শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৫, ০৪:০২ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের খবর :
একসময় তার তেমন কিছুই ছিল না। সংসার চালাতে অন্যের বাসায় কাজ করা ছাড়াও রাস্তার মাটি কাটতেন। কিন্তু মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে এখন তিনি শত কোটি টাকা, বহুতল অনেক বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমির মালিক।
আলাদিনের চেরাগ পেয়ে লাইফ স্টাইল বদলে গেছে কৃষক লীগ নেতা নজরুল ইসলাম বিশ্বাসের। অনেকে তাকে দুলাল বিশ্বাস নামেও চিনে থাকে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
নজরুল ইসলাম বিশ্বাস ওরফে দুলাল বিশ্বাসের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার আবাইপুর ইউনিয়নের পাঁচপাখিয়া গ্রামে। তিনি এখন বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি। এই নজরুল বর্তমানে ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অল্প দিনে টাকার কুমির বনে যাওয়া এই নজরুলের এখন আটটি প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে বিশ্বাস ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন, বিবিএল এলিভেটর লিমিটেড, বিশ্বাস সিকিউরিটিস অ্যান্ড লজিস্টিকস লিমিটেড, নাফ ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বিশ্বাস ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ফ্রেন্ডস কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, ফাইন ফুডস লিমিটেড ও পার্বণ রেস্টুরেন্ট।
তার গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে গেছে, নজরুল একসময় অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। পরবর্তী সময়ে তিনি নব্বইয়ের দশকে তৎকালীন বিডিআরে সৈনিক পদে যোগদান করেন। এরপর কিছু দিন যেতেই শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তার চাকরি চলে যায়। সেই সময় তিনি জীবিকার তাগিতে ঢাকায় চলে আসেন। এরপরই মুগদায় এক রড-সিমেন্টের দোকানে কাজ নেন। সেই দোকানির মেয়ের প্রতি তার নজর পড়ে। দোকানির মেয়ের জামাই থাকতেন জাপানে। বিবাহিত এ নারীর সঙ্গে শুরু হয় তার প্রেমের সম্পর্ক। এরপর বিয়ে করেন এই নারীকে। এরপর শুরু হয় তার ওপরে ওঠার পালা। রাতারাতি তিনি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান। দ্রুেত বড়লোক হওয়ার জন্য বিভিন্ন দুষ্টচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
এলাকাবাসী জানান, নজরুলের একসময় কিছুই ছিল না। কিন্তু এখন তার গ্রামের শৈলকুপার পাঁচপাখিয়ায় প্রায় ৫০ বিঘা জমির ওপরে সুবিশাল বাড়ি। বাড়ি বললেও ঠিক হবে না, রাজপ্রসাদ। চারপাশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রাজপ্রসাদসম বাড়ির ছাদে তৈরি করেছেন হ্যালিপ্যাড ও সুইমিংপুলসহ কারুকার্যখচিত পুরো বাড়ি। যা না দেখলে অবিশ্বাস্য।
শৈলকুপার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা নায়েব আলী জোয়ার্দার বলেন, দুলাল বিশ্বাসের আগে থাকার জায়গাও ছিল না। আর এখন গাড়ি-বাড়ির অভাব নেই।
আরও জানা গেছে, মূলত তার প্রতারণা ব্যবসা শুরু হয় বিশ্বাস বিল্ডার্স লিমিডেট নামের একটি প্রতিষ্ঠান খোলার মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন জনের নামে থাকা জমি দখল করতে এক অভিনব কৌশল বের করেন। অন্যের জমিতে ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট দেবেন শর্তে অনেককে রাজিও করান। কিন্তু ভবন নির্মাণের পরই অধিকাংশ জমি তিনি তার কব্জায় নিয়ে নেন। এমন একটি ঘটনা ঘটেছে নিউমার্কেট এলাকায়। ওই এলাকায় গেলেই নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্স নামে একটি ২২ তলাবিশিষ্ট একটি উঁচু ভবন সবার নজর কাড়বে। কিন্তু ভবনটি দাঁড়িয়ে থাকা জমির প্রকৃত মালিক হলেন ই¯্রাফিল হোসেন নামের এক ব্যক্তি। যার সঙ্গে প্রতারণা করে জমিটি জোর করে নিয়েছেন নজরুল।
ভুক্তভোগী ই¯্রাফিল হোসেন জানান, ২০০৫ সালের দিকে নজরুল তার জমির সামনে একটি ভাঙাচোরা গাড়ি নিয়ে আসেন। এ সময় তিনি তাকে লোভ দেখান তার লোভে পড়ে ওই ব্যক্তির ভাইবোনসহ ৭৪ জন শরিক সম্মতি দেন। এরপর কাজ শুরু হয়। নির্মাণ কাজও শেষ হয়। কিন্তু কাজ শেষে তাকেসহ সবাইকে নামমাত্র ভাগ দিয়ে পুরোটাই দখল করেন নজরুল ইসলাম বিশ্বাস। এর প্রতিবাদ করলেও ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে উল্টো মামলা দিয়ে নাজেহাল করেছেন নজরুল। শুধু তাই নয়, মাঝে মাঝে তাকে যুবলীগের নেতা স¤্রাটকে দিয়েও হুমকি দিতেন। ২২ তলার এ ভবনের ওপরের ১৭টি তলায় আবাসিক ফ্ল্যাট রয়েছে ২৬৭টি। আর নিচের তলাগুলোতে দোকানঘর রয়েছে প্রায় ৭০০। আমাদের জমিতে ভবন নির্মাণের চুক্তি করা থেকেই শুরু হয় তার প্রতারণা।
স্থানীয়রা যা জানান
শৈলকুপা আসনের সংসদ সদস্য ও ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই বলেন, দুলাল বিশ্বাসের বাবা আব্দুর রশিদ বিশ্বাস মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর পথভ্রষ্ট হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই বছর পর একটি ডাকাতির ঘটনায় তিনি জেলও খাটেন। কিন্তু তার ছেলের হাতে আজ আলাদিনের চেরাগ। মাত্র কয়েক বছরে কেমন কেমন করে অসংখ্য ফ্ল্যাট, বাড়ি ও হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এখন তিনি টাকার জোরে কৃষক লীগের সহ-সভাপতি। দলটির সহ-সভাপতি হওয়ার পর একাধিকবার হেলিকপ্টারে করে গ্রামে গেছেন। কিন্তু কৃষক লীগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষক লীগে দুলাল নামে ওই পদে কোনো ব্যক্তির নাম নেই।
মুক্তিযোদ্ধার নামে মামলা
স্থানীয়রা জানান, একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নজরুল। তার দাপটে এলাকায় আওয়ামী লীগের কর্মীরা নানা হয়রানির শিকার হন। সেই সময়ে তিনি এক মুক্তিযোদ্ধার নামে ১৭টি মামলা করেন। এরপর আবারও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে মুক্তিযোদ্ধা ও তার ছেলে ও সমর্থকদের নামে ৯টি মামলা করেন।
নজরুলের এত সম্পদ
নজরুল ডেভেলপার কোম্পানির ব্যবসা খুলে অল্প দিনেই কোটিপতি বনে গেছেন। এখন তার অঢেল টাকা। শুধু টাকাই নয়, আছে কয়েক শতাধিক ফ্ল্যাট ও উঁচু ভবন। তার কোম্পানি বিশ্বাস বিল্ডার্সের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্যমতে, সম্পন্ন হওয়া বিশ্বাস বিল্ডার্সের প্রকল্পের মধ্যে নিউমার্কেটে ‘নিউ ার্কেট সিটি কমপ্লেক্স’, উত্তরায় ‘বিশ্বাস লেক টাচ’, মোহাম্মদপুরে ‘বিশ্বাস রাতুল’, কমলাপুরে ‘বিশ্বাস ভিলা’ ও ‘বিশ্বাস টাওয়ার’। ‘পূর্বাচল হিল সিটি’ ও ‘লেক সিটি’ নামে ল্যান্ড প্রজেক্টের নাম বলা আছে ওয়েবসাইটে। এ ছাড়াও বিশ্বাস বিল্ডার্সের চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে আছে খিলগাঁওয়ে ‘বিশ্বাস হাসনাহেনা’ ও ‘বিশ্বাস চলন্তিকা’, মোহাম্মদপুরে ‘বিশ্বাস নিহারিকা’ ও ‘কুঞ্জছায়া’, হবিগঞ্জে ‘সাইহাম ফিউচার কমপ্লেক্স’, ধানমন্ডিতে ‘জেকে টাওয়ার’, ‘ক্রেডেন্স’ ও ‘বিশ্বাস ’, গুলশানে ‘গ্রেস’, মিরপুরে ‘বিশ্বাস দিগন্ত’, মিরপুর-৬-এ ‘বিশ্বাস নীলাঞ্জনা’ ও মিরপুর-১০-এ ‘বিশ্বাস মাধবী’, উত্তরায় ‘বিশ্বাস বলাকা’, ‘বিশ্বাস ফাইয়াস’, ‘বিশ্বাস মারজান’ ও ‘বিশ্বাস প্রশান্তি’, পশ্চিম কাফরুলে ‘বিশ্বাস মঈন টাওয়ার’, মহাখালীতে ‘আরজত আলী কমপ্লেক্স’ ও ‘সুলতান প্লাজা’
এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সময়ের আলোকে বলেন, দুই আড়াই বছর ধরে কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছি। আর কেন্দ্রীয় পদে নাম নেই যা জেনেছেন তা সত্য নয়। নিউমার্কেট এলাকার ২২ তলা ভবন নিয়ে কথা শুরু করতেই তিনি বলতে শুরু করেন, এগুলো কি আপনার জানার মধ্যে পড়ে? কেন জানবেন আপনি বলুন। এই বলেই ফোনের লাইনটি কেটে দেন।