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করে যাচ্ছে। আমরাই বিশ্বের প্রথম শত বছরের ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ বাস্তবায়ন শুরু করছি।
প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে হেলিকপ্টার যোগে মির্জাপুর কুমুদিনী কমপ্লেক্সে অবতরণ করেন। এরপর তিনি গার্ড অব অর্নার নেন। পরে টাঙ্গাইল জেলার ১২টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ১৯টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তার ছোট বোন শেখ রেহেনা।
উদ্বোধনী ১২টি উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছেÑ ধেরুয়া রেলওয়ে ওভারপাস, টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের বঙ্গবন্ধু ভিআইপি অডিটোরিয়ামের উদ্বোধন, ৩৩/১১ কেভি সুইচিং স্টেশন (গ্রীড সাবস্টেশন, বৈল্যা, রাবনা বাইপাস, টাঙ্গাইল), ৩৩/১১ কেভি ২০ এমভিএ ইনডোর উপকেন্দ্র (ইন্দ্রবেলতা, পোড়াবাড়ী, টাঙ্গাইল), বাসাইল উপজেলা শতভাগ বিদ্যুতায়ন ঘোষণা, দেলদুয়ার উপজেলা শতভাগ বিদ্যুতায়ন উপজেলা ঘোষণা, নাগরপুর উপজেলা শতভাগ বিদ্যুতায়ন উপজেলা ঘোষণা, সখীপুর উপজেলা কমপ্লেক্সের প্রশাসনিক ভবন সম্প্রসারণ ও হলরুম উদ্বোধন, কালিহাতী (ধুনাইল)-সয়ার হাট হাতিয়া পর্যন্ত রাস্তার শুভ উদ্বোধন, মির্জাপুর উপজেলা কমপ্লেক্স সম্প্রসারিত ভবন উদ্বোধন, মির্জাপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স উদ্বোধন ও মির্জাপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র উদ্বোধন।
এছাড়া ১৯টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। তা হলোÑ এলেঙ্গা-জামালপুর জাতীয় মহাসড়ক (এন-৪) প্রশস্তকরণ প্রকল্প (টাঙ্গাইল অংশ), এলেঙ্গা-ভূঞাপুর-চরগাবসারা সড়কে ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত সেতু ও ১টি কালভার্ট পুনর্নির্মাণ এবং আঞ্চলিক মহাসড়ক উন্নয়ন, টাঙ্গাইল-দেলদুয়ার জেলা মহাসড়ক (জেড-৪০১৫), করটিয়া (ভাতকুড়া)-বাসাইল জেলা সড়ক (জেড-৪০১২) এবং পাকুল্লা-দেলদুয়ার-এলাসিন (জেড-৪০০৭) অংশকে যথাযথ মানে ও প্রশস্থতায় উন্নীতকরণ, কালিহাতী উপজেলা কমপ্লেক্সের প্রশাসনিক ভবন সম্প্রসারণ ও হলরুম নির্মাণ কাজ, বাসাইলের করটিয়াপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ কাজ, দেলদুয়ারে বাতেন বাহিনী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ কাজ, ঘাটাইলের রসুলপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণ কাজ, ঘাটাইলের লোকেরপাড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণ কাজ, দেলদুয়ারে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয় নির্মাণকাজ, জেলা সদর মডেল মসজিদ নির্মাণ কাজ, টাঙ্গাইল সদর উপজেলা মডেল মসজিদ নির্মাণ কাজ, বাসাইল উপজেলা মডেল মসজিদ নির্মাণ কাজ, টাঙ্গাইল সদর উপজেলা ভূমি অফিস নির্মাণ কাজ, সখীপুর উপজেলা ভূমি অফিস নির্মাণ কাজ, মধুপুর উপজেলা ভূমি অফিস নির্মাণ কাজ, মির্জাপুর উপজেলা ভূমি অফিস নির্মাণ কাজ, টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসের নকুন ভবন নির্মাণ কাজ, ভারতেশ্বরী হোমসের মাল্টিপারপাস হল নির্মাণ কাজ, মির্জাপুর ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট নার্সিং কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজ।
এরপর প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠান সভামঞ্চে আসেন। এ সময় ভারতেশ্বরী হোমসের শিক্ষার্থীরা জাতীয় সঙ্গীত, দেশাত্ববোধক গান ও মনোজ্ঞ ডিসপ্লে প্রদর্শন করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (মরণোত্তর), জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (মরণোত্তর), নজরুল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদকে বিশেষ অবদান রাখায় দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা সম্মাননা স্মারক প্রদান করেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে স্মারক সম্মাননা ও স্বর্ণপদক গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহেনা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পক্ষে সম্মাননা এবং স্বর্ণপদক গ্রহণ করেন তার নাতনি খিলখিল কাজী। এছাড়া অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ উপস্থিত থেকে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী যা খেলেন ॥ বৃহস্পতিবার কুমুদিনীতে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলার লোকজ ঐতিহ্য কাঁসা, রূপা ও খাদা, পাথরের থালায় দুপুরের খাবার খেলেন। তিনি ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত দিয়ে পাঁচ তরকারির পাঁচফোড়নের লাবড়া, ছোট আলুর দম, লাউ বিচি ভাজা, কাচকি মাছের বড়া, নারিকেল দিয়ে বুটের ডাল, চিংড়িবাটা ও কুমড়া পাতা ভাজা খান। কুমুদিনী কমপ্লেক্সের কিচেন ইনচার্জ হরিদাস বণিক এ তথ্য জানিয়েছেন।
কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজীব প্রসাদ সাহার বাস ভবনে আয়োজিত ভোজসভায় অন্যদের মধ্যে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, রাজীব প্রসাদ সাহা ও তার সহধর্মিণী শম্পা সাহা ও ছেলে রুদ্র সাহা এবং দুই কন্যা রাহী ও হৃদী, কুমুদিনী ট্রাস্টের পরিচালক প্রতিভা মুৎসুদ্দি এবং ব্যারিস্টার রেহান। প্রধানমন্ত্রী খেজুর গুড় ও নারিকেল দিয়ে তৈরি পাটিসাপটা ও সামান্য ক্ষিরের মালপোয়া খেয়েছেন বলেও জানা গেছে।