রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:২৮ অপরাহ্ন
হোসাইন আহমদ হেলাল | কালের খবর :
শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন হলেও মাদরাসা শিক্ষার মান বাড়েনি
আরবি ভাষার দক্ষতা নিয়ে বিজাতিরা শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে
মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার যথেষ্ঠ উন্নয়ন হয়েছে। যা আশা করা যায়নি, তার তুলনায় অনেক বেশী উন্নয়ন হয়েছে। কওমি মাদরাসায় সরকারীভাবে উন্নয়ন না হলেও পিছিয়ে নেই। কাওমি মাদরাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের সরকারী স্বীকৃতি দেশের বহুমুখী শিক্ষায় নতুন একটি ধারা সংযোগ হলো। তবে সঠিকভাবে শিক্ষার মান উন্নয়ন হয়নি। কওমি বা আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষার মান উন্নয়ন করা হলে এবং শিক্ষার্থীরা যদি আরবি ভাষায় সঠিক দক্ষতা অর্জন করতে পারে আরব বিশ্বের শ্রমবাজার বাংলাদেশের দখলে চলে আসবে। দেশে বৈদেশিক আয় বেড়ে যাবে অনেক গুণ। প্রবাসী শ্রমিকদের কম বেতনে চাকরি করতে হবে না। মাদরাসা শিক্ষার মান উন্নয়ন না হলে আরব বিশ্বের বিশাল শ্রমবাজার অন্যদেশের দখলেই থাকবে। বাংলাদেশে শ্রমিক কর্মচারীরা অল্প বেতন ভাতায় চাকরি করতে বাধ্য হবে। বৈদেশিক আয় থেকে দেশ বঞ্চিত হবে দেশ। এমনটি মনে করছেন শিক্ষাবিদ, আলেম সমাজ, ধর্মীয় নেতা, প্রবাসি চাকরিজীবীরা।
দেশের সাধারণ শিক্ষা ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী, এমন অভিযোগ অনেক দিনের, প্রাথমিক, ইবতেদায়ি থেকে স্নাতকোত্তর, সকল স্তরের শিক্ষার মান নিয়েই অভিজ্ঞজনদের অভিযোগ করতে শোনা যায়, নতুনভাবে যোগ হয়েছে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে খেয়াল খুশি মতো। গত প্রায় এক দশক যাবত দেশের প্রায় প্রতিটি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে দেখা গেছে। খেয়াল খুশি মতো ডিগ্রি প্রদান আর প্রশ্নপত্র ফাঁস কোনভাবে ঠেকানো যাচ্ছে না। বেসরকারী ক্যাডেট কলেজ, ক্যাডেট মাদরাসা, ক্যাডেট স্কুলের শেষ নেই। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত উন্নত শিক্ষার নামে শিক্ষা বাণিজ্য ও বন্ধ করা যাচ্ছে না, কোচিং প্রাইভেট বন্ধে আইন করেও থামানো যায়নি। এত এত অভিযোগের ভিড়ে সরকার দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন সংযোগ ঘটিয়েছে কওমি মাদরাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাসিদকে স্নাতকোত্তর স্বীকৃতি আইন পাস করে। এটি কওমি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশাল পাওয়া। সরকার সকল স্তরে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। সঠিক নজরদারির অভাবে, রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত শিক্ষাঙ্গনের কারণে শিক্ষার মান উন্নয়ন হচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞগণ দাবি করছেন। প্রতিষ্ঠান প্রধান, শিক্ষক এবং অভিভাকদের অবহেলা, অদক্ষতার কারণও মনে তাঁরা।
বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি, দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক আলহাজ এ এম এম বাহাউদ্দীন বলেছেন, বিশ্বে ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি আরবি ভাষার গুরুত্ব কম নয়। আরব বিশ্বে বিশাল শ্রমবাজার। বাংলাদেশের মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এ শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে আরবি ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে। এ ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি জেলায় একটি মাদরাসাকে আরবি ভাষার শিক্ষার জন্য নির্বাচন করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আরবি শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। এতে করে ব্যক্তির লাভ হবে, দেশেরও উন্নতি হবে।
শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মাহবুব মোহাম্মদ আলী ইনকিলাবকে বলেন, দেশের সকল স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো এবতেদায়ী মাদরাসাকে নজরদারিতে আনতে হবে। স্কুল, কলেজের মতো কওমি ও আলিয়া মাদরাসা গুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন। তবে সকল স্তরের প্রতিষ্ঠান স্ব-স্ব স্বকীয়তায় থেকে মান উন্নত করতে হবে। তিনি বলেন ইন্ডিয়ানরা আরবি কোর্স শিখে আরবদেশে চাকরি করছে। খুজ নিয়ে দেখবেন আরব কান্ট্রিগুলোর শ্রম বাজার তাদের দখলে রয়েছে। তাদের সরকার শ্রম বাজারকে গুরুত্ব দিয়ে দক্ষ জনবল তৈরী করে বিদেশ পাঠাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কওমি মাদরাসায় ইতিহাস, ভুগোল, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা চালু করা প্রয়োজন। এ বিষয়গুলো যুক্ত করার বিষয়ে নীতিনির্ধারক আলেমগণ ভাবতে পারেন। যাতে শিক্ষার্থীরা এসব বিষয়ে ব্যাসিক জ্ঞান ধারণা রাখতে পারে।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও লেখক মুজতবা আল-মামুন জানান, দেশের মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা এখন পিছিয়ে নেই। মাদরাসা শিক্ষকগণ এখন আর গরীব নেই। বেতন পাচ্ছে বেশি যথাসময়ে, ভাতা পাচ্ছে, সহকারী বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। মাদরাসা শিক্ষাকে এখন অবহেলার চোখে দেখার সুযোগ নেই। শিক্ষকরা আন্তরিক হলেই শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে। আলিয়া ও কওমি মাদরাসায় অনেক ছাত্রকে জানি যার শিক্ষা সিলেবাসের বাইরে আলাদা যোগ্যতা অর্জন করে বিভিন্ন জায়গায় ভালো-ভালো চাকরি করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্যতার সাথে পড়াশুনা করছে। ঢাকার সংবাদপত্রেও তাদের অনেকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে। দেশি সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, কওমি মাদরাসা বা আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষার মান যদি উন্নয়ন করে এবং শিক্ষার্থীরা যদি আরবি ভাষায় সত্যিকারার্থে দক্ষতা অর্জন করতে পারে, দেশের বৈদেশিক আয় বেড়ে যাবে বহুগুণ। আরব বিশ্বে শ্রমবাজার বাংলাদেশের দখলে চলে আসবে।
কওমি মাদরাসার প্রবীণ শিক্ষক মাওলানা মোঃ আবদুল হান্নান ইনকিলাবকে জানান, কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এখন থেকে দেশের বাইরে তাদের শিক্ষাযোগ্যতায় চাকরি পাবেন। তারা উপযুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে পারবে। যা এতদিন আটকে ছিলো শুধু সরকারি স্বীকৃতির অভাবে। তিনি বলেন, একটি দেশ বা জাতি শুধু শিক্ষিত শ্রমিক দিয়ে চলতে পারে না। সঠিক পথে থাকার জন্য জাগতিকতার বাইরে নৈতিক জ্ঞান বুদ্ধিওয়ালা মানুষ দরকার হয়। আধ্যাত্মিক এবং ধর্ম, দর্শন দরকার হয়। শিক্ষিত শ্রমিকের বিপরীতে শিক্ষিত মানুষ দরকার হয়। যে ঘাটতি আমাদের সাধারণ শিক্ষায় পূরণ হবেই না। তিনি বলেন, নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের অভাবে পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের সমাজ, সংসার, সংস্কৃতি ভেঙ্গে পড়েছে। তারাও এখন তাদের ঘাটতি পূরণের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে নজর দিয়েছে। দেশের মাদরাসাগুলোকে যদি সত্যিকারার্থে নৈতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাদের মাধ্যমে যদি দেশের নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং ধর্মীয় প্রয়োজন মেটানো যায় তবে সমস্যা কোথায়? কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করলে আরব বিশ্বে উন্নত লেখাপড়ার সুযোগ এবং ভালো চাকরি পাওয়া সহজ হবে।
কুয়েত প্রবাসী আবদুল বাতেন জানান, আরবি ভাষা সঠিকভাবে জানতে পারলে ভালো বেতনে চাকরি পেতাম। আরবিদের যেকোন বিষয়ে বুঝাতে পারলেই সহযোগিতা পাওয়া যায়। ইন্ডিয়ানরা আরবি শিখে অন্যজাতি হয়েও ভালো চাকরি পাচ্ছে। জীবনে ভুল করেছি মাদরাসায় লেখাপড়া না করে। আমি বাংলাদেশীদের বলবো আরবি ভাষা ভালোভাবে শিখে আসুন ভালো করতে পারবেন। না হয় অন্যের হাত ধরে চলতে হবে। অর্ধেক শ্রম চলে তার হাতে।