বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৬ অপরাহ্ন
বগুড়া প্রতিনিধি, কালের খবর :
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের শত শত একর জমি ও বিদেশি অনুদানের কোটি টাকা খরচে ঘাপলার অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে বগুড়ায় কাজ করে যাওয়া ১২০ বছরের পুরনো চার্চেস অব গড মিশন।
কালের খবর’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির মাঠ পরিচালক হিসেবে উত্তম দেওয়ান যোগদান করার পর থেকে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিসহ বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। কর্মচারীরা এর প্রতিবাদ করলে চাকরিচ্যুতিসহ মানসিক নির্যাতন করা হয়।
জয়পুরহাটের খঞ্জনপুর মিশন চক্ষু ক্লিনিকের চিকিৎসক জন কস্তা ও হিসাবরক্ষক মি. বিমল পালের যোগসাজশে মিশনের বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। এর নেপথ্যে রয়েছেন উত্তম। এ কারণে এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত ৫০০ পরিবারসহ এ অঞ্চলের খ্রিস্টান পরিবারগুলোর টিকে থাকা এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
সম্প্রতি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটির আহ্বায়ক সুজিত টুডু জানান, মাঠ পরিচালক মিশন পরিচালনার জন্য তাঁর পরিবারের আটজন সদস্যকে নিয়োগ দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী ও ভাই। এটি মিশনের নীতিমালাবিরোধী।
আরো একটি অভিযোগ হলো, মিশনের কর্মীদের কোয়ার্টার, স্কুল ও গির্জা বছরের পর ধরে মেরামত না করা। এসব প্রতিষ্ঠানের দরজা-জানালার অবস্থা বেহাল। দেওালের পলেস্তারা খুলে পড়েছে। বৃষ্টির সময় উপাসনালয় ও স্কুল ঘরের মধ্যে পানি পড়ে।
খঞ্জনপুর মিশন স্কুলের শিক্ষক লুনা চক্রবর্তী জানান, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চার বছরে বাজেটের ৩৬ কোটি টাকার সিংহভাগ এই মিশন পেয়েছে। উত্তম দেওয়ান এই টাকা উত্তোলন করেছেন, যা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে প্রমাণিত। ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুসারে সাবেক ব্যবস্থাপক বিরাজ বাড়ই মাঠ পরিচালকের তৈরি করা ভুয়া নিরীক্ষা প্রতিবেদনের নমুনা তাদের কাছে প্রকাশ করেন। সেখানে দেখা গেছে, দুই কোটি ২১ লাখ ৯০ হাজার ৩৮১ টাকার ভুয়া খরচ দেখানো হয়েছে। এদিক থেকে কাজে যোগদানের পর আজ পর্যন্ত নিরপেক্ষ নিরীক্ষা করলে তার নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রমাণিত হবে।
এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর অর্থপ্রাপ্তির ছাড়পত্রে দেখা গেছে, গত ২০১৩ সালে ৮৩ লাখ ৭০ হাজার, ২০১৪ সালে ৮৯ লাখ ৩২ হাজার, ২০১৫ সালে ৮৯ লাখ ৭৬ হাজার, ২০১৬ সালে ৭৮ লাখ ৪৬ হাজার ও ২০১৭ সালে এক কোটি ১৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা মিলেছে।
কালের খবর’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, চার্চেস অব গড মিশন বগুড়ায় ১৮৯৮ সালে কার্যক্রম শুরু করে। এটি ১৯০৫ সালে স্থাপন করে দেশের সবচেয়ে বড় খ্রিস্টীয় উপাসনালয়। ১৯০৮ সালে স্থাপন করা হয় বগুড়া মিশন প্রাথমিক বিদ্যালয়। এরপর ১৯৪১ সালে স্থাপন করা হয় খ্রিস্টান (মিশন) হাসপাতাল। প্রথম দিকে এসবের নিয়ন্ত্রণ ছিল মিশনারিদের হাতে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভায়ালো জি কোভার। পর্যায়ক্রমে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মিশনারিরা এটি পরিচালনা করতেন। সর্বশেষ দায়িত্বে ছিলেন মিশন হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডা. ইভা ফেডালিয়া গিলবার্ট।
১৯৭২ সালের আগ পর্যন্ত মিশন পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি ছিল না। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় ’৭২ পরবর্তী সময়ে, যখন মিশনের দায়িত্ব বিদেশিরা বাঙালিদের হাতে তুলে দেয়। শুরু থেকে পরিচালনার ক্ষেত্রে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের দেওয়ান গোষ্ঠী আধিপত্য বিস্তার করে। প্রথম মাঠ পরিচালক ছিলেন মনোজ দেওয়ান। তিনি টানা ৩০ বছর এই পদে ছিলেন। এরপর দায়িত্ব নেন তাঁর চাচাতো ভাই উত্তম দেওয়ান। তিনি টানা ১৪ বছর এই পদে রয়েছেন।
নিয়ম অনুসারে, চার্চেস অব গড মিশন পরিচালনার জন্য মাঠ পরিচালক গঠিত হবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর দুই প্রতিনিধি নিয়ে। ভোটের মাধ্যমে এই প্রতিনিধি নির্বাচন করা হবে। কিন্তু সেটি যথাযথভাবে করা হয়নি। আর এর পেছনে প্রধান কারণ হলো ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা।
খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকজন অভিযোগ করেন, প্রথম পরিচালক মনোজ দেওয়ান দায়িত্ব পালনকালে নব্বইয়ে দশকে খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রথম বিভাজন তৈরি করেন। মিশনারিদের তৈরি করা মূল উপাসনালয় (গির্জা) থাকা সত্ত্বেও ৫০০ গজ দূরে তৈরি করেন প্রার্থনা ঘর (চ্যাপেল)। নির্দেশ দেওয়া হয়, হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চ্যাপেলে প্রার্থনা করবে। ধর্মীয় বিশেষ আনুষ্ঠানিকতাগুলো চ্যাপেলে করা না গেলেও বগুড়া মিশন এটি মানে না। যা প্রায় ৩০ বছর ধরে চলছে।
খ্রিস্টানরা জানান, বাংলাদেশে এই মিশনের সদর দপ্তর হলো বগুড়ায়। এ ছাড়া জয়পুরহাট, ঘোড়াঘাট, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর, নওগাঁয় রয়েছে এর কার্যক্রম। ধর্ম ছাড়াও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করাই মিশনের লক্ষ্য। মিশনের বগুড়াসহ অন্যান্য স্থানের শতাধিক একর জমি ব্যবস্থাপনাতে রয়েছে নানা অনিয়ম। এসব জমির গাছ কাটা, ফসলের জন্য লিজ দেওয়া, বিক্রি করা সব কিছু করেন উত্তম। তিনি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ঢাকার মিরপুর ও সাভারে নিজ নাম ও বেনামে জমি-ফ্ল্যাট কিনেছেন।
অভিযুক্ত মাঠ পরিচালক উত্তম দেওয়ান বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো সঠিক না। কারণ, বিগত বাজেটে (পাঁচ বছর) এনজিও ব্যুরোর কাছে ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি চাহিদাপত্র দিয়েছি। সেখান থেকে অতি সামান্য টাকার বরাদ্দ মিলেছে। এসব টাকা তিন মাস মেয়াদে বছরব্যাপী ছাড় দেওয়া হয়। ’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মিশনের বিভিন্ন উেসর টাকা আত্মসাৎ করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, প্রতিবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন সরকারের এনজিও ব্যুরো ও দাতা সংস্থাকে দাখিল করতে হয়। ’ সংস্কারকাজ নিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনীয় অর্থ প্রাপ্তি না থাকায় এগুলোর কাজ করা যায়নি। আমার বিরুদ্ধে যারা বলছে, তারা সবাই প্রতিহিংসার বশে পড়ে অভিযোগ করছে। ’
বগুড়া খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর সভাপতি রবার্ট রবিন মারান্ডি বলেন, ‘নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতেই কিছু লোক ইচ্ছা করে খ্রিস্টানদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে রেখেছে। যার কারণে ইচ্ছামতো মিশন চালাতে সুবিধা হচ্ছে তাদের। আমি এই বিভাজন দূর করতে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। ’