রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:২০ অপরাহ্ন
কালের খবর প্রতিবেদন : জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত বিশুদ্ধ পানি। রাজধানীতে এই বিশুদ্ধ খাবার পানির প্রবল সংকটকে কাজে লাগিয়ে রমরমা ব্যবসা করে যাচ্ছে অনেক অসাধু ড্রিংকিং ওয়াটার কারখানা মালিক। জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে তোয়াক্কা না করে দূষিত খাবার পানি সরবরাহ করছে তারা। কারখানাগুলো বিশুদ্ধ পানির নাম করে ওয়াসার দূষিত ও জীবাণুযুক্ত পানি কম দামে কিনে জারে ভরছে। জারের গায়ে নকল স্টিকার লাগিয়ে চড়া দামে বিক্রি করছে নগরবাসীর কাছে। এসব পানি পান করে নগরবাসী পানিবাহিত নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। চরম হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা।
দূষিত পানির অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু শাস্তি ও জরিমানার পরও বন্ধ করা যাচ্ছে না ব্যবসা। নগরবাসীর জন্য বিশুদ্ধ পানি নিয়ন্ত্রণ ও বণ্টনে ড্রিংকিং কারখানাগুলোর দেখভাল করে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। সুপেয় পানি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের মান যাচাইয়ে শর্ত হিসেবে বিএসটিআই’র পক্ষ থেকে রয়েছে ৩০ ধরনের পরীক্ষা পদ্ধতি। এসব পদ্ধতি নিশ্চিত হওয়ার পর পানি বাজারজাতকরণের অনুমতি দেয় রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটি। এছাড়া বিশুদ্ধ পানি বাজারজাতকরণের অনুমোদনের পর কারখানায় রসায়নবিদ, কর্মীর সুস্বাস্থ্যের সনদ ও ল্যাব থাকার কথা।
এসব মান বজায় না রেখে অবৈধভাবে পানি উৎপাদনের দায়ে গতকাল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও সায়েদাবাদ এলাকায় ভেজালবিরোধী অভিযানে সেইফ ড্রিংকিং ওয়াটার ও আল হুমায়ুন ড্রিংকিং নামের কারখানাকে ১ লাখ করে মোট ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া আরো কয়েকটি কারখানার কয়েকজনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এমনকি খালি জারে পানি ভরার আগে জার জীবাণুমুক্ত করতে ওয়াশিং প্লান্ট না থাকার দরুন প্রায় ২ হাজার পানির জার ধ্বংস করা হয়। বিএসটিআই সূত্র জানায়, গত জানুয়ারি থেকে ২২শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর ৮টি এলাকায় মোট ৫টি ভেজালবিরোধী অভিযান চালায় বিএসটিআই। এসব কারখানা পল্টন, মতিঝিল, বাড্ডা, তেজগাঁও, গুলশান, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও ভাটারা এলাকায় অবস্থিত। এসব এলাকার কারখানাগুলোতে ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়ে প্রায় ২২ লাখ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও ১২টি কারখানা সিলগালাসহ প্রায় ৯ হাজার পানির জার ধ্বংস করা হয়।
বিএসটিআই সহকারী পরিচালক মো. রেজাউল হক বলেন, রাজধানীতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করে বিএসটিআই স্বীকৃতপ্রাপ্ত ড্রিংকিং কারখানাগুলো। এসব কারখানার আদলে অনেক ভেজাল কারখানায় বিশুদ্ধ পানির নামে দূষিত পানি বিক্রি করছে অসাধু কতিপয় ব্যবসায়ী। তাদের ধরতে আমরা দফায় দফায় ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। অভিযান শেষ হলেই আবার তারা ভিন্ন নামে নতুন কারখানা করে গোপনে ভেজাল পানি বিক্রি করছে। তাদের নির্মূলে বিএসটিআইর এমন অভিযান অব্যাহত রাখার কথা বলেন তিনি।
রাজধানীতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নামে-বেনামে, নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত সব মিলিয়ে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০টি খাওয়ার পানির কারখানা রয়েছে। এসব কারখানা থেকে জারের পানি নগরের বাসাবাড়ি, দোকান-হোটেল, সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালতে সরবরাহ করা হচ্ছে। নগরবাসী এসব পানি টাকা দিয়ে কিনে বিশুদ্ধ মনে করে কোনো ধরনের প্রশ্ন ছাড়াই পান করছে। তারা জানে না এসব পানি উৎপাদনে বিএসটিআই অর্পিত কোনো মান বজায় রাখা হচ্ছে কিনা। মোহাম্মদপুরের হোটেল মালিক সামাদ খান বলেন, জারের পানি টাকা দিয়ে কিনে খাই। তবে কোথাকার পানি কোথায় তৈরি হয় সে বিষয়ে তার জানার কোনো উপায় নেই বলে জানান এ হোটেল মালিক।
কারওয়ানবাজারের অন্তর ড্রিংকিং ওয়াটার, তেজগাঁও রেলগেট ওয়াটার কারখানা, মোহাম্মদপুরের সাগর ড্রিংকিং ওয়াটার, মোহাম্মদপুরের বুদ্ধিজীবী স্বচ্ছ ড্রিংকিং ওয়াটার ও মিরপুর-১০’র সেইফ ইন্টারন্যাশনাল ড্রিংকিং ওয়াটার কারখানায় সরজমিন গিয়ে জারের পানি উৎপাদনের মান যাচাই করে দেখার চেষ্টা করেন এ প্রতিবেদক। তাতে দেখা যায়, কারখানাগুলো থেকে হাজার হাজার পানির জার পৌঁছে যাচ্ছে নগরের বিভিন্ন বাসাবাড়ি, দোকানপাট ও অফিস-আদালতে। কাস্টমার পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য নিযুক্ত রয়েছে কারখানাগুলোর ডিলার। বিশুদ্ধ পানি কারখানা থেকে কাস্টমার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে কারখানা আর ডিলাররা বেছে নিচ্ছে অসাধু পথ। তোয়াক্কা করছে না আইনি কোনো নির্দেশনা।
কারখানাগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, মোহাম্মদপুরের বুদ্ধিজীবীর পার্শ্ববর্তী স্বচ্ছ ড্রিংকিং ওয়াটার কারখানাটি মানতে রাজি নয় বিএসটিআইর কোনো নির্দেশনা। কোনো ধরনের সাইনবোর্ড ছাড়াই কারখানাটি নোংরা পরিবেশে রিফাইন ছাড়াই জীবাণুযুক্ত পানি ভরে প্রতি জার ৫ টাকা দরে বিক্রি করছে। কারখানাটিতে শুধু ডিপ থেকে পানি তুলে কোনো প্রকার শোধন ছাড়াই জারে ভরে ডেলিভারি দিচ্ছে। বিষয়টি অস্বীকার করে কারখানাটির ম্যানেজার রুবেল বলেন, এখানে পানি বিশুদ্ধকরণের সব মান বজায় রাখা হচ্ছে। কারখানাটিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ- বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি।
এদিকে বিএসটিআইয়ের তথ্য অনুসারে, ২০ লিটারের একটি জারের পানি মোটামুটি মান বজায় রেখে রিফাইন করতে খরচ পড়ে ৪০ টাকা। অথচ মোহাম্মদপুরের স্বচ্ছ ড্রিংকিং ওয়াটার ও তেজগাঁও রেলগেটের বেনামে গড়ে ওঠা ড্রিংকিং ওয়াটার কারখানাগুলো ওয়াসার ডিরেক্ট লাইনের পানিভর্তি প্রতি জার বিক্রি করছে মাত্র ৫ টাকা। কথা হয় তেজগাঁওয়ের ওয়াটার কারখানার ডিলার সঞ্জীবের কর্মচারী রাসেলের সঙ্গে। রাসেল জানায়, এসব কারখানার কোনো লাইসেন্স নেই। যার যার মতো এখান থেকে ৫ টাকা দরে জার ভরে ৩০ টাকা থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি করেন আমাদের মহাজন।
একই ভাবে মোহাম্মদপুর ড্রিংকিং ওয়াটার কারখানা থেকে মহাজন সঞ্জীব প্রতিদিন পানি কিনে কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট ও মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রতিদিন হাজার হাজার খালি জার তেজগাঁওয়ের রেলগেটের কারখানায় ওয়াসার সাপ্লাইয়ের পানি ভরে বিশুদ্ধ পানির নামে বেশি দামে বিক্রি করছে ডিলার সঞ্জীব।
যোগাযোগ করলে সঞ্জীব বলেছে, ভালো মন্দ মিলিয়েই জারের পানি বিক্রি করি। তবে মন্দ মানের পানিও খেতে ভালো বলে জানায় সঞ্জীব। ওদিকে তেজগাঁও রেলগেটের ওয়াটার কারখানা থেকে রাসেলকে দিয়ে সাপ্লাই পানি ডেলিভারি করালেও অস্বীকার করে সঞ্জীব।
তেজগাঁও রেলগেট ওয়াটার কারখানায় দেখা যায়, সরাসরি সাপ্লাই লাইনের পানি বড় বড় ট্যাংকে ভরে জারে ভরা হচ্ছে। তাতে পানি বিশুদ্ধকরণ মেশিন বা তত্ত্বাবধানের কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। জীবাণুযুক্ত দূষিত পানি জারে ভরে কর্মচারীরা নিয়ে যাচ্ছে চা বিক্রেতাসহ নিম্নমানের হোটেলগুলোতে।
কর্মচারী ইমরান জানায়, এখানকার পানি ভালো কি মন্দ আমরা জানি না। মহাজনের কথামতো আমরা জার ভরে হোটেলে দিয়ে আসি।
কারওয়ানবাজারের অন্তর ড্রিংকিং ওয়াটার কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, পানি ডিপ থেকে তুলে মেশিনের মাধ্যমে রিফাইন করা হচ্ছে। তবে পুরাতন জার জীবাণুমুক্ত করতে ল্যাব কার্যক্রমসহ ওয়াশিং প্লান্টের কোনো ব্যবস্থা নেই। কথা হয় অন্তর ড্রিংকিং ওয়াটারের মহাজন নূর মোহাম্মদের সঙ্গে।
তিনি বলেন, আমরা কারখানা থেকে দু’ধরনের পানি উৎপাদন করে থাকি। এক ধরনের মোটামুটি ভালো পানি যা ২০ লিটারের প্রতি জার ১০ টাকায় বিক্রি করি। আরেক ধরনের ভালো মানের পানি যা প্রতি জার ৩০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। উভয় জারের পানি বিশুদ্ধ বলে দাবি করেন কারখানা মালিক।
অন্তর ড্রিংকিং ওয়াটারের কর্মকর্তা নুরুজ্জামান বলেন, প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ জার পানি বিক্রি করে থাকেন তারা। পানির বিশুদ্ধতার দাবি করলেও স্ট্রিকারে পানির মূল্য ও উৎপাদন, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ না থাকার বিষয়ে কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
এ কারখানার জার ডেলিভারি কর্মকর্তা আকবর আলী বলেন, অন্তরা ওয়াটার কারখানায় সব ধরনের পানি পাওয়া যায়। একদম নরমাল মানের জারের পানি চায়ের দোকানগুলোতে দেয়া হয়। আর একটু ভালো মানের পানির জার হোটেল ও অফিসগুলোতে সরবরাহ করা হয়।
কালের খবর /২২/২/১৮