শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৪১ অপরাহ্ন
কালের খবর : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা সাহিত্য-সংস্কৃতি বোঝে না। তারা মানুষের মঙ্গলের কথাও ভাবে না।‘আমাদের শিল্প সংস্কৃতি কেবল বাংলাদেশের সীমানায় না, বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে যাবে।’
বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের ইতিহাস তুলে ধরে এসব কর্মকাণ্ডে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যখনই সরকার গঠন করেছি, তখনই এ ব্যাপারে আন্তরিক থেকেছি। এবং আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করেছি আমাদের ঐতিহ্যগুলোকে ধরে রাখার জন্য। বইমেলা আমাদের এখানে হয়। এটা মনে রাখতে হবে, বইমেলা শুধু বই কেনাবেচা জন্য নয়। বইমেলা কিন্তু আকর্ষণ করে। আমাদের সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটাকে প্রসারিত করে। অজানাকে জানার সুযোগ করে দেয়। আমরা নিজেরাই বলি, এটা আমাদের প্রাণের মেলা। এই ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকে যে বইমেলা শুরু হয়, এই মেলা কিন্তু অনেক নবীন লেখককে তাদের সাহিত্যকর্ম প্রকাশের সুযোগ করে দেয়, আবার অনেক পাঠক তৈরি করে। কাজেই লেখক-পাঠক-পরিবেশক সবাইকেই আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। এই মেলা আমাদের জ্ঞান চর্চার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। কাজেই আমরা এই মেলার সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করি। আমাদের যে ঐতিহ্য রয়েছে, আমাদের যে ভাষা রয়েছে- এই ভাষার চর্চা আরও বৃদ্ধি হোক, সেটাই আমরা চাই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দু’টি ভূখণ্ড, এদের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ১২শ কিলোমিটার। দুই ভূখণ্ডের ভাষা-সংস্কৃতি- সবকিছুই ভিন্ন। দুই ভূখণ্ডের জনসংখ্যায় আমরা বেশি ছিলাম। তারপরও আমরা শোষিত-বঞ্চিত হচ্ছিলাম। তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তা মেনে নেয়নি।’
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। তারই প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিসসহ অন্যান্য সংগঠন মিলে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলে। তারই প্রস্তাবে ১৯৪৭ সালের ১১ মার্চ ধর্মঘট ডাকা হয়। ওই ধর্মঘট পালন করার সময় পিকেটিং করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক ছাত্রনেতা গ্রেফতার হন। সেই আন্দোলন ধীরে ধীরে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হয়ে তিনি সারাদেশ সফর করেন। এই আন্দোলনের একটা পর্যায়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়, তাকে আর মুক্তি দেওয়া হয়নি। কিন্তু বন্দিখানায় থেকেও যখনই তিনি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসেছেন, ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, কথা বলেছেন এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি সবসময় নির্দেশ দিয়েছেন। এসময় বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু অংশও পড়ে শোনান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কিন্তু ভাষার মর্যাদার সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। আমি এটুকু বলতে পারি- আজ আমাদের যা যা অর্জন, সবকিছুর পেছনে আমাদের মহান ত্যাগ যেমন রয়েছে, তেমনি বঙ্গবন্ধুরও অবদান রয়েছে। আওয়ামী লীগ যখন হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হলো, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করলো। কিন্তু যুক্তফ্রন্টকে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি। এরপর ১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়। সেই শাসনতন্ত্রেই কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এরপর জাতির পিতা ছয় দফার ভিত্তিতে যে সংগ্রাম করেছিলেন, তারই পথ বেয়ে, অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছয় দফা আন্দোলন, এরপর আমাদের স্বাধীনতা। আজকে স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘কিন্তু এরপর আবার যখন মার্শাল ল সরকার ক্ষমতায় আসে, তারা আর যা হোক, বাঙালি জাতির সংস্কৃতি, বাঙালি জাতির সাহিত্য চর্চা, বাঙালি জাতির বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো— এই কাজগুলোর দিকে তাদের তেমন কোনও মনোযোগ ছিল না। আর থাকতেও পারে না। কেন পারে না? খুব স্পষ্ট। যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে, সংবিধান লঙ্ঘন করে, তারা সবসময় আতঙ্ক থাকে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে। সেসময় আমরা জানতে পারলাম যে কানাডাপ্রবাসী দু’জন বাঙালি এবং তাদের সঙ্গে আরও কয়েকটি দেশের মাতৃভাষাপ্রেমী, তারা একটি সংগঠন গড়ে তোলে। তাদের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব আসে যে জাতিসংঘে আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু কোনও সংগঠন এককভাবে প্রস্তাব করলে হয় না, কোনও একটি দেশকে করতে হয়। যখনই এই খবরটি আমার কাছে এলো, সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রস্তাবনা পাঠালাম। আপনারা জানেন, ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ এই বাংলা একাডেমি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন যেমন করছে, তেমনি বিদেশি বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য অনুবাদ হচ্ছে, বাংলা ভাষার বিভিন্ন লেখা অন্য ভাষায় অনুবাদ হচ্ছে। সারাবিশ্বের সঙ্গে একটি সংযোগ হচ্ছে। এর দৃষ্টান্ত, প্রতিবার যখন বইমেলা হয়, কোনও না কোনও দেশের কবি-সাহিত্যিক উপস্থিত হন। তারা বাংলা ভাষা-সাহিত্যের চর্চা করেন, কত চমৎকারভাবে তারা বক্তব্য দেন। বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতি সম্পর্কে তারা যে ধরনের কথা বলেন, আমাদের উৎসাহিত করেন, এতেও বাঙালি জাতির মর্যাদা বিশ্বের দরবারে বৃদ্ধি পায়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে বাংলাদেশকে গড়তে চাই। আমরা এমন বাংলাদেশ গড়তে চাই যে বাংলাদেশ হবে অসাম্প্রদায়িক, যে বাংলাদেশ হবে শান্তিপূর্ণ। যে বাংলাদেশে প্রতিটি ধর্ম-বর্ণ তার নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে। এবং বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ কিংবা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যারা আছে, তারাও যেন তাদের ভাষা চর্চা করতে পারে। সেভাবেই আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। কারণ নিজেদের সংস্কৃতি, নিজেদের ভাষা, নিজেদের শিল্প-সাহিত্যকে যদি আমরা মর্যাদা দিতে না পারি, তার উৎকর্ষ সাধন করতে না পারি, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা কখনও বিশ্বের দরবারে আরও উন্নত হতে পারব না। তাই বাংলাদেশকে আমরা ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’
বক্তব্য শেষে অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধন ঘোষণা করেন তিনি। তিনি বইমেলা ঘুরে দেখেন। তার সঙ্গে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান প্রমুখ।
প্রায় পাঁচ লাখ বর্গফুট এলাকায় ৪৫৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭১৯টি ইউনিট এবং বাংলা একাডেমিসহ ২৪টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে মোট ১৫ হাজার ৫৩৬ বর্গফুট আয়তনের ২৫টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ১৩৬টি লিটল ম্যাগাজিনকে লিটল ম্যাগাজিন কর্নারে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এবারও মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে রয়েছে শিশুচত্বর। ওই কর্নারকে সাজানো হয়েছে শিশুকিশোরদের জন্য বিনোদন ও শিক্ষামূলক অঙ্গসজ্জায়।
বাংলা একাডেমিসহ মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পুরো ফেব্রুয়ারি মাস বইয়ের এ উৎসবে বই বিক্রি করবে ২৫ শতাংশ ছাড়ে।
ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা চলবে। ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে মেলা প্রাঙ্গণ। মাসব্যাপী গ্রন্থমেলায় এবারও ‘শিশুপ্রহর’ ঘোষণা করা হবে।