শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৫৫ পূর্বাহ্ন
কালের খবর রিপোর্ট :
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ধরপাকড় চলছেই। গতবছর থেকে শুরু হওয়া এ ধরপাকড় নতুন বছরেও অব্যাহত রয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ১৬দিনে ফিরেছেন ১ হাজার ৬১০ জন বাংলাদেশি। গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধরপাকড়ের শিকার হয়ে ৬৪ হাজার ৬৩৮ জন কর্মী দেশে ফিরে আসেন। যার মধ্যে ২৫ হাজার ৭৮৯ জনই ফিরেছেন সৌদি আরব থেকে। সৌদি আরব থেকে ফেরা কর্মীদের অধিকাংশকে এক কাপড়েই ফেরত পাঠানো হয়েছে। সৌদি ফেরত বাংলাদেশিদের অভিযোগ, বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও তাদেরকে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। নিয়মিত ফেরত আসার ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার রাতেও দেশটি থেকে ফিরেছেন ১০৯ জন।
ওইদিন রাত ১১টা ২০মিনিটে সৌদি এয়ারলাইন্সের এসভি ৮০৪ বিমানযোগে তারা দেশে ফেরেন। প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহযোগিতায় ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম এসব কর্মীদের জরুরি সহায়তা প্রদান করে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদিকরণের কারণে ফেরত আসাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকবে। সেক্ষেত্রে এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে সরকারকে মনোযোগি হতে হবে। তাতে ভবিষ্যতে শ্রমবাজার আরও শক্তিশালী হবে। অন্যদিকে, যারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে লোক পাঠাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ তাদের। এছাড়া সাধারণ বা গতানুগতিক নয় বরং উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক প্রয়োজন বলে মনে করেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
গতকাল দেশে ফেরেন সিলেট জেলার তালেব (৩০)। তিনি মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন না। রাতেই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে হস্তান্তর করেছে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম। পাঁচ বছর পূর্বে শ্রমিক হিসাবে সৌদি আরব গমন করেন তিনি। কিন্তু গত দুই মাস পূর্বে সেখান মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। মাত্র দুই মাস আগে দেশটিতে গিয়েছিলেন নোয়াখালীর আজিম হোসেন। তাকেও ফেরত পাঠানো হয়েছে। তার অভিযোগ, পাসপোর্টে তিন মাসের ভিসা থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। ভাগ্যবিড়ম্বিত এই শ্রমিক বলেন, বাজার করার জন্য মার্কেটে যাওয়ার পথে আটক করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় পুলিশের সঙ্গে নিয়োগকর্তা (কফিল) কথা বলার পরও তাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে দেশে ফেরা মুন্সিগঞ্জের রুহুল আমিন, কুমিল্লার ফিরোজ হোসেন ও মানিক, শরিয়তপুরের মিলন, যশোর জেলার মোসলেম উদ্দিন, বগুড়ার মেহেদি হাসান, গাজীপুরের রাজিবসহ ১০৯ বাংলাদেশি অধিকাংশের অবস্থাই এমন। তাদের অভিযোগ, আকামা তৈরীর জন্য কফিলকে (নিয়োগকর্তা) টাকা প্রদান করলেও কফিল তা তৈরি করে দেয়নি। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর কফিলের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও গ্রেপ্তারকৃত কর্মীর দায়-দায়িত্ব নিচ্ছে না তারা।
ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান জানান, ২০১৯ সালে ২৫ হাজার ৭৮৯ বাংলাদেশিকে সৌদি আরব থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। নতুন বছরের শুরুর ১৬ দিনে ১৬১০ জন বাংলাদেশি ফিরেছেন দেশটি থেকে। ফেরত আসাদের বর্ণনা প্রায় একই রকম। প্রায় সবাই খালি হাতে ফিরেছেন। কয়েক মাস আগে গিয়েছিলেন এমন লোকও রয়েছে ফেরত তালিকায়। তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায়। পরিসংখ্যান তুলে ধরে শরিফুল হাসান জানান, প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে মোট ৬৪ হাজার ৬৩৮ কর্মী দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে ২৫ হাজার ৭৮৯ জন, মালয়েশিয়া থেকে ১৫ হাজার ৩৮৯ জন, সংযুক্ত আরব-আমিরাত থেকে ৬ হাজার ১১৭ জন, ওমান থেকে ৭ হাজার ৩৬৬ জন, মালদ্বীপ থেকে ২ হাজার ৫২৫ জন, কাতার থেকে ২ হাজার ১২ জন, বাহরাইন থেকে ১ হাজার ৪৪৮ জন ও কুয়েত থেকে ৪৭৯ জন শূণ্য হাতে ফিরেছেন- যাদের পরিচয় ডিপোর্টি। তিনি বলেন, এই মানুষগুলোর পাশে সবার দাঁড়ানো উচিৎ। ফেরত আসা প্রবাসীদের আমরা শুধু বিমানবন্দরে সহায়তা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছি না, তারা যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারে সেজন্য কাউন্সিলিং, দক্ষতা প্রশিক্ষণ ও আর্থিকভাবেও পাশে থাকতে চাই। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা সবাই মিলে কাজটি করতে হবে। পাশাপাশি এভাবে যেন কাউকে শূণ্য হাতে ফিরতে না হয়, সেজন্য সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিকে দায়িত্ব নিতে হবে। দূতাবাস ও সরকারকেও বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে হবে। বিশেষ করে ফ্রি ভিসার নামে প্রতারণা বন্ধ করা উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।
ওয়ারবি ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ফারুক আহমেদ মনে করেন, উভয় দেশের মধ্যে জোরালো কূটনৈতিক সম্পর্ক দরকার। তিনি বলেন, অনেকে সেদেশে বৈধভাবে অবস্থান করছে, কাজ করার অনুমতিপত্রও আছে। তারপরও পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে, এটা কোনভাবেই মেনে নেয়ার মতো না। তিনি বলেন, আমাদের কূটনীতি অনেকটা দূর্বল। সাধারণ কূটনীতি দিয়ে এর সমাধান হবে না। দরকার উচ্চ পর্যায়ের কূটনীতি। ফারুক আহমেদ বলেন, সৌদি আরব আমাদের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। সেখানে লাখ লাখ কর্মী কাজ করছে। আমাদের কূটনীতিকরা হয়তো মনে করছেন, এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে তারা আরও বেশি লোক পাঠিয়ে দেবে বা নতুন করে লোক নেবে না। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সবসময় তাদের নিজেদের স্বার্থ দেখে, তা যদি ইললিগ্যালও হয়। এক্ষেত্রে সমমর্যাদার এবং উচ্চপর্যায়ের কূটনীতিই পারে যেকোন অনিয়ম রুখতে।
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি এন্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)-এর চেয়ারপারসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, বছর দুয়েক আগে সৌদিকরণ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, কিছুক্ষেত্রে তারা বাইরের লোক নেবে না। যে প্রফেশনগুলোতে এখনও বাইরের কর্মী আছে, সেখানে আসতে আসতে ছাঁটাই করে দেবে। যদি রাখে, তবে ডাবল বেতন দিতে হবে সংশ্লিষ্টদের। আর সৌদি কর্মী নিয়োগ দিলে অর্ধেক বেতন দিলেই চলবে। এভাবে খুব প্লান করে তারা সৌদিকরণের দিকে যাচ্ছে। এর ফলে বোরখা, চিংড়ি চাষসহ বেশ কয়েকটি প্রফেশনে আমাদের যারা কাজ করতো, তাদের বের করে দিচ্ছে। তারা বলছে, এগুলো আমরা আগেই জানিয়েছিলাম। এখন এক্ষেত্রে আমাদের তেমন কিছুই করার নেই। তিনি বলেন, তবে এর মধ্যেও নেপালের সঙ্গে সৌদি সরকারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। ওই চুক্তির আলোকে আগামী ৫ বছর তারা গার্ড হিসাবে নেপাল থেকে লোক নেবে। ওই ধরণের চুক্তির অধীনে যদি আমরা যেতে পারতাম, তাহলে আমরাও লোক দিতে পারতাম। যেহেতু নেপালিদের একটা স্পেশালাইজেশন হয়ে গেছে, তাই ওই জায়গাটাতে আমরা ঢুকতে পারিনি।
এই অবস্থায় সৌদি আরব থেকে আমাদের কর্মী ফেরত আসার সংখ্যাটা আরও বাড়তে থাকবে। এখন সরকার যদি কোন নেগোসিয়েশনে গিয়ে বাজার তৈরি করতে পারে বা এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারে, এডুকেশনটাকে মেইনস্ট্রিমে নিতে পারে তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের শ্রমবাজার আরও বেশি কার্যকর হবে। ড. তাসনীম বলেন, নেগোসিয়েশন করে সরকার কতটুকু সফল হবে জানি না, তবে এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে এডুকেশন সিস্টেমটা ঢেলে সাজাতে পারে। অতি অল্প সময়ে দেশটি গিয়ে ফিরে আসা কর্মীদের প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক জানান, সৌদিতে এখন মুসানেব সিস্টেমে লোক যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে মুসানেব সিস্টেমে গেলে কাউকে স্বল্প সময়ে ফেরত পাঠানোর কথা না। এমনও হতে পারে মুসানেব সিস্টেমের বাইরে ওই দেশের এবং এই দেশের দালালচক্র মিলে লোক পাঠাচ্ছে, যাদের আসলে কোন চাকরি নেই। জাল জালিয়াতি করে কোনরকম কাগজ বানিয়ে দিচ্ছে। যেটা মুসানেব সিস্টেমের বাইরে। এক্ষেত্রে করণীয় কি জানতে চাইলে এই অভিবাসন বিশেষজ্ঞ বলেন, যার বা যাদের মাধ্যমে যাচ্ছে, সরকার তাদেরকে ধরতে পারে। বলতে পারে টাকা ফেরত দিতে। আর ওই দেশের যারা এসব করছে তাদের ব্লাকলিস্টেট করতে পারে। আমাদের রিক্রুটিং এজেন্সিকে সতর্ক করে দিতে পারে, যেনো তাদের সঙ্গে কোন কার্যক্রম না করে। যদি করে, তাহলে লাইসেন্স বাতিল করে দেবে সরকার। সরকার কিছুটা পদক্ষেপ নিচ্ছে জানিয়ে তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, গতবার ১০০টার মতো এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে আরও কঠোর হতে হবে।