সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৪০ অপরাহ্ন
কালের খবর : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকে শিক্ষার গুণগত মান বজায় রেখে উপযুক্ত চিকিৎক গড়ে তুলতে যথাযথ পাঠ্যক্রম অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছেন।
রবিবার রাজধানীর ফার্মগেটস্থ বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বাংলাদেশ সোসাইটি অব ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন-এর তৃতীয় এবং বাংলাদেশ ক্রিটিক্যাল কেয়ার নার্সিং-এর প্রথম আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বেসরকারী খাতেও মেডিকেল কলেজ হচ্ছে। তবে, সেক্ষেত্রে আমি বলব, তাদের একটু নজর দেওয়া দরকার- শিক্ষার মানটা যথাযথ আছে কি না। কারিকুলামগুলো ঠিকমতো আছে কি না সেই দিকেও একটু বিশেষভাবে নজর দেওয়া দরকার।’
চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসা ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন, আমাদের চিকিৎসকদের আরো উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য আমরা বিদেশে পাঠাতে চাই।
তিনি বলেন, আমার এটাই প্রশ্ন যে, যদি অন্যদেশ পারে তবে, আমরা পারবো না কেন? কারণ, আমাদের মেধা বা জ্ঞান কোনটিরই অভাব নেই। তবে, সুযোগের অভাব ছিল। যেটি আমরা এখন করে দিচ্ছি।
শিক্ষার মানের প্রতি নজর দেওয়ার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বই লেখার প্রতিও মনোনিবেশ করার আহবান জানান।
মেডিকেল সাইন্স এখন অনেক এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, আর এসব বই এত দামী সবার পক্ষেতো এসব বই কেনা সম্ভব নয়। কাজেই আমার মনে হয় আপনাদের বিভিন্ন এসোসিয়েশন আছে এবং মন্ত্রণালয় থেকেও এটার উদ্যোগ নেওয়া উচিত এবং প্রত্যেকটি মেডিকেল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লাইব্রেরিটা একান্তভাবে প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় নতুন নতুন রোগের পাশাপাশি নতুন নতুন যে প্রযুক্তি আবিস্কার হচ্ছে তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য চিকিৎসক সমাজের প্রতি আহবান জানান।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের সচিব ডা. সিরাজুল হক খান এবং বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন (বিএসসিসিএম)-এর সভাপতি অধ্যাপক ইউএইচ সাহেরা খাতুন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। স্বাগত বক্তৃতা করেন ক্রিটিকন বাংলাদেশ-২০১৮’র কংগ্রেস সভাপতি ডা, মীর্জা নাজিম উদ্দিন। শুভেচ্ছা বক্তৃতা করেন বিএসসিসিএম-এর সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এএসএম আরিফ আহসান।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রী পরিষদ সদস্যগণ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ,সংসদ সদস্যগণ, সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ, চিকিৎসক সমাজের প্রতিনিধিগণ এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
দেশে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা দেশের ইতিহাসে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করি। সম্প্রতি রাজশাহী ও চট্টগ্রামে নতুন দু’টি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় করা হচ্ছে। সিলেটেও আরও একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পর্যায়ক্রমে প্রত্যেকটি বিভাগীয় শহরে একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করবে সরকার।
চিকিৎসার জন্য দেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসকের অভাব রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তবে, ডাক্তারদের কথা-বার্তা এবং পরিচর্যায়ও অর্ধেক রোগ ভাল হয়ে যেত পারে সেদিকে আমাদের চিকিৎসকদের একটু বিশেষ যতœবান হতে হবে।
ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে মরনাপন্ন রোগীদের সেবা দেওয়া হয় বলে এখানকার চিকিৎসাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, এখানে যারা কাজ করেন তাঁদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হয়। তবে যতটা ঝুঁকিমুক্ত থেকে চিকিৎসা দেওয়া যায় সেই বিষয়টাও যেমন দেখতে হবে, আবার রোগীদের চিকিৎসাটাও দেখতে হবে।
এসময় প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালে বাড়তি ভিজিটরের আগমনকে নিরুৎসাহিত করে বলেন, এতে যে কোন সময় রোগীর ক্ষতি বা ইনফেকশন হতে পারে।
তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায় ক্যামেরাসহ অপারেশন থিয়েটারে মিডিয়া ঢুকে পড়ছে। আত্বীয়-স্বজন, ভিজিটার যাচ্ছে, ভাত-মাছের মতো। তিনি ক্রিটিক্যাল রোগীর ক্ষেত্রে ভিজিটরদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করার আহবান জানিয়ে বলেন, কই বিদেশেতো এভাবে রোগী দেখতে দেওয়া হয় না। প্রয়োজনে ভিজিটর কর্নার থাকবে, সেখানে মনিটরে রোগী দেখে আত্বীয়-স্বজন, প্রিয়জনেরা চলে যাবে অথবা গ্লাসের বাইরে থেকে রোগী দেখবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্রিটিক্যাল কেয়ারের চিকিৎসকদের আরো কঠোর হতে হবে। বাধা দিতে হবে। রোগী বাঁচাতে চাইলে চিকিৎসাটা ভালভাবে করতে দিতে হবে।’
শেখ হাসিনা ভিজিটরদের বাধা প্রদানের ক্ষেত্রে কঠোর হবার জন্য প্রয়োজনে তাঁর (প্রধানমন্ত্রীর) রেফারেন্স ব্যবহারের আহবান জানিয়ে বলেন, আমার ভোট বাড়লো কি কমলো সেটা চিন্তা নয়, রোগী বাঁচলো কিনা, তাঁরা সেবা পাচ্ছে কি না সেটাই আমার চিন্তা। এক্ষেত্রে পোস্ট অপারেটিভ কেয়ারের চিকিৎসক এবং নার্সদের উন্নত প্রশিক্ষণের ওপর প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বারোপ করেন।
পৃথিবীতে নার্সিং একটা মর্যাদাপূর্ণ পেশা হলেও আমাদের দেশে এটিকে একটু নিচু চোখে দেখা হতো উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এজন্যই তাঁর সরকার নার্সিং পেশাকে দ্বিতীয় শ্রেনীর মর্যাদা দিয়েছে।
তাঁর সরকারের গড়ে তোলা ডিজিটাল বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন চালু হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা চালু থাকায় টেলিমেডিসিনে আমরা অনেদূর এগিয়েছি। আগামী মাসে আমাদের নিজস্ব উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণ হলে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে আরো একধাপ এগিয়ে যাব।
‘শুধু ওষুধ খাওয়ালেইতো আর রোগী ভাল হবে না সেজন্য খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি নিরাপত্তা -সব দিকেই তাঁর সরকার নজর দিচ্ছে,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রয়েজনে আইন শিথিল করে দিয়ে হলেও তাঁর সরকার সকল হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক এবং নার্সদের নিয়োগ দিেেচ্ছ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ৯ বছরে ১২ হাজার ৭২৮ জন সহকারি সার্জন এবং ১১৮জন ডেন্টাল সার্জন নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে ১৩ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রায় সাড়ে ১২ হাজার নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ২৪টি সরকারি হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার শয্যা বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণকালে দেশে মোট সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ছিল ১৪টি যা বর্তমানে ৩৬টিতে উন্নীত হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৬৯টি। সরকারি-বেসরকারি মিলে ডেন্টাল কলেজের সংখ্যা ২৮টি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় দেশের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে ‘জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবে’ বাক্যটি যুক্ত করা হয়।
তিনি বলেন, জাতির পিতা জনগণকেন্দ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে থানা পর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্য কাঠামোকে সম্প্রসারণ করেন। চিকিৎসকরা যেন সরকারি চাকুরি নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করতে সম্মানিত বোধ করেন, সেজন্য তিনি চিকিৎসক পদকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করেন।
জাতির পিতার দর্শনকে ধারণ করে তাঁর সরকার জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে গত ৯ বছরে স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার স্বাস্থ্যসেবা গ্রাম পর্যায়ে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সারাদেশে সাড়ে ১৮ হাজার কম্যুনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করেছে। সেখান থেকে ৩০ প্রকার ঔষধ বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাল থেকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা চালু করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের ঐকান্তিক আগ্রহ এবং নিরলস প্রচেষ্টায় অটিজমের মত মানবিক স্বাস্থ্য সমস্যাটি বিশ্বসমাজের দৃষ্টিতে আনা সম্ভব হয়েছে। অটিস্টিক শিশুদের সুরক্ষায় ২২টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন এখনও বাংলাদেশের জন্য অনেকাংশে নতুন বিষয় উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, তারপরও এ পর্যন্ত আমরা ২৭টি সরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ২১১টি বেডের মাধ্যমে আইসিইউ-এর উন্নতমানের সেবা দিতে সক্ষম হচ্ছি।
চিকিৎসা পেশাকে একটি মহান ব্রত উল্লেখ করে প্রতিটি রোগীকে নিজের পরিবারের একজন সদস্য মনে করে সেভাবে সেবা প্রদান করার জন্যও প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসকদের প্রতি আহবান জানান। চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে তাঁর সরকারের প্রচেষ্টা এবং চিকিৎসকদের তাঁর সরকারের সবরকম সহযোগিতা অব্যাহত রাখার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি এ প্রসঙ্গে জাতির পিতার ১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর তৎকালীন পিজি হাসপাতালে ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত জাতির পিতার ভাষণের উল্লেখ করে বলেন, বঙ্গবন্ধু ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আপনারা ডাক্তার, আপনাদের মন হতে হবে অনেক উদার। আপনাদের মন হবে সেবার। আপনাদের কাছে বড় ছোট থাকবে না। আপনাদের কাছে থাকবে রোগ- কার রোগ বেশি, কার রোগ কম। তাহলেই তো সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে এবং আপনারা মানুষের সহযোগিতা পাবেন।’