ঝালকাঠি প্রতিনিধি, কালের খবর :
ঝালকাঠি সদরের বাসন্ডা ইউনিয়নের কৃষ্ণকাঠি (বিকনা) আ. জব্বার মাঝির ছিল ১২ কাঠা জমি ও ১১ জন সন্তান। শ্রমজীবীর কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। শেষ বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হন আ. জব্বার। সন্তানরা পিতাকে সুস্থ করতে জমি ও সহায়-সম্বল বিক্রি করে চিকিৎসা খরচ বহন করেছেন। ঘরের বসতভিটার বাইরে আর একখণ্ড জমিও নেই তার। ১১ সন্তানের মধ্যে মেয়ে সাতজন ও ছেলে চারজন। ছেলেরা সবাই শ্রমজীবীর কাজ করে এবং মেয়েরা গৃহপরিচারিকার কাজ করে। আ. জব্বারের মেয়ে বিউটি বেগমের পাশের গ্রাম লাটিমসার লস্কর বাড়ির এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ে তিন বছরের মধ্যে একটি পুত্র সন্তান হওয়ার কয়েক মাস পরেই ছেলে সন্তানসহ ফেলে রেখে চলে যায়। গৃহপরিচারিকার কাজ করেই ভাড়া বাসায় থেকে ছেলেকে পড়াশোনা করানো, নিজেদের সংসারের খরচ বহন করে অতিকষ্টে জীবনযাপন করছিল বিউটি। বিনা খরচে সরকারি ঘর বরাদ্দের জন্য করলে একখানা ঘর বরাদ্দ পাই। সদর উপজেলার বাসন্ডা ইউনিয়নের কুনিহারি গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর অধীনে ৩৪নং ঘরটি বরাদ্দ পান বিউটি।
দীর্ঘ ৪০ বছর বয়স পার করে অবহেলা-কষ্ট উপেক্ষায় জীবনযাপন করে নিজের নামে তিনি পেলেন জমির দলিল ও ঘরের কাগজ। তাই উচ্ছ্বাস যেন কমছে না বিউটির। বিউটি জানান, স্বামী চলে যাওয়ার পর থেকে অনেক কষ্ট করে চলতেছি। মানুসের বাসায় কাজ করে ছেলেটাকে লেখাপড়া করাচ্ছি। সরকারি কলেজ থেকে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষার্থী। থাকার কোনো জায়গা নেই। এখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী যে ঘর দিচ্ছে তাতে শুকরিয়া। এত সুন্দর ঘর আমাদের দেবে তা ভাবতে পারিনি। ভাবছিলাম, টিন-কাঠের ঘর পাব। পেয়েছি পাকা ঘর। আহ কি আনন্দ।
কৃষ্ণকাঠি টাইগার স্কুল সংলগ্ন জাবেদ খান ইটভাঁটা শ্রমিকের কাজ করেন। ছোটবেলা থেকেই ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কারণে তাকে বেছে নিতে হয় শ্রমজীবীর পেশা। শুকনো মৌসুমে ইটভাঁটার শ্রমিক আর বর্ষা মৌসুমে ইজিবাইক চালক। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট জাবেদ। তার পিতা আনোয়ার হোসেন রিকশা চালিয়ে জীবনযাপন করতেন। গাছ থেকে পড়ে কোমর ভেঙে যায় আনোয়ার হোসেন খানের। তাকে সুস্থ করতে সহায়-সম্বল যা ছিল সবই শেষ হয়ে গেছে। এখন আছে শুধু বসতঘরটি। বাবার একটি ঘর পাঁচজনে ভাগ করলে আর কি থাকে। ঘরের জন্য আবেদন করে সদর উপজেলার বাসন্ডা ইউনিয়নের কুনিহারি গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর অধীনে ৩১নং ঘরটি বরাদ্দ পেয়েছেন জাবেদ।
নতুন পাওয়া ঘর ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে বললেন, টিনশেড পাকা ঘরটি তার খুব পছন্দ হয়েছে। থাকার কক্ষের সঙ্গে রান্নাঘর। পয়োঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থাও ভালো। পরিবার নিয়ে এখন খুব ভালোভাবে থাকতে পারব।
ঘর পেয়ে আনন্দে কাঁদলেন রাজাপুরের সেই রহিমা বেগম। অসুস্থ স্বামী নিয়ে কোনো সময় কনকনে শীতে তীব্র ঠান্ডা বাতাসে, কোনো সময় বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে থাকতে হতো গৃহহীন স্বামীর ভিটায়। স্বামীর ঘরের ভিটা মাটি ছাড়া আর কোনো আয়ের উৎস নেই তাদের। ওই ভিটায় ছিলও ভাঙা টিনের পলিথিনের চালা ও ভাঙা বেড়ার ছোট এক কক্ষ বিশিষ্ট একটি ঝুপড়ি ঘর। সেই ঘরে অতি কষ্টে বসবাস করে আসছিল অসুস্থ মন্নাফ ও তার স্ত্রী রহিমা বেগম।
সরেজমিনে ঝালকাঠির রাজাপুরের গালুয়া ইউনিয়নের জীবনদাসকাঠি গ্রামে গেলে রহিমা বেগম জানান, সাথি নামে তার একটি মেয়ে ছিল, তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। জামাই গাড়ির হেলপার। আসলাম (১৯) নামে তার একটি ছেলে ছিল। ২০ বছর আগে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে আজো ফিরে আসেনি। তার স্বামী মন্নাফ (৮০) কাঠমিস্ত্রি কাজ করে সংসার চালাতেন। স্বামী দশ বছর আগে কাজ করতে গিয়ে ঘরের মাচান থেকে পড়ে অসুস্থ হয়ে যায়। অর্থাভাবে ভালো ডাক্তার না দেখাতে পারায় সেই থেকে আস্তে আস্তে প্যারালাইজে পরিণত হয়ে যায়। তার সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, পঞ্চাশোর্ধ্ব রহিমা চলতে কষ্ট হলেও বেঁচে থাকার লড়াই করে আসছেন। অসুস্থ স্বামীর ন্যূনতম ওষুধ কিনতে ও তার মুখে দুমুঠো আহার তুলে দিতে এবং নিজে বেঁচে থাকতে অন্যের ঘরে ঝিয়ের কাজ, কখনও মাটি কাটার কাজসহ যখন যে কাজ পান তাই করেন। অর্ধাহার-অনাহারে থাকলেও ছিল না মাথা গোঁজার ঠাঁই। একটি ঘর পাওয়ার আশায় এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যানসহ অনেকের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি।
তাকে নিয়ে ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ঘর নাই, খাবার নাই। যা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোক্তার হোসেনের নজরে আসলে তিনি উপজেলা ত্রাণ তহবিল থেকে খাদ্য সামগ্রী নিয়ে নিজেই হাজির হন রহিমার বাড়িতে। তিনি ওই পরিবারের সার্বিক খোঁজখবর নেন। আশ^াস দেন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একটি ঘর দেওয়ার। ২৩ জানুয়ারি উপজেলার গালুয়া ইউনিয়নের চারাখালি গ্রামের ১নং ওয়ার্ডে সরকারের নির্মিত ঘরের ১১নং ঘরের চাবিটি রহিমার হাতে তুলে দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোক্তার হেসেন। ঘরের চাবিটি হাতে পেয়ে আনন্দে-আবেগে কেঁদে ফেলেন রহিমা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোক্তার হোসেন জানান, চারাখালি গ্রামে প্রথমবারের মতো ৩১টি জমিসহ ঘর ও তার দলিল হস্তান্তর করা হয়েছে। যার ১১নং ঘরের চাবিটি দেওয়া হয়েছে রহিমাকে। প্রত্যেকটি ঘরে দুটি কক্ষ, একটি রান্নাঘর ও একটি ল্যাট্রিন রয়েছে। একটি ঘর নির্মাণে বরাদ্দ ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা।
জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী জানান, ২০১৯ সালের জুন মাসের সর্বশেষ জরিপের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঝালকাঠি জেলার চার উপজেলায় জমিও নেই, ঘরও নেই এমন জনসংখ্যা রয়েছে ১ হাজার ২২১ জন। এদের মধ্যে ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন ৪৭৪ জন। যার মধ্যে ঘর দেওয়া হয়েছে ২৩০টি। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গৃহহীনদের জন্য এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। ২৩ জানুয়ারি সারা দেশের সঙ্গে একযোগে তিনি ঝালকাঠি জেলার ২৩০টিসহ ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১টি ঘর উদ্বোধন করেন। বিশে^ প্রথম গৃহ ও ভূমিহীনদের জন্য এতগুলো ঘর একত্রে দিয়ে রেকর্ড গড়েছেন।
জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী আরও জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্পকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। জমি ও গৃহহীনদের জন্য ‘ক’, জমি আছে ঘর নাই ‘খ’ এবং অসহায় দরিদ্রদের জন্য ‘গ’ শেণি। ‘ক’ তালিকাভুক্ত প্রতিটি ঘর ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা বরাদ্দ ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উদ্বোধন করা হয়েছে ঝালকাঠি সদর উপজেলার নবগ্রাম-বিনয়কাঠি ইউনিয়নে ২০ এবং বাসন্ডা ইউনিয়নের কুনিহারি আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পে ৪৫টি, নলছিটি উপজেলার ভৈরবপাশা ইউনিয়নে ৪০টি, রাজাপুর উপজেলার গালুয়া, মঠবাড়িয়া ও সাতুরিয়া ইউনিয়নে ৭৫টি এবং কাঠালিয়া উপজেলার আমুয়া, কাঁঠালিয়া ও শৌলজালিয়া ইউনিয়নে ৫০টি। নিজ নিজ উপজেলায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২৩ জানুয়ারি সকাল ১০টায় একযোগে উদ্বোধন করেন।