এই পরিস্থিতিতে বগুড়ায় নির্মাণাধীন স্থাপনা এবং জোর করে বাড়ির মালিককে নির্মাণসামগ্রী কেনায় বাধ্য করার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করে বগুড়া জেলার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভুঞা। এসব দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে পুলিশের ‘অ্যাকশন’। পাশাপাশি বাড়ির মালিকদের নির্মাণ কাজ নির্বিঘ্নে চালিয়ে নিতে সব ধরনের আইনি নিরাপত্তাজনিত সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন পুলিশ সুপার। এই ঘোষণায় স্বস্তি ফিরেছে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে।
এদিকে জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জোর করে বালু ও নির্মাণসামগ্রী সরবরাহকারী এবং চাঁদাবাজের সঙ্গে জড়িত একশ জনের একটি তালিকা করেছে পুলিশ। সেই সঙ্গে প্রতিটি নির্মাণাধীন বাড়ি ও স্থাপনার সামনে সতর্ক বার্তামূলক সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলার ৫১৮টি নির্মাণাধীন স্থাপনার সামনে এই সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে পুলিশ।এ ব্যাপারে বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভুঞা ঢাকাটাইমস বলেন, ‘বগুড়া জেলায় কোনো ধরনের চাঁদাবাজি আমি হতে দেব না। চাঁদাবাজ, দখলদারে বিরুদ্ধে জেলা পুলিশ সব সময়ই কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এমনকি নির্মাণাধীন বাড়িতে জোর করে বালু ও নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ করা এবং চাঁদাবাজি বন্ধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছি। এলাকার জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বসেছিলাম। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। এখন থেকে কেউ এ ধরনের কাজ করলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটি বন্ধ হলে অনেক অপরাধ কমে আসবে বলে মনে করি।’ গত জুনে শহরে প্রকাশ্যে চারটি হত্যার ঘটনা ঘটে। নিহতরা ছিলেন যুবলীগ এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মী। তারা প্রত্যেকে বালু ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। এসব হত্যার পর পুলিশ বালু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। জোরপূর্বক বালু সরবরাহ বন্ধ হলে জেলায় অনেক অপরাধ কমে যাবে এমন চিন্তা থেকে পুলিশ সুপার শহরের বিভিন্ন এলাকায় সুধিজন ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেন।
বৈঠকে তিনি বাড়ি নির্মাণকারীদের নির্ভয়ে পছন্দমতো স্থান থেকে বালু কিনে কাজ চালানোর আহ্বান জানান। এরপর থেকে নির্মাণাধীন বাড়িগুলো পুলিশী পর্যবেক্ষণে আছে। এছাড়া জোরপূর্বক বালু সরবরাহকারী একশ জনের তালিকা করেছে পুলিশ। যাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মী।
স্থানীয় সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জোরপূর্বক বালু সরবরাহকারী চাঁদাবাজদের কারণে বাড়ি করতে গিয়ে হরহামেশা মালিকদের পড়তে হতো নানা অসুবিধায়। হুমকি ধামকিতে সব সময় তটস্থ হয়ে তাকতে হতো তাদের। পছন্দ মতো জায়গা থেকে ইট বালু সিমেন্ট কিনতে পারতেন না। আবার ন্যায্য মূল্যের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে চাঁদাবাজদের থেকে সেসব কিনতে হতো। অনেকে চাঁদাবাজদের ভয়ে বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা নিলেও সিদ্ধান্তহীনতা ভুগতেন। তবে জেলা পুলিশের নেওয়া এই উদ্যোগে এখন স্বস্তির নিশ^াস ফেলছেন নির্মাণাধীন বাড়িওয়ালারা।
জেলার নির্মাণাধীন বাড়িগুলোতে গেলে দেখা মিলবে জেলা পুলিশের টানিয়ে দেওয়া সতর্ক বার্তামূলক ‘বিশেষ বিজ্ঞপ্তি’। তাতে বড় করে লেখা রয়েছে ‘এ বাড়ির নির্মাণ কাজ জেলা পুলিশ বগুড়া পর্যবেক্ষণ করছে।’ তার নিচেই লেখা ‘বাড়িওয়ালা নিজ পছন্দমত সুবিধাজনক জায়গা থেকে ইট, বালু, রডসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী ক্রয় করবেন। কেউ ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন প্রকার নির্মাণ সামগ্রী ক্রয় ও বিক্রয়ের চেষ্টা করলে অথবা চাঁদা দাবি করলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যে কোনো চাঁদাবাজি সংক্রান্ত কোন অভিযোগ থাকলে নিম্নলিখিত নম্বরে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।’ সেখানে জেলা পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইনচার্জের যোগাযোগের নম্বর সংযুক্ত করা হয়েছে। জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) সনাতন চক্রবর্তী কালের খবরকে বলেন, ‘পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে এখন পর্যন্ত বগুড়া সদরে ৩৩০টি এবং মফস্বল এলাকাগুলোতে সকল থানার অফিসার ইনচার্জদের মাধ্যমে ১৮৮টি নির্মাণাধীন বাড়িতে জেলা পুলিশের সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জোরপূর্বক বালু সরবরাহের সঙ্গে জড়িত এরকম প্রায় একশ জনের তালিকা করা হয়েছে। নিয়মিত খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। পুলিশের এরকম মুভমেন্টের পর এই গ্রুপটি আর মাঠে নেই।’
উল্লেখ্য, গত এক যুগ ধরে বগুড়া শহর ছাড়াও জেলার সর্বত্র বাড়ি অথবা যেকোনো স্থাপনা নির্মাণ কাজ শুরু হলেই স্থানীয় কিছু বালু ব্যবসায়ী জোরপূর্বক সেখানে বালু সরবরাহ করে থাকে। বগুড়া শহরের বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় নির্মাণ কাজে কেউ তাদের পছন্দমত স্থান থেকে বালু কিনে নির্মাণ কাজ করতে পারেননি এতদিন। যারা এই বালু সরবরাহের কাজ করেন তাদের অধিকাংশই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। বালু সরবরাহ নিয়ে আভ্যন্তরীণ কোন্দলে গত এক যুগে নিজেদের মধ্যে অসংখ্য খুনের ঘটনাও ঘটেছে।