বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৩৫ পূর্বাহ্ন
মো: মোত্তাকিম হোসেন (লাভলু) : ভূটানকে বলা হয় এশিয়ার সুইজারল্যান্ড। আয়তনে বাংলাদেশের চারভাগের একভাগ, জনসংখ্যা মাত্র আট লক্ষ। হিমালয়ের কোলে অবস্থিত ভূটানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে প্রতিবছর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা ছুটে আসেন এখানে, এদেশের অনেক মানুষের আয় নির্ভর করে পর্যটনের ওপরেই।সাজানো সুন্দর একেকটা শহর, পরিচ্ছন্ন আঁকাবাঁকা পথঘাট, চারপাশে অবারিত সবুজের মেলা- প্রকৃতি খুব যত্ন করে সাজিয়েছে ভূটানকে।
বাংলাদেশ থেকে সড়কপথেই যাওয়া যায় ভূটানে। এবং সেটা বেশ অল্প খরচেই। সেক্ষেত্রে আপনাকে গুলশানের ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসী থেকে ভারতের ‘ট্রানজিট ভিসা’ করিয়ে নিতে হবে, কারণ সড়কপথে ভূটান যেতে চাইলে ভারতের কুচবিহার জেলার ওপর দিয়েই যেতে হবে। ট্রানজিট ভিসার জন্যে ছবি/পাসপোর্ট এবং আনুষঙ্গিক কাগজপত্রের সঙ্গে শ্যামলী পরিবহনের ঢাকা-শিলিগুড়ি বাসের টিকেটের(রিটার্ন সহ) মূল এবং ফটোকপি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসীতে। ভিসার এন্ট্রি এবং এক্সিট পয়েন্ট হবে চ্যাংড়াবান্ধা-জয়গাঁও।
শ্যামলী পরিবহন ছাড়া অন্যভাবেও এই রুটে যেতে পারবেন। সেক্ষেত্রে প্রথমে টিকেট কেটে ভিসা পাওয়ার পর টিকেট ফেরত দিতে পারেন।
ঢাকার কল্যাণপুর থেকে সরাসরি বুড়িমারি’র(লালমনিরহাট) এসি/নন এসি অনেক বাস আছে, সেগুলোর একটায় চড়ে বসতে পারেন। রাত আটটা-নয়টার বাসে উঠলে বুড়িমারি পৌঁছুতে ভোর হয়ে যাবে। সকাল নয়টায় ইমিগ্রেশন অফিস চালু হয়, ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে ঢুকে পড়ুন ভারতে, এই জায়গার নাম চ্যাংড়াবান্ধা। ডলার ভাঙিয়ে নিতে পারেন এখান থেকেই, ভালো দামই পাওয়া যায় এখানে।
আপনাকে যেতে হবে জয়গাঁও, এখান থেকেই আপনি ভূটানে প্রবেশ করবেন। তিন/চারজন হলে চ্যাংড়াবান্ধা থেকে জয়গাঁও সরাসরি ট্যাক্সি রিজার্ভ করে নিতে পারেন, ভাড়া পড়বে ১২০০-১৫০০ রূপি। বেশী লোক হলে জীপ পাবেন। একা হলে বাসে যাওয়াটাই ভালো, সেক্ষেত্রে আপনাকে বাসে করে প্রথমে ময়নাগুড়ি যেতে হবে, সেখান থেকে লোকাল বাসে উঠে যাবেন হাসিমারা নামের একটা জায়গায়, পঞ্চাশ রুপী করে ভাড়া। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি চা বাগান চোখ জুড়িয়ে দেয়। হাসিমারা থেকে অটোতে করে যাবেন বর্ডারের কাছে ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসে, দূরত্ব সামান্যই।
ভূটানের ভিসার জন্যে ঢাকা থেকে আবেদন করতে হয় না, জয়গাঁও গেলেই অন এরাইভাল ভিসা পাবেন। ফর্মালিটিজ সেরে পার হয়ে যান বর্ডার, ভূটানের এই জায়গাটার নাম ফুটসোলিং। জীপ-ট্যাক্সি বা বাস, যেভাবে ইচ্ছে যেটায় খুশী চড়ে চলে যেতে পারবেন ভূটানের রাজধানী থিম্পুতে। পাহাড়ী রাস্তায় চলতি পথে দেখা হবে মেঘেদের সঙ্গে, হয়তো ভাগ্য ভালো থাকলে গাড়ির সঙ্গেই মেঘেদের পাল্লা দিতে দেখবেন। পাহাড়ের চড়াই পেরুনোর সময় পায়ের নীচে মেঘের ভেলা চোখে পড়বে, সে এক অসাধারণ দৃশ্য! গাড়ি রিজার্ভ করার সময় দরদাম করতে ভুলবেন না। ফুটসোলিং থেকে থিম্পু প্রায় চার-পাঁচ ঘন্টার পথ। তবে এরচেয়ে বেশী সময়ও লাগতে পারে। পাহাড়ী রাস্তা হওয়ায় গাড়ির গতিবেগ কম থাকে।
থিম্পু যাবার অন্তত একদিন আগেই হোটেল বুকিং করে ফেলবেন। হাজার-দেড় হাজার রুপীর মধ্যে ভালো মানের রুম পেয়ে যাবেন। ভূটানে ভারতীয় রূপি চলে, তাই রূপি ভাঙানোর বাড়তি ঝামেলার প্রয়োজন পড়ে না। শহরটা একদম সাজানো-গোছানো, ফিটফাট। ভূটানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, খানিকটা বৃষ্টি হলেই মনে হয় যেন পুরো শহর স্নান করে সেজেগুজে বসে আছে। থিম্পু শহরটাতেই পুরো একটা দিন চক্কর দিতে পারেন। দেখার আছে বুদ্ধ মূর্তি, চিড়িয়াখানা, সীমতখা জং, রাজপ্রাসাদ, পার্লামেন্ট হাউজ ইত্যাদি।
থিম্পু থেকে আড়াই ঘন্টা দূরত্বের শহর পুনাখা। ট্যাক্সি রিজার্ভ করে নিতে পারেন, অথবা বাসেও যাওয়া যায়। তিন/চারজনের গ্রুপ হলে ট্যাক্সিতেই সুবিধা। ভালো হয়, যে কয়দিন ভূটান থাকবেন সে কয়দিনের জন্যে যদি একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ফেলেন। ভূটানের মানুষজন খুবই সহজ-সরল, দারুণ আন্তরিক তাদের ব্যবহার। পর্যটকদের তারা দারুণ সমাদর করেন, কারণ পর্যটনের ওপরই তাদের অনেকের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে। ট্যাক্সি ড্রাইভারেরাও খুব অমায়িক ব্যবহার করবে আপনার সঙ্গে।
ট্যাক্সি নিয়ে চলে যেতে পারেন পুনাখা। ভূটানের বেশকিছু জায়গায় যেতে হলে পর্যটকদের থিম্পু ইমিগ্রেশন অফিস থেকে অনুমতি নেয়া লাগে, পুনাখা তাদের মধ্যে একটি। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললে সে’ই সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেবে। দো চু লা-পাস, পুনাখা জং, আর্চারি গ্রাউন্ড বা সাসপেনশন ব্রীজের মতো জায়গাগুলো আপনার চোখ আর মন দুটোকেই তৃপ্তি দেবে। ক্যামেরা বা মোবাইলের মেমরি কার্ড এখানেই ফুল হয়ে যেতে পারে! পুনাখায় থাকার ভালো হোটেল নেই খুব একটা, তাই পড়ন্ত বিকেলে থিম্পু চলে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
ভূটানের সবচেয়ে সুন্দর শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পারো। ভূটানের একমাত্র এয়ারপোর্টটাও এই শহরেই অবস্থিত। থিম্পু থেকে পারো যাবার রাস্তাটা অসম্ভব সুন্দর, গাড়ির জানালা থেকে চোখ ফেরানো যায় না- এমন অবস্থা। চাইলে এখানে রাতে থাকতেও পারেন। পারো জং, কিচু মনস্টেরি, চেলে লা-পাস ঘুরে দেখতে পারেন একদিনের মধ্যেই। পাহাড়ের কোলঘেঁষে বানানো এয়ারপোর্টের রানওয়েটাও দারুণ আকর্ষণীয়। আরেকটা দিন বরাদ্দ রাখতে হবে টাইগার নেস্টের জন্যে। ধর্মীয় আর পর্যটনের দিক থেকে সম্ভবত ভূটানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান এটাই। পারো শহর থেকে প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় লাগে টাইগার নেস্টের পার্কিং স্ট্যান্ডে যেতে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে উঠতে হবে টাইগার নেস্টে। জায়গাটা মাটি থেকে প্রায় তিন হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত। হেঁটে উঠতে প্রায় তিন ঘন্টা সময় লাগে, নামতেও লাগবে এক ঘন্টার মতো। তবে হাঁটার পরিশ্রমটা করতে পারলে জীবনের স্মরণীয় সৌন্দর্য্যের মুখোমুখি হবেন আপনি, এটা নির্দ্বিধায় বলা চলে।
ভূটানের অন্যান্য আকর্ষণীয় জায়গাগুলো হচ্ছে হাভেলি, বুমথাং ইত্যাদি। এসব জায়গায় যেতে হলেও থিম্পু ইমিগ্রেশন অফিস থেকে অনুমতি নিতে হবে। ভ্রমণের শেষটাও শুরুর মতোই। বাস বা রিজার্ভ গাড়িতে চলে আসবেন ফুটসোলিং, চাইলে এখানে একরাত থাকতেও পারেন। ইমিগ্রেশন করিয়ে ভারতে ঢুকবেন আবার, জয়গাঁও সীমান্ত দিয়ে, সেখান থেকে আগের মতো চ্যাঙড়াবান্ধা চলে আসবেন, বর্ডারের ফর্মালিটিজ সেরে পা রাখবেন বাংলাদেশে।
ভূটানে ধুমপান নিষেধ, তামাকজাত পণ্যের বিক্রিও নিষিদ্ধ। ধরা পড়লে গুণতে হবে জরিমানা। তবে সেখানে বার আছে, বিয়ার বা মদ্যপানে কোন বাধা নেই, মাতাল না হলেই হলো। প্রকৃতি তার অদ্ভুত খেয়ালে অপরূপ এক মোহনীয় রূপে সাজিয়েছে ছোট্ট এই দেশটিকে, সেখানে যেতে বিশাল অঙ্কের টাকা কিংবা কঠিণ জোগাড়যন্তের দরকার নেই বাংলাদেশের মানুষের জন্যে। তাহলে আর দেরী কেন, এখনই প্ল্যান করতে শুরু করুন, কবে কাদের সঙ্গে নিয়ে ভূটান ভ্রমণে বেরিয়ে পড়বেন।