বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:০৫ পূর্বাহ্ন
কালের খবর ডেস্ক :
চাকরি জীবনে সবচেয়ে বেশি লাভজনক স্থানে দায়িত্ব পালন করেছেন আব্দুর রশিদ মিয়া। গোপালগঞ্জের লোকজনের সঙ্গে ছিলো তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতা আসলেই প্রথম চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এখানে যোগদান করে-ই আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কমিশন বাণিজ্য করে অল্প কয়েকদিনে হয়ে যান লাখপতি। এসব অভিযোগে তাকে বদলী করা হবে জেনে-ই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার মাধ্যমে তদ্বীর করে সিরাজগঞ্জ জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পদায়ন হন। ২০০৮ সাল থেকে টাকা ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে যান।
জানা গেছে, আব্দুর রশীদ মিয়া ২০১৯ সালে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পান। তিনি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশাসন)-এ দীর্ঘসময় দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে মানবসম্পদ, পরিবেশ ও জেন্ডার ইউনিটেও কর্মরত ছিলেন। এগুলো সবই অতিগুরুত্বপূর্ণ ও লোভনীয় স্থান। এসব পদে থেকেই তিনি প্রায় ৩শ’ কোটির সম্পদ গড়ে তুলেন। এখন তাকে অধিদপ্তরের অনেকেই কোটিপতি রশিদ নামে চিনেন। এই দুর্নীতি ও অনিয়মের টাকা দিয়ে আব্দুর রশীদ মিয়া ২০২৩ সালে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (মানবসম্পদ উন্নয়ন, মাননিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ ইউনিট) হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প (পিইডিপি-৪)-এর দায়িত্ব পালন করেন। সোনার কপাল নিয়ে চাকুরিতে এসেছেন রশিদ মিয়া। কেউ কেউ বলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে (এলজিইডি) আলাউদ্দিনের চেরাগ পেয়েছেন তিনি। সেই দুর্নীতিবাজ ও স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন আব্দুর রশিদ মিয়া এখন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)’র প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মো. আবদুর রশিদ এলজিইডিতে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঠিকাদারি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন এবং প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে বড় অংশ হাতিয়ে নেন। তিনি প্রকল্প পরিচালক, নির্বাহী প্রকৌশলী এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বদলি-বাণিজ্য ও নিয়োগ-বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যাপক বিতর্কিত হয়েছেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, তিনি ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন। ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত তিনি প্রায়ই শেখ সেলিম, শেখ হেলাল, লিটন চৌধুরী ও শাহজাহান খানের বাসায় মিটিং করেছেন। তিনি ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং আন্দোলনের শহীদদের কখনো স্বীকার করেন না। যার কারণে গণ অভ্যুত্থানের পর কোনো প্রোগ্রামে ও মিটিংয়ে বিষয়টি এড্রেস না করে সবসময় কথা বলেন। এ বিষয়টি নিয়ে এলজিইডিতে সবাই বিব্রত।
জানা যায়, তিনি অফিসে আওয়ামীপন্থি অফিসারদের নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরি করেছেন এবং আওয়ামীপন্থি অফিসারদের নিয়ে প্রায়ই গোপন মিটিং করেন। তিনি স্থানীয় সরকার বিভাগে কর্মরত আওয়ামীপন্থি অফিসারদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। এলজিইডি সংশ্লিষ্ট মহল জানান, তার নেতৃত্বে আওয়ামীপন্থি অফিসারগণ আরও সক্রিয় হয়েছে। এতে এলজিইডির কর্মকান্ডে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তার কর্মকাণ্ডে এলজিইডি একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এসব নিয়ে এলজিইডি’র কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি চলছে। এর আগে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুর রশিদ মিয়া অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। তখন তিনি এলজিইডিতে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে ছিলেন। সে সময় এই অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অনুসন্ধান পর্যায়ে অনেক অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলেও মো. আবদুর রশিদ মিয়া শুরু থেকেই চরম অসহযোগিতা করেছেন বলে দুদক থেকে জানানো হয়েছে। তদন্তকালীন সময়ে বেশ কিছু নথিপত্রসহ পরপর তিনবার তাকে তলবি নোটিশ দেওয়া হলেও কোনো সাড়া দেননি। তার কাছে চাওয়া নথিপত্র তখন সরবরাহ করেননি আব্দুর রশিদ মিয়া।
সর্বশেষ গত ২০২৩ সালের ১৫ মে শেরেবাংলা নগর থানার মাধ্যমে তলবি নোটিশ পাঠিয়েছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মানসী বিশ্বাস। ওই চিঠিতেও ফুটে উঠেছে দুদককে অসহযোগিতার চিত্র। শেরেবাংলা নগর থানা সূত্রে বিষয়টি জানা গেছে।
ওই তলবি নোটিশ মূলত স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের আগারগাঁও এলজিইডি ভবন বরাবর পাঠানো হয়েছে।
চতুর্থবার পাঠানো নোটিশে বলা হয়েছে, অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য গত ২০২৩ সালের ১০ এপ্রিল, ১৬ এপ্রিল ও ২ মে নোটিশ প্রেরণ করা হলেও চাহিদাকৃত কোনো রেকর্ডপত্র সরবরাহ করা হয়নি কিংবা উপস্থিত হয়ে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় তাকে ২০২৩ সালের ২৩ মে মাসে অনুসন্ধানের স্বার্থে নিজ, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের এনআইডি কার্ড, স্মার্ট কার্ড, পাসপোর্ট, জন্ম সনদের ফটোকপিসহ হাজির হয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। দুদক আইন ২০০৪ এর ১৯ (৩) ধারায় রেকর্ডপত্র সরবরাহ না করলে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই নোঠিশেও আব্দুর রশিদ মিয়া কোন সাড়া দেননি।
এ বিষয়ে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এলজিইডির আবদুর রশিদ মিয়াকে বারবার তলব করা হলেও তিনি হাজির হননি কিংবা চাহিদাকৃত নথিপত্র সরবরাহ করেননি। দুদকে আসা অভিযোগের বিষয়ে নিজস্ব গোয়েন্দা অনুসন্ধানে বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাকে ডাকা হয়েছিল সেসব তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাইয়ের জন্য। কিন্তু তিনি সচেতনভাবেই দুদকের তলবি নোটিশকে অবহেলা করেছেন। সর্বশেষ তাকে শেরেবাংলা নগর থানার মাধ্যমে তলবি নোটিশের চিঠি দেওয়া হয়।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, এলজিইডির তৎকালীন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুর রশিদ মিয়া দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞাত আয় বর্হিভূত বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা অর্জন করেছেন। তার বিরুদ্ধে এলজিইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রশাসন ও ট্রেনিং বিভাগে দায়িত্ব পালনকালে অভিযোগ উঠেছে। এর আগে তিনি প্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রায় ৩০০শ কোটি টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এসব সম্পদের অধিকাংশই স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও তার নিকট বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের নামে গড়েছেন। অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযোগ তিনি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। যাদের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ করেছেন।
সেই অভিযোগে অঢেল সম্পদের বর্ণনায় বলা হয়েছে- বগুড়ার শেরপুর পৌরসভায় জমি, হিমছায়াপুরে বাগানবাড়ী, একই এলাকায় ১০ নম্বর শাহবন্দেগী ইউনিয়নে খন্দকার তলা মৌজায় ৫ একর জমি, বগুড়ার শেরপুর সেরময়া মৌজায় ১২ বিঘাজমি, রাজশাহীতে ৫ ও ৭ তলা দুটি বাড়ী, একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সিরাজগঞ্জে হাটিকুমডুল এলাকায় ২৫ শতাংশ জমির ওপর ফুডগার্ডেন, সিরাজগঞ্জ-বগুড়া মহাসড়কে আরও একটি ফুডগার্ডেন। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৭০ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংকে কোটি টাকার বেশি এফডিআর ও রাজধানীতে একাধিক বেনামি ফ্ল্যাট।
২০২৩ সালে যখন তিনি সংস্থাটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছিলেন তখন তার অনিয়ম-দুর্নীতি ও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়ে। অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রাথমিক তদন্তেই এর সত্যতা প্রকাশ পায়।
অভিযোগের বিষয়ে কয়েক দফায় তাকে তলব করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি। বরং,অভিযোগটি চাপা দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী থেকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদে পদোন্নতি নেন। এ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা হলেও, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ও তাকে কোনো ধরনের বাধার মুখে পড়তে হয়নি। বরং বিগত সরকারের সময় হয়রানির শিকার হওয়ার দাবিতে তিনি সংস্থার প্রধান প্রকৌশলীর পদ বাগিয়ে নেন।
অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান সরকারের একটি অদৃশ্য শক্তি বিপুল অর্থের বিনিময়ে তাকে এই পদে বসিয়েছে। যদিও পূর্ণাঙ্গভাবে তাকে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা চলছিল। গুলশান-উত্তরার একটি অফিসে এ বিষয়ে সমঝোতা হয় এবং ‘ব্যবসায়িক দেনা-পাওনার’ একটি স্ট্যাম্প দলিলও প্রস্তুত করা হয়, যেখানে একজন বিনিয়োগকারী যুক্ত ছিলেন। সেই স্ট্যাম্পে সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেন আব্দুর রশিদ মিয়া।
২০২৩ সালে শুরু হওয়া দুদকের ওই তদন্তও তিনি ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়েছেন বলে জানা গেছে। এতে সহায়তা করেছেন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার তার এক বেয়াই, যিনি একসময় দুদকের সাবেক এক প্রভাবশালী কমিশনারের স্টাফ অফিসার ছিলেন।
এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাকে অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব দেওয়ায় সংস্থার বঞ্চিত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করেন, এত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থার দায়িত্ব এমন বিতর্কিত কর্মকর্তার হাতে যাওয়ায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। তাই এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছে তারা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কেউ যদি পদোন্নতি পেয়ে প্রধান প্রকৌশলী হন, তবে সেটা দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করার শামিল হবে।”