ইলেকট্রনিক সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএসএসএবি) প্রাথমিক পর্যবেক্ষণেও ভবনটি ঘিরে ব্যাপক অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটির ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মনজুর আলম কালের খবরকে  বলেন, দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে যা দেখা গেছে, তা কল্পনাতীত। এত বড় ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে জরুরি নির্গমনের কোনো একটি পথও নেই। অগ্নিনিরাপত্তামূলক দরজাও ছিল না। যে আয়তনের ভবন, সেখানে অন্তত চারটি সিঁড়ি থাকার কথা। ছিল মাত্র দুটি। ছাদও তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল। এটা ভয়াবহ অন্যায়। এ ছাড়া আগুন লাগলে শ্রমিকরা কোন দিকে বের হবে, এমন কোনো নির্দেশিকা নেই।

তিনি বলেন, ফায়ার মহড়া না হওয়ায় অধিকাংশ শ্রমিক চারতলায় গিয়ে জড়ো হন। সেখানে একসঙ্গে অধিকাংশের অঙ্গার দেহ পাওয়া যায়। আমাদের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের মিল আছে।

এদিকে, অগ্নিকাে ৫২ জনের মৃত্যুর ঘটনায় সজীব গ্রুপের কর্ণধার মো. আবুল হাসেমসহ আটজনকে আসামি করে গতকাল শনিবার হত্যা মামলা করেছে পুলিশ। সাধারণত এ ধরনের ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর ধারায় মামলা হলেও রূপগঞ্জের ঘটনায় হত্যা মামলা করা হয়েছে। হাসেমসহ সব আসামিকে গতকালই গ্রেপ্তার করে চার দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

শনিবার বিকেলে তাদের আদালতে তুলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা খাতুন চার দিন মঞ্জুর করেন। আদালত থেকে বের হওয়ার পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আবুল হাসেম বলেন, ‘আমার কোনো বক্তব্য নেই। মামলা হয়েছে, সেখানেই সব হবে।’

এর আগে দুপুরে হাসেমসহ আটজনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২-সহ কয়েকটি ধারায় আসামি করে মামলা করেন ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক নাজিম উদ্দিন মজুমদার। আসামিরা হলেন- সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান পরিচালক মো. আবুল হাসেম, তার চার ছেলে হাসীব বিন হাসেম, তারেক ইব্রাহীম, তাওসীব ইব্রাহীম, তানজীম ইব্রাহীম, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহান শাহ আজাদ, উপমহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ ও প্রকৌশলী মো. আলাউদ্দিন। সজীব গ্রুপের কর্ণধার মো. আবুল হাসেমের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী। ২০০৮ সালে লক্ষ্মীপুর সদর আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরে যান তিনি। এরপর ২০১৪ সালে তাকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান আবুল হাসেম।

পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান কালের খবরকে  বলেন, রূপগঞ্জের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযুক্তদের দায়-দায়িত্বের বিষয় সেখানে উঠে আসবে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম কালের খবরকে  বলেন, ভবনটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। পুলিশ বাদী হয়ে রূপগঞ্জ থানায় আটজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেছে। এ ঘটনায় চেয়ারম্যান আবুল হাসেমসহ আটজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

রূপগঞ্জ থানার ওসি এ এফ এম সায়েদ কালের খবরকে  বলেন, সকালেই রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে জেলা পুলিশ হাসেম ফুডের চেয়ারম্যান আবুল হাসেমসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

শনিবার দুপুরে তাদের ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এনে রাখা হয়। বিকেলে হাতকড়া পরিয়ে হাঁটিয়ে পাশেই আদালতে নেওয়া হয়। রিমান্ড শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে অংশ নেন কোর্ট পরিদর্শক আসাদুজ্জামান। তিনি শুনানিতে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার হাসেম ফুডসে অগ্নিকাে র ঘটনায় বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, গ্রেপ্তারকৃতরা অতীতেও অপরাধ সংঘটিত করেছে। তাদের অবহেলার কারণেই এতগুলো প্রাণ ঝরে গেছে। এ প্রতিষ্ঠানে নারী ও শিশুদের বন্দি করে কাজ করানো হতো। বন্দি করে রাখা হতো। তাই রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে।’

নিহত ব্যক্তিদের পক্ষ নিয়ে শ্রমিক নেতা অ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান বলেন, এ প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের ওপর অনেক নির্যাতন চলত, তার বহিঃপ্রকাশ এই ঘটনা। তাই গ্রেপ্তারকৃতদের রিমান্ডে নেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি।

রিমান্ডের বিরোধিতা করে আসামিপক্ষের আইনজীবী মাহাবুব আলম লিটন বলেন, এটি একটি নিছক দুর্ঘটনা। এ প্রতিষ্ঠানে মালিকের ছেলেদের শেয়ার রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিষয়ে তাদের কোনো ক্ষমতা নেই। তা ছাড়া গ্রেপ্তারকৃতরা দেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিক এবং রাজস্ব প্রদানকারী। রিমান্ড বাতিলের দাবি ও জামিন প্রার্থনা করছি।

রিমান্ড আবেদনে রূপগঞ্জ থানার পরিদর্শক হুমায়ুন কবির মোল্লা উল্লেখ করেন, ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘাটনসহ জড়িত অজ্ঞাতনামা আসামিদের সঠিক নাম-ঠিকানা সংগ্রহ ও ঘটনায় কার কী ভূমিকা ছিল, তা উদ্ঘাটন করার জন্য আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।

যে কারণে হত্যা মামলা: কেন হত্যা মামলা করা হলো- এমন প্রশ্নে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান কালের খবরকে  বলেন, ভবনটিতে কোনো জরুরি নির্গমন ব্যবস্থা ছিল না। প্রতি তলায় প্রায় ৩৫ হাজার বর্গফুট জায়গা। মাত্র দুটি সিঁড়ি। তার মধ্যে একটি আবার বন্ধ ছিল। প্রতিষ্ঠানটির মালিক একজন পুরোনো ব্যবসায়ী। তার বয়স ৭০ বছর। অভিজ্ঞতা থেকেও তার জানা উচিত ছিল, এত বড় একটি ভবনে কী কী নিরাপত্তা সরঞ্জাম না থাকলে তা যে কোনো মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এটা অবহেলা হিসেবে দেখা হচ্ছে না। জেনেশুনেই এতগুলো শ্রমিককে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাই হত্যার ধারায় মামলা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যে ইঞ্জিনিয়ার ভবনের নকশা তৈরির সঙ্গে সংশ্নিষ্ট ছিলেন তাকেও আসামি করা হয়েছে।

এজাহার: ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. নাজিম উদ্দিন মজুমদার বাদী হয়ে করা মামলার এজাহারে বলা হয়- ঘটনার দিন তিনজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে তাদের মৃত্যু হয়। পেনাল কোডের ৩০২, ৩২৩, ৩২৪, ৩২৫, ৩২৬ ও ৩০৭ ধারার অপরাধ করেছে।

এজাহারে আসামিদের বিষয়ে বলা হয়েছে- আবুল হাসেম, তার ছেলে হাসিব বিন হাসেম, তারেক ইব্রাহীম, তাওসীব ইব্রাহীম ও তানজীম ইব্রাহীম এবং সজীব গ্রুপের সিইও শাহান শাহ আজাদ, হাসেম ফুডস লিমিটেডের ডিজিএম মামুনুর রশিদ ও একই প্রতিষ্ঠানের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কাম অ্যাডমিন মো. সালাউদ্দিনসহ অজ্ঞাত আসামিদের উপস্থিতি ও নির্দেশে কারখানার ছয়তলা ভবনে আগুন লাগার সময় দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠতলা পর্যন্ত প্রধান গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এবং জরুরি বহির্গমনের জন্য পর্যাপ্ত সিঁড়ি না থাকার কারণে হাসেম ফুডস লিমিটেডের কর্মকর্তা-কর্মচারী আগুনে পুড়ে মারা যান। সাতজন শ্রমিক আহত হন।

মিথ্যা আশ্বাসে পুড়ল অধিকাংশ: গতকাল রূপগঞ্জে স্থানীয় অনেক বাসিন্দা ও শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়। হাসেম ফুডসের অদূরে চায়ের দোকান রয়েছে বাবুল হোসেনের। তিনি জানান, বেঁচে আসা একাধিক শ্রমিক তাকে জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানটির ফ্লোর ইনচার্জ মাহবুব হোসেনের মিথ্যা আশ্বাস ও খামখেয়ালির কারণে অধিকাংশের প্রাণ গেছে। আগুন লাগার পর বাঁচানোর আশা দিয়ে চারতলার সবাইকে নিয়ে এসেছিলেন তার এসি কক্ষে। বন্ধ করে দেওয়া হয় সিঁড়ির তালা। আগুন লাগার ঘণ্টাতিনেকের মধ্যে অন্তত ৪৬ শ্রমিকের সঙ্গে মাহবুবও মারা যান একজনের লাশ হস্তান্তর :অগ্নিকাে নিহত একজনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তার নাম মোরসালিন মিয়া (২২)। গতকাল বিকেল ৩টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গ থেকে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মরদেহ দাফনের জন্য ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

মোরসালিন মিয়ার বাড়ি দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দরে। চার বছর আগে তিনি হাসেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি বেতন পেতেন সাত হাজার টাকা।

মোরসালিনের মামা জুয়েল হক জানান, ‘মোরসালিনের বাবা আনিসুর রহমান গ্রামে কৃষিকাজ করেন। মোরসালিন এখানে কাজ করে যা আয় করত, তার একটা বড় অংশ বাড়িতে পাঠাত। সে মারা যাওয়ায় তার পরিবার অর্থ সংকটে পড়বে। তার পরিবার আর্থিক ক্ষতিপূরণ চায়।’

সিআইডির ডিএনএ ফরেনসিক ল্যাবের সহকারী অ্যানালিস্ট নুসরাত ইয়াসমিন সমকালকে বলেন, গতকাল সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ চত্বরে নিখোঁজ ৩৭ জনের জন্য ৫৩ স্বজনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।

অভিযান সমাপ্ত: হাসেম ফুডসের কারখানার ভবনটিতে ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন ছিল না বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) দেবাশীষ বর্ধন। শনিবার প্রায় ৪৫ ঘণ্টা পর বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার পর তিনি সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ফায়ার সার্ভিস থেকে প্রতিটি কারখানার ভবনের জন্য ফায়ার সেফটি প্ল্যানের একটি অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু ভবনটির নকশা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের অনুমোদন ছিল না। রাজউকের ছাড়পত্র, কারখানা অনুমোদনের ছাড়পত্র, পরিবেশের ছাড়পত্র নিয়েছিল কিনা, তা আমাদের জানা নেই। কারখানার আগুনটি ছিল হার্ড ফায়ার। এ ভবনে একাধিক সমস্যা রয়েছে। ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে নেট দিয়ে ব্যারিকেড ছিল। আবার কিছু কিছু জায়গায় তালাবদ্ধ ছিল। এর মধ্যেও আমরা কাজ করেছি। পাঁচতলার ফ্লোর ধসে পড়েছে। ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বুয়েট থেকে বিশেষজ্ঞ এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর তারা পরিত্যক্ত ষোষণা করবেন।’

আইএলওর উদ্বেগ: রূপগঞ্জের কারখানায় অগ্নিকাে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘের শ্রমবিষয়ক সংস্থা আইএলও। এক বিবৃতিতে নিহত ও আহতদের শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছে সংস্থাটি।