শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৬ অপরাহ্ন
কালের খবর: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উচ্চশিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, বিশ্বায়নের এই যুগে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে মানসম্পন্ন ও সময়োপযোগী উচ্চশিক্ষার কোন বিকল্প নেই।
রবিবার সকালে তেজগাঁওস্থ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন প্রদত্ত ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক-২০১৫ ও ২০১৬’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং গবেষণার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা এবং উদ্ভাবনী শক্তিই পারে সকল প্রতিকূলতা এবং প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে সভ্যতাকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে।’
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) উদ্যোগে ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’ ২০১৫ ও ২০১৬ প্রদান অনুষ্ঠানে এ বছর ২৬৫ জন কৃতী শিক্ষার্থীকে এই পদকে ভূষিত করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্ব-স্ব অনুষদে সর্বোচ্চ নম্বর বা সিজিপিএ অর্জনের স্বীকৃতি হিসাবে ২০১৫ সালের জন্য ১২৪ জন এবং ২০১৬ সালের জন্য ১৪১ শিক্ষার্থী এই পদক লাভ করেন ।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন।
ইউজিসি’র চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। এছাড়া পদকপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যত্বত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী রুবাইয়া জাবিন লতা এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী নূর মোহাম্মদ অনুষ্ঠানে স্ব-স্ব অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
ইউজিসি’র সদস্য, প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগম স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
সরকারের মন্ত্রী পরিষদ সদস্যগণ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যগণ, সরকারের পদস্থ কমৃকর্তাবৃন্দ, ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান, ইউজিসির বর্তমান এবং সাবেক সদস্যবৃন্দ, সরকারি ও বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়সমূহের উপাচার্যগণ, শিক্ষাবিদ, স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকবৃন্দ এবং ইউজিসির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক বিজয়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, এতগুলো ছেলে-মেয়ে আমাদের কাছ থেকে স্বর্ণ পদক পেল অর্থাৎ কত মেধা আমাদের দেশে রয়েছে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা পৃথিবীর অনেক দেশের থেকে মেধাবী বলে আমি বিশ্বাস করি।
সরকার প্রধান বলেন, শুধু এখানে মেধার বিকাশে সুযোগটা সৃষ্টি করে দেয়ার দরকার। মেধা ও মনন চর্চার একটি সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া এবং সেটা করতে পারলে আমাদের ছেলে-মেয়েরা যে, কত ভাল করতে পারে সেটা আমার জানা আছে।
তিনি বলেন, আজকে ২৬৫ জনকে আমরা স্বর্ণপদক দিলাম। আমি সত্যই খুব আনন্দিত। আর ২০১৬ সালের বেলায় আমি লক্ষ্য করলাম মেয়েদের সংখ্যাটা বেশ বেড়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বলতেন একটি সমাজে নারী-পুরুষ সকলেরই সমান অধিকার থাকা উচিত, সবাইকেই সমান সুযোগ করে দিতে হবে। কাজেই আমরা সেটারই চেষ্টা করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় ছেলেদের পড়াশোনায় আরো মনযোগী হবার আহবান জানিয়ে বলেন, শুধুৃ লেখাপড়া নয়, খেলাধূলা এবং সংস্কৃতি চর্চা সবদিকেই প্রচেষ্টা থাকতে হবে। এজন্য তাঁর সরকার প্রত্যেকটি উপজেলায় মিনি স্টেডিয়াম করে দেবে যেন সেখানে সারাবছর খেলাধূলা চলতে পারে।
তিনি বলেন, সবাইতো চলে গেছে আমরা দুই বোনই বেঁচে আছি (তিনি ও শেখ রেহানা)। আমরা কখনই আমাদের সন্তানদের পড় পড় পড়- এভাবে বলি না, বরং বলি এটা তোমার পড়া এটা তোমাকে পড়তে হবে। নিজের গরজেই পড়তে হবে।
দীর্ঘ সংগ্রামের পথ বেয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এই স্বাধীনতা যেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয় তা নিশ্চিত করার জন্যও শিক্ষার্থীদের প্রতি আহবান জানান।
আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশে গ্রামে গ্রামে ইন্টারনেট সুবিধা গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী মার্চ-এপ্রিল মাসেই আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু উপগ্রহ-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হবে। আমরা স্যাটেলাইট যুগেও চলে যাচ্ছি। অর্থাৎ আমাদের আকাশ থেকে একেবারে সাগরের তলদেশ (নেভীর জন্য সাবমেরিন) পর্যন্ত সব জায়গাতেই বাংলাদেশ বিচরণ করবে সেভাবেই আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলে যাচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, কাজেই এই যে আমরা পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র করছি, সেনা-নৌ-বিমানবাহিনী থেকে শুরু করে প্রতিটি বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানকে আধুনিক করে গড়ে তুলছি, মেডিকেল থেকে শুরু করে বহুমুখী বিশ্ববিদ্যালয় করে দিচ্ছি সেখানেও তো আমাদের ভবিষ্যতে শিক্ষক লাগবে, প্রযুক্তিবিদ লাগবে, ডিজিটাল বাংলাদেশের অনেক দক্ষ জনবল দরকার। সেজন্যই শিক্ষাটা আমাদের একান্তভাবে প্রয়োজন। এইযে বিপুল কর্মযজ্ঞ আমরা শুরু করেছি সেটা এগিয়ে নিয়ে যাবে আজকের প্রজন্ম।
আজকের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকেই আগামীর কর্ণধার গড়ে উঠবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তোমরাইতো আমাদের সোনার ছেলেমেয়ে, তোমরাই সোনার বাংলা গড়ে তুলবে। সেটাই আমরা আশা করি। কারণ, বাংলাদেশকে আমরা চাচ্ছি ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে। আর ২০৪১ সালে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। এই কাজটা করে দিতে হবে আজকের তোমরা যারা মেধাবী ছেলে-মেয়ে আছো তাদের।
এ সময় জাতির পিতা একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার মধ্যদিয়ে স্বল্প আয়ের দেশকে যে পর্যায়ে রেখে যান সেখান থেকে এখন বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে গ্রাজুয়েশন লাভ করতে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আর কেউ আগের মতো আমাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারবে না। কারণ, আমরা সেই জায়গাটায় পদার্পণের সক্ষমতা অর্জন করেছি। ইনশাল্লাহ আগামী মার্র্চ মাসেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে মর্যাদা পাবে।
জাতির পিতা স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে শিক্ষাকে মানুষের সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে জাতির পিতার শিক্ষা সম্প্রসারণের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠনের তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা ১৯৭২ সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন ছাত্রবেতন মওকুফ করেন। হাজার হাজার বিধ্বস্ত স্কুল-কলেজ পুনর্গঠন করেন। নতুন নতুন বিদ্যালয় ও কলেজ ভবন নির্মাণ করেন।
উচ্চশিক্ষার বিকাশে তিনি ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর পদাংক অনুসরণ করেই এটাকে আমরা আরো শক্তিশালী করতে চাচ্ছি, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ৭৫-এর বিয়োগান্তক অধ্যায়ের দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে শিক্ষার উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়। ফলে মাত্র দু’বছরে সাক্ষরতার হার ৪৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়।
তিনি বলেন, এ অর্জনের স্বীকৃতি হিসাবে বাংলাদেশ ‘ইউনেস্কো সাক্ষরতা পুরস্কার ১৯৯৮’ লাভ করে এবং পুরস্কারের টাকায় তাঁর সরকার শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া শুরু করে। কিন্তুু ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই স্বাক্ষরতার হার না বাড়িয়ে উল্টো কমিয়ে ৪৪ শতাংশে নামিয়ে আনে, যা অত্যন্ত দর্ভাগ্যজনক।
সরকার প্রধান বলেন, তাঁর সরকারের শিক্ষাখাতের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আমরা চাই বাংলাদেশে একটি মানুষও নিরক্ষর থাকবে না।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের আলোকে সমন্বিত শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। শিক্ষানীতিতে জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে মানবিকতা ও আলোকিত মানুষ সৃষ্টির দিকনির্দেশনা রয়েছে।
দেশের শিক্ষার বিস্তারে তাঁর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপসমূহ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উচ্চশিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করতে জাতীয় সংসদে ‘এক্রিডিটেশন কাউন্সিল আইন’ পাস হয়েছে এবং শিগগিরই এর কার্যক্রম শুরু হবে।
তাঁর সরকারই দেশে প্রথম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১২টি নতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি ও ৪৪টি নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দেশে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৪টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯৫টি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম গতিশীল করার লক্ষ্যে ২০১০ সালে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ পাশ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সিলেট, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে তিনটি নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। যে সব জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় নেই, সে সব জেলায় একটি করে সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।
বক্তব্যের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা, জাতীয় চার নেতা, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের এবং ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর বিদ্রোহে নিহতদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান জানান, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স সাবসিডিয়ারি কোর্সে ‘বাংলা ভাষা’ এবং ‘বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের ইতিহাস’ বিষয় দুটি পাঠ্য করার জন্য ইতোমধ্যেই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।