শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৫ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের খবর :
নগরীর ডেমরা-যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা-রামপুরা সড়কে পরিবহন সেক্টরের নিয়ন্ত্রণহীন বেপরোয়াপনা যেন কিছুতেই থামছেনা। এতে যাত্রী ও পথচারীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট লাখো মানুষের। এখানকার পরিবহন সেক্টরের অধিকাংশ মাদকাসক্ত চালক ও হেলপাররা ইদানিং আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অথচ পরিবহন মালিকেরা জেনেওে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় তারা এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। এছাড়াও পরিবহন সেক্টরে ব্যাপক চাদাবাজির কারণে খরচ ও মজুরি টার্গেট পূরণ করতে দ্রুত যাওয়ার প্রতিযোগীতাও মেতেছেন চালকরা। তাদের বেপরোয়াপনায় একের পর এক ছোট বড় দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। অথচ সংশ্লিষ্ট পরিবহন সেক্টর কর্তৃপক্ষসহ ট্রাফিক-থানা পুলিশের বিনা নজরদারি ও অভিযান না থাকার কারণে সড়কে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা প্রতিরোধ হচ্ছেনা।
অথচ গত শনিবার ২৫ মে মহাখালী আন্ত:জেলা বাস টার্মিনালে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, মাদকাসক্ত কোনো চালক বা হেলপারের হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং তুলে দেবেন না। চালক কিংবা হেলপারকে মাদকাসক্ত মনে হলে তার ডোপ টেস্ট করান। এ বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা আমরা করব।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নগরীর ডেমরা থেকে ডেমরা-যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা-রামপুরা সড়ক হয়ে শহরের বিভিন্ন রুটে কয়েকটি কোম্পানির নামে বাস বাস ও যাত্রীবাহী লেগুনা চলাচল করে। এর মধ্যে মীরপুর থেকে ষ্টাফ কোয়ার্টার রুটে অছিম পরিবহন নামে প্রায় ৪০ টি বাস, মোহাম্মদপুর থেকে ষ্টাফ কোয়ার্টার রুটে রাজধানী নামে ৩০ টি বাস, একই রুটে রমজান নামে ২০ থেকে ২২ টি, স্বাধীন নামে ৩০ টি যাত্রীবাহী বাস চলছে। অব্দুল্লাহপুর ভায়া ষ্টাফ কোয়ার্টার হয়ে বন্দর থানাধীন মদনপুরে চলছে ৩০-৩৫ টি বাস। ডেমরা-রামপুরা সড়কের মেরাদিয়া থেকে মীরপুরে আলিফ নামে চলছে ৩০-৩৫ টি বাস। একই রুটে রবরব নামেও চলছে ৩০-৩৫ টি বাস। এর মধ্যে রামপুরা থেকে মাদারটেক পর্যন্ত ২২ টি যাত্রীবাহী লেগুনা চলছে।
আরও জানা যায়,ডেমরা-যাত্রাবাড়ী সড়কে ডেমরা-যাত্রাবাড়ীসহ আশপাশে শতাধিক বৈধ-অবৈধ যাত্রীবাহী লেগুনা চলছে। একই রুটে গুলিস্থান থেকে রূপগঞ্জের গাউছিয়া পর্যন্ত গ্রীন বাংলা পরিবহন নামে চলছে ১২ টি যাত্রীবাহী মিনি বাস। গুলিস্থান থেকে ডেমরা ষ্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত আসিয়ান নামে চলছে ১৬ টি বাস। একইভাবে রানীমহল পরিবহন নামে চলছে আরও ১৬ টি বাস। এছাড়াও ঢাকা সিলেট মহাসড়ক রুটে ডেমরা-যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা-রামপুরা সড়ক দিয়ে আরও অন্তত ৪০ টি রুটের যানবাহন চলাচল করছে। আর প্রতিটি বাসে চালক,হেলপার ও কনট্রাক্টরসহ ৩-৪ জন লোক কাজ করে। তবে লেগুনার বেলায় ২ জন হলেই যথেষ্ট।
অভিযোগ, সড়কে চলাচলকারী ওই সব যানবাহনের অধিকাংশ চালক ও হেলপাররা মারাত্মক বেপরোয়া, অদক্ষ-অপ্রাপ্ত বয়স্ক, মাদকাসক্ত ও নিয়ন্ত্রনহীন অপরাধপ্রবন। ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার কারণে তাদের বেপরোয়াপনায় প্রতিনিয়ত সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছেই। ভাড়া ও অন্যান্য ছোট ছোট বিষয় নিয়ে প্রায়ই চালক-হেলপারা যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ অচরন করে। বাকবিতন্ডা হলে অনেক সময় যাত্রীদের গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়ার হুমকিও দেয়। সড়কে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসংখ্যবার বাস চালক-হেলপারদের সঙ্গে মারামারি ও রক্তারক্তির ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়াও ডেমরা-রামপুরা সড়কে চলাচলকারী যাত্রীদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত চালক-হেলপাররা অনৈতিক আচরন করে। কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে তারা কৌশলে এড়িয়ে যায়। তবে পরিবহন কর্তৃপক্ষরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে বলে জানিয়েছেন তারা।
আরও অভিযোগ, ওই সড়ক দুটিতে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বেপরোয়া অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও অদক্ষ চালকদের পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল। আর এসব যানবাহন পুলিশের নাকের ডগায় চলছে। এছাড়া চালকদের ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইলে কথা বলা, অতিরিক্ত পণ্য ও যাত্রী পরিবহন, ট্রাফিকদের দায়িত্বে অবহেলা, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা-মনোভাব, অদক্ষতা-অসতর্কতা, দ্রুত যাওয়ার মানসিকতাসহ নানা কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে। ডেমরা-রামপুরা সড়কে দেখা গেছে প্রায়ই নিয়ম অমান্য করে বাসচালকরা সামনের গাড়িকে ওভারটেক করতে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়, ঘটায় প্রাণহানী। পরিবহন মালিকরা আবার ফিটনেস পরিক্ষা না করেই অহরহ অদক্ষ ড্রাইভারের কাছে গাড়ি চালানোর দায়িত্ব দিচ্ছেন। আর ড্রাইভারদের অনুপস্থিতিতে আবার হেলপাররা গাড়ি চালায়।
ট্রাফিক বিভাগ ও ভুক্তভোগী যাত্রীদের অভিযোগ, ডেমরা থেকে ছেড়ে যাওয়া প্রায় সোয়া ২শ’ বাস প্রতিদিন ডেমরা-রামপুরা সড়কে চলাচল করছে। প্রায়ই ষ্টাফ কোয়ার্টার থেকে ছেড়ে যাওয়া বা শহর থেকে ছেড়ে আসা বাসগুলো ডেমরা-রামপুরা সড়কের আমুলিয়া, শেখের জায়গা, মোস্তমাঝির মোড়, নাগদারপাড় ও ত্রিমহোনী এলাকায় এসেই নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়। ওইসব এলাকায় ট্রাফিক ডিউটি না থাকায় যাত্রীরা চালক হেলপারের কাছে হেনস্তা হওয়ার ভয়ে এ বিষয়ে কিছু বলতেও সাহস পায়না। এদিকে আসন্ন ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় পরিবহন মালিকরাও যার তার হাতে গাড়ির চাবি তুলে দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এসব চালকদের অনেকেই মাদকাসক্ত, অনেকেরই লাইসেন্স নেই, কেউবা আবার লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে। এদিকে নিজেদের বিশ্রামের জন্য চালকরা হেলপারদের দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। তবে ট্রাফিক বিভাগ বলছে, প্রতিনিয়ত মামলা, রেকারিং ও ডাম্পিং হলেও চালক ও হেলপারদের দৌড়াত্ম্য যেন থামছেনা। এবারের ঈদে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যানজট নিয়ে নিয়ে ট্রাফিক বিভাগ চিন্তিত নয়, যাত্রী,পথচারী ও সড়ক ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পরিবহন মালিক ও পরিবহন সেক্টরের লোকজন যুগান্তরকে বলেন, আমরাও চালক-হেলপারদের কাছে জিম্মি। তারা গাড়ি না চালালে রোজগার হবেনা। যাত্রীরাও সড়কে চলতে পারবেনা। তবে চালকদের বেপরোয়পনার কারণ টার্গেট পূরণ। এছাড়া প্রতিটি পরিবহনেরন জন্য স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনকে চাদা দিতে হয়। পাশাপাশি তেল মবিল, হেলপার, কন্ট্রাক্টর ও মালিকের খোড়াকিসহ নিজের খরচ যোগাতেই চালকের হিমশিম খেতে হয়। তাই তারা সড়কে বেশি বেপরোয়া থাকে। শুধু পরিবহন চাদা বন্ধ হলেই সমস্যা অনেক কমে যাবে।
তারা আরও বলেন, শুধু ডেমরায় প্রতিটি বাসের জন্য প্রতিদিন স্থানীয় নেতৃবৃন্দদের ১৪০ টাকা চাদা দিতে হয়। এভাবে মিরপুর, মোহাম্মদপর, আব্দুল্লাহপুরসহ শেষ গন্তব্যে নেতাদের টাকা দিতে হচ্ছে প্রতিদিন। তার ওপর পার্কিং খরচ, গাড়ি মেইনটেইন খরচ ও পুলিশের টাকাসহ সব খরচ আসে গাড়ি চলার ওপর। তাছাড়া অনেক চালকই এখন নেশাগ্রস্থ থাকে বলে তারা সড়কে বেপরোয়াপনা করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডেমরা-যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা-রামপুরা সড়কের ৭৫ ভাগ চালকই নেশাগ্রস্ত। চালক সঙ্কটের কারণে অনেক সময় মালিক বাধ্য হয়ে মাদকাসক্ত চালকের হাতে গাড়ি তুলে দেন। পরিবহন শ্রমিকদের বক্তব্যম, দৈনিক অন্তত ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয় চালক ও তার সহকারীদের। ক্লান্তি দূর করতে তারা নেশা করেন। আর নেশার ঘোরেই দুর্ঘটনা ঘটে।
ইদানিং পর পর কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ডেমরা-রামপুরা সড়কে। দেখা গেছে, গত ২৩ মে সন্ধ্যায় বনশ্রীর আল রাজি হাসপাতালের সামনে কাভার্ডভ্যানের চাপায় মেহেদী হাসান (২৬) নামে ঢাকা কলেজের এক ছাত্র নিহত হয়েছেন। তিনি ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। গত ৮ মে মো. হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া (৩৮) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। গত ৫ এপ্রিল বাস চাপায় ইবনে তাহছিম ইরাম (১৮) নামে স্থানীয় এক কলেজ ছাত্রের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে। এ সময় তার মাথার একপাশ থেতলে গিয়ে মগজ বেরিয়ে যায় এ মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটেছে শুধুমাত্র দুই বাসের পাল্লা দেওয়ার ঘটনা কেন্দ্র করে। গত ১৩ জানুয়ারী ডেমরার আমুলিয়া মডেল টাউন সংলগ্ন ডেমরা-আমুলিয়া সড়কে বাসের ধাক্কায় পেয়ারী বেগম (৫৫) নামে এক ভিক্ষুক বৃদ্ধার ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে।
ডেমরা-রামপুরা সড়কে চলাচলকারী বাস যাত্রী বশির উদ্দিন, মো. লিটন, মিজানুর রহমানসহ একাধিক যাত্রীরা যুগান্তরকে বলেন, এ সড়কে ট্রাফিক পুলিশের অভিযান থাকলেও চালক-হেলপাররা মারত্মক বেপরোয়া। তাদের আচরনে মনে হয় সড়কে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনা, বরং এগুলো পরিকল্পিত হত্যাকা-। আর নৈরাজ্যকর পরিবেশে আমারা যাতায়াত করতেও যেন বাধ্য। এদিকে প্রতিটি বাসের ব্যবসা মূলত চালকরাই নিয়ন্ত্রণ করছে। কারণ দৈনিক চুক্তিভিত্তিক ইজারায় প্রতিটি মালিক তার বাসটি চালকের হাতে তুলে দেন। তাই চালকরা যাত্রী ধরার জন্য বাসে বাসে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এ পরিস্থিতিতে বাস চালাতে গিয়ে কোন দুর্ঘটনা দেখার সময় নেই চালকদের। তাদের প্রতিবাদ করলেও মারামারির সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে রামপুরা ট্রাফিক জোনের টিআই বিপ্লব ভৌমিক যুগান্তরকে বলেন, মাদকাসক্ত চালকদের অবশ্যই কাউন্সিলিং করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বাস মালিক ও সাধারণ মানুষ সকলের সমন্বয়ে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। আর বাসের চালকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দরকার কারণ তাদের সচেতনতার মাত্রা খুবই কম। সর্বক্ষণ তাদের মানসিক চাপের মধ্যে থাকতে হয়। চালকদের মূল লক্ষ্য থাকে দ্রুত বাস চালিয়ে টাকা রোজগার, তাই সড়কে তারা রুক্ষ ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তবে ট্রাফিক বিভাগের এসবের কোন ছাড় নেই। অনিয়মের জন্য প্রতিদিন মামলা, রেকারিং ও ডাম্পিং চলছেই যা অব্যাহত থাকবে।