শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৪৬ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
সিরাজগঞ্জে খিরা চাষে লাভবান কৃষক, খিরা যাচ্ছে সারাদেশে। কালের খবর তীব্র গরমে পথচারীদের সুপেয় পানি সরবরাহ করছে ফায়ার সার্ভিস। কালের খবর সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করে পশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে। কালের খবর সমাজে “শান্তি স্থাপন ও সহিংসতা নিরসনে — সাতক্ষীরায় তাপদাহে রিকশাচালকদের মাঝে পানি ও স্যালাইন বিতারণ। কালের খবর প্রচণ্ড তাপদাহে পুড়ছে বাগান, ঝরছে আম, শঙ্কায় চাষীরা। কালের খবর ট্রাফিক-ওয়ারী বিভাগ যানচলাচল স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছে। কালের খবর মারামারি দিয়ে শুরু হলো ‘খলনায়ক’দের কমিটির যাত্রা। কালের খবর কুতুবদিয়ার সাবেক ফ্রীডম পার্টির নেতা আওরঙ্গজেবকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের দাবিতে মানববন্ধন। কালের খবর সাতক্ষীরায় লোনা পানিতে ‘সোনা’ নষ্ট হচ্ছে মাটির ভৌত গঠন। কালের খবর
বাহারের নিয়ন্ত্রণে কুমিল্লার রাজনীতি। কালের খবর

বাহারের নিয়ন্ত্রণে কুমিল্লার রাজনীতি। কালের খবর

 

কুমিল্লা প্রতিনিধি, কালের খবর :

দৃশ্যটা আর পাঁচ-দশটা জেলা শহরের মতোই। রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপট। হাল্কা-মাঝারি যানজট। হাসপাতালের আধিক্য। কিছু দূর এগোলেই ঘ্রাণ পাওয়া যায় ইতিহাসের। নজরুল-শচীন দেব বর্মণ-ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিবিজড়িত শহর কুমিল্লা। শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতি। গৌরবোজ্জ্বল সোনালী অতীত। আর বর্তমান?

জাঙ্গালিয়া থেকে কান্দিরপাড়। শহরের প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছাতেই স্পষ্ট সবকিছু।

দুটি ভবন, মার্কেট যেন প্রতীকী। শহরের সর্বত্র আওয়াজ একটাই, বাহার ভাই, বাহার ভাই। স্থানীয় এমপি, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। ৬৯ বছর বয়সেও একাই কুমিল্লা সামলাচ্ছেন। গেল ১৫ বছর কুমিল্লার রাজনীতিতে তিনিই প্রথম ও শেষ কথা। সর্বত্র তার একক নিয়ন্ত্রণ। সরকারি স্থাপনা থেকে পার্টি অফিস। কোথায় নেই তিনি। অভিযোগেরও শেষ নেই তার বিরুদ্ধে। যদিও এলাকায় উন্নয়নের কৃতিত্বও তার। ‘কুমিল্লা’ নামে বিভাগের পক্ষে তার অনড় অবস্থানও প্রশংসা পায় দলমত নির্বিশেষে। ক’দিন পরই কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন। সেখানেও আছেন আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। লড়ছেন তার কন্যা তাহসিন বাহার সূচনা। কে না জানে লড়াইটা মূলত বাহারেরই।
ডামি প্রার্থী কথাটা জাতীয় রাজনীতিতে প্রচলিত হলো এই সেদিন। শব্দটা হয়তো শোনা যায়নি। কিন্তু কুমিল্লায় ভোটের রাজনীতিতে এ ধরনের দৃশ্যপট পুরনো। দুই মেয়াদে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন ‘বিএনপি নেতা’ মনিরুল হক সাক্কু। দুটি নির্বাচনেই সাক্কুর পক্ষে বাহারের সমর্থন ছিল- এটা কুমিল্লায় একেবারেই ওপেন সিক্রেট। তবে গত নির্বাচনে পাশার দান উল্টে যায়। এতে বাহারের প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আরফানুল হক রিফাত। তবে এ নির্বাচনে সাক্কুর স্বল্প ব্যবধানে হারের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল নিজাম উদ্দিন কায়সারের। ২৯ হাজার ভোট পাওয়া কায়সারের সঙ্গে পর্দার আড়ালে রিফাতের যোগাযোগ ছিল এমন আলোচনা রয়েছে। এবারো প্রার্থী হয়েছেন কায়সার। বাহার কন্যা ছাড়াও মাঠে রয়েছেন মনিরুল হক সাক্কু, আওয়ামী লীগ নেতা নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম। ক’দিন পরেই ভোট। তবে ভোটের তেমন কোনো আমেজ নেই। চারদিকে নীরবতা। কথা বলতে চান না লোকজন। কি যেন অজানা ভয় তাদের মনে। কথা বলার পরিণতি কী হয় তা নিয়ে শঙ্কা। আবার এমনটাও তারা ভাবতে পারেন, বলে কী হবে সবই তো একজনের ইচ্ছাতেই হবে।

এমনিতে কুমিল্লার রাজনীতিতে ঘরের ভেতর ঘর। বিএনপি মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে হাজী আমিনুর রশীদ ইয়াছিন। অন্যদিকে, মনিরুল হক সাক্কু। যদিও সাক্কু এখন বহিষ্কৃত বিএনপি থেকে। তবে প্রয়াত মন্ত্রী আকবর হোসেনের নিকটাত্মীয় হিসেবে কুমিল্লার রাজনীতিতে তার প্রভাব দীর্ঘ। একসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছিল মোটা দাগে দুই ভাগে। আফজল খান বনাম বাহার। দশকের পর দশক চলেছে এ লড়াই। কখনো ঝরেছে রক্ত। কুমিল্লার রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় ধরে প্রভাব ধরে রেখেছিল আফজল খানের পরিবার। ১৯৮৪ সালে বাহার কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান হলেও রাজনীতিতে তার চলার পথ ছিল উত্থান-পতনে ভরা। দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন, আবার ফিরেও এসেছেন। তবে ২০০৮ সালে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর বদলে যায় পুরো দৃশ্যপট। আকবর হোসেনের মৃত্যুতে দুর্বল হয় বিএনপি’র রাজনীতি।

অন্যদিকে, আফজল খান আওয়ামী লীগে প্রভাব হারাতে থাকেন। ধীরে ধীরে পুরো কুমিল্লার রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন বাহার। জেলায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা কিংবা মন্ত্রী থাকলেও শহরে তাদের কোনো প্রভাব বিস্তার করতে দেননি বাহার। ধীরে ধীরে মহানগর আওয়ামী লীগের ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এ ছাড়া স্থানীয় যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ একক নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন এমপি বাহার। তার বিরোধীরা হয় পদ পায়নি, না হয় গুরুত্বহীন পদ পেয়েছেন। প্রয়াত মেয়র, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত ছিলেন বাহারের ঘনিষ্ঠ। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোতে তার মেয়ে তাহসিন বাহার সূচনা, আত্মীয় আব্দুল আজিজ সিহানুক, নুসরাত জাহান শাকিরা, হাবিবুর আলামিন সাদি, আকাশ ওয়াহিদ, সায়ের সায়েরিন, সাইফুল ইসলাম রনি, জুনায়েদ সিকদার অপুসহ অনেকেই রয়েছেন।

কুমিল্লায় মদ খেয়ে পূজামণ্ডপে আসলে পুলিশে দেয়া হবে বলে মন্তব্য করে দেশব্যাপী সমালোচিত হন এমপি বাহার। এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পাহাড় কাটা নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালককে ১৫ দিনের মধ্যে কুমিল্লা ছাড়ার নির্দেশ ও অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েও আলোচিত হন বাহার।

উন্নয়ন, প্ল্যান পাস নিয়ে নানা আলোচনা : কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের উপ- নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি একদিনে ১৭৬৫টি ভবন নির্মাণের প্ল্যান পাস করা হয়। এ নিয়ে শহরে নানা আলোচনা রয়েছে।

শহরের ১৬০টি ভবন নকশা না মেনে নির্মাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কুমিল্লা শহরে ছিনতাই, লুটপাট, স্কুল-কলেজ দখল, চাঁদাবাজি নিত্যদিনের ঘটনা। শহরে ৬টি কিশোর গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপের আবার উপ-গ্রুপ আছে। ঈগল গ্রুপ, রতন গ্রুপ, কুমিল্লার কিং গ্রুপ, ল ঠ্যালা গ্রুপ, সাইড ল গ্রুপ, আপার লোক গ্রুপ। গোমতী নদীর কমপক্ষে দেড়শ’ পয়েন্ট দিয়ে ড্রেজার লাগিয়ে দিনে-রাতে বালু ও মাটি উত্তোলন করে বিক্রি করছে প্রভাবশালীরা। বিক্রি হচ্ছে গোমতীর চর ও বাঁধ। প্রতি শতক ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা দরে এই জমি বিক্রি হয়। সাদা স্ট্যাম্পে লিখে দেয়া হচ্ছে এই জমি। সমপ্রতি কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার টিক্কারচর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কোথাও ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন হচ্ছে। কোথাও নদীর বাঁধের ভেতরের ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। আবার কোথাও নদীর বাঁধ ও সড়ক কেটে পাইপ দিয়ে বালু ফেলে জলাশয় ভরাট চলছে। শুধু টিক্কারচর ও বানাসুয়া পয়েন্ট থেকে কোটি কোটি ঘনফুট মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে।

নেতারা যা বলেন: কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি আঞ্জুম সুলতানা সীমা বলেন, কি বলবো, কোথা থেকে শুরু করবো আর কোথায় শেষ করবো। এমপি বাহার পুরো কুমিল্লাই দখল করে রেখেছে। কুমিল্লায় বাহারই শেষ কথা। কেউ কথা বলার সাহস পান না। সব সামাজিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, স্টেডিয়াম, ফুটপাথ, সরকারি অফিস, দলীয় পদ-পদবি, শিল্প-কারখানা সবকিছুই এমপি বাহার ও তার লোকজন ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন। শহরে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়।

কুমিল্লার সব টেন্ডারও বাহারের নিয়ন্ত্রণে। ডায়াবেটিক হাসপাতাল, অন্ধ কল্যাণ হাসপাতালও দখল হয়ে গেছে।

মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য নূর- উর রহমান মাহমুদ তানিম। বহু আগে বাহারের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি বলেন, এমপি বাহার প্রতিষ্ঠানগতভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন জোর করেই। কুমিল্লার আয়ের প্রধান সেক্টর হলো টেন্ডারবাজি। এটা পুরোটাই তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। উনার নলেজের বাইরে শহরে কোনো অনুষ্ঠান করতে দেয়া হয় না। আমাকে তার রাজনীতির জন্য নিরাপদ মনে করেন না। উনি হাইব্রিডদের দিয়ে কমিটি করেছেন। সমস্ত বিএনপি-জামায়াতের লোকজন কমিটিতে জায়গা পেয়েছে।

সাবেক সিটি মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বলেন, বাহার কিছুই কেয়ার করেন না। তিনি এমপি হয়েও মেয়ের প্রচারণা করছেন। কমিশনে অভিযোগ দিয়েও কাজ হয় না। তিনি কিছুই পাত্তা দেন না। তিনি কুমিল্লা শহরে এমন একটি ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন, যেখানে উনি যা করবেন সেটাই সঠিক। কেউ তার বিরুদ্ধে যেতে চান না। মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক এডভোকেট আনিসুর রহমান মিঠু বলেন, কুমিল্লায় কোনো মসজিদের ইমাম কে হবেন সেটাও যদি একজন এমপি ঠিক করে দেন, তাহলে বাকি বিষয়গুলো কী হতে পারে সেটা সহজেই আঁচ করা যায়। আসলে কমিল্লা শহরে বাহার সাহেবের কথার বাইরে কিছু হয় না। আমরা দলে কোণঠাসা। উপরের কেউ চায় একক নিয়ন্ত্রণ। তাই বাহার একক নিয়ন্ত্রণ করেন। কেউ না চাইলে তিনি এসব করতে পারতেন না।

কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিক সিকদার বলেন, সাধারণ মানুষের ভাষায় কুমিল্লায় একজন ব্যক্তির স্বৈরশাসন চলছে। নেতারা ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু সাধারণ মানুষ এখন তার দখলবাজি, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছে।

বক্তব্য চেয়ে বাহারকে ফোন করা হলে: অভিযোগের বিষয়ে এমপি বাহাউদ্দিন বাহারের বক্তব্য জানতে ফোন করা হলে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে ফোন রেখে দেন। তখন তিনি এ বিষয়ে পরে কথা বলবেন বলে আশ্বস্ত করলেও পরে একাধিকবার ফোন করেও তাকে আর পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা দিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি।

দৈনিক কালের খবর নিয়মিত পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিন..

কালের খবর মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com