শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৪ অপরাহ্ন
টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি এমন দুটি পত্রিকায় ছাপাতে দেয়া হয়েছিল, যার মধ্যে ইংরেজি দৈনিকটির এক কপিও নারায়ণগঞ্জে পৌঁছে না। আর বাংলা দৈনিকটির প্রচারসংখ্যা মাত্র ৭ কিংবা ৮ কপি। আবার নিজেদের ওয়েবসাইটেও খুঁজে পাওয়া যায়নি সেই টেন্ডার বিজ্ঞপ্তির ঘোষণা।
অথচ সেই টেন্ডারের ১৩টি উন্নয়ন কাজের মোট ব্যয় ১২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এভাবেই চলছে নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের কোটি কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ে লুকোচুরি।
খোদ জেলা পরিষদের এক শীর্ষ কর্তাব্যক্তির বেসরকারি পিএ (ব্যক্তিগত সহকারী) হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিরই রয়েছে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আর নিজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান না থাকায় অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকার টেন্ডার ও আরএফকিউ (রিকোয়েস্ট ফর কোটেশন) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করছেন ওই শীর্ষকর্তার আত্মীয়রা।
সম্প্রতি জেলা পরিষদের এই বিশাল অংকের প্রকল্প টেন্ডার নিয়ে প্রায় দেড় ডজন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকরা কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করলে বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
দৈনিক যুগান্তরের কাছে এসব ঠিকাদার তুলে ধরেছেন অনিয়ম আর দুর্নীতির খতিয়ান। যদিও জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই বলে দাবি করে বলেছেন, সব কিছু স্বচ্ছতা ও নিয়মতান্ত্রিকভাবেই হচ্ছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ওটিএম (ওপেন টেন্ডার মেথোড) প্রক্রিয়ায় মোট ১২ কোটি ৯৩ লাখ টাকার ১৩টি উন্নয়ন কাজের টেন্ডার আহবান করে নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ। নিয়ম মোতাবেক বহুল প্রচারিত ২টি (বাংলা ও ইংরেজি) দৈনিকে এ টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কথা থাকলেও ২টি অখ্যাত পত্রিকায় এ টেন্ডার নোটিশ ছাপানো হয়।
জেলা পরিষদের নিজস্ব ওয়েবসাইটেও এ টেন্ডার বিজ্ঞপ্তির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
ঠিকাদাররা জানান, আমরা সিপিটিইউয়ের (সেন্ট্রাল প্রকিউরম্যান্ট টেকনিক্যাল ইউনিট) ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এ টেন্ডার বিজ্ঞপ্তির নোটিশ পেয়েছি। কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন আমরা দেখতে পাই টেন্ডার কোটেশনে কিছু এডিশনাল আইটেমের ক্ষেত্রে বিওকিউতে (ব্যালেন্স অব কোয়ানটিটি) এলএস (লাম-সাম) বা থোক অর্থ উল্লেখ করা হয়নি।
এতে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় রেট নির্ধারণের জটিলতা সৃষ্টি হয় এবং ১০% লেস (কম) বা বেশি হলে নন-রেসপনসিভ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই আমরা প্রায় ১৯ থেকে ২০ জন ঠিকাদার জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর টেন্ডারটি সংশোধন বা বাতিলের জন্য লিখিত আবেদন করি।
পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষ তিনবার করিজেন্ডাম (সংশোধনী) করলেও সেই থোক অর্থের কলামে কোনো রেট বা কোড উল্লেখ না করেই ২৯ নভেম্বর টেন্ডার ড্রপ ও ওপেনিংয়ের তারিখ নির্ধারণ করে।
লিখিত আবেদনকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মিজান এন্টারপ্রাইজের মালিক মিজানুর রহমান, জেএম এন্টারপ্রাইজের মালিক আল মামুন, মেসার্স হাসিব এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম সারোয়ার বাদলসহ কয়েকজন ঠিকাদার অভিযোগ করেন, টেন্ডারে স্বচ্ছতা আনতে যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ই-টেন্ডারের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেখানে কিছু অসাধু ব্যক্তি এ স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
শুধুমাত্র নিজেদের পছন্দের ঠিকাদারদের এ কাজ পাইয়ে দিতেই এই প্রক্রিয়ায় টেন্ডার দেয়া হয়েছে। আমরা ধারণা করছি- টেন্ডারের এডিশনাল আইটেমের লাম-সাম (থোক অর্থ) রেটটি গোপনে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে; যাতে আমরা রেট অনুযায়ী টেন্ডার কাজ থেকে বঞ্চিত হই।
তারা বলেন, সরকারি ছুটির পরদিন টেন্ডার ওপেন বা ড্রপিং হয়- এমনটি আমরা খুব কমই দেখেছি। জেলা পরিষদের এমন সাব-অ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ারও আছেন যারা অর্ধকোটি টাকার দামি প্রাইভেটকার হাঁকিয়ে চলেন।
তবে বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী মনোয়ার হোসেন। তিনি যুগান্তরকে জানান, ঠিকাদারদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বিষয়টি নিয়ে সিপিটিইউয়ের (সেন্ট্রাল প্রকিউরম্যান্ট টেকনিক্যাল ইউনিট) সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন, লাম-সাম কলামে রেট উল্লেখ করাটা মেন্ডেটরি বা আবশ্যক নয়। আমরা তিনবার টেন্ডার সংশোধন করেছি এবং এতে কোনো ভুল থাকলে সিপিটিইউয়ের পক্ষ থেকেই আমাদের টেন্ডার কার্যে বাধা দেয়া হতো। প্রকৃতপক্ষে ওটিএম প্রক্রিয়াটি ঠিকারদারদের কাছে অভ্যস্ত হয়ে উঠেননি বলে বুঝতে ভুল করছেন।
এ ব্যাপারে সিপিটিইউয়ের (সেন্ট্রাল প্রকিউরম্যান্ট টেকনিক্যাল ইউনিট) পরিচালক শামীমুল হক কালের খবরকে জানান, এডিশনাল আইটেম অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে গুডসের (পণ্য) জন্য রেট দেয়াটা বাধ্যতামূলক নয়। তবে আইটেমটি যদি কাজের হয় তবে রেট উল্লেখ করাটা বাঞ্ছনীয়।