রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:২৬ অপরাহ্ন
এম আই ফারুক | কালের খবর :
এম আই ফারুক : মাসুম পারভেজ রুবেল। মার্শাল আর্ট হিরো হিসেবে বাংলা চলচ্চিত্রে তার দুর্দান্ত আবির্ভাব। পর্দায় কুংফু-কারাতের নান্দনিক সব কৌশল দেখিয়ে বাংলা সিনেমায় এনেছিলেন নতুন জোয়ার। জুটি প্রথায় আবদ্ধ হননি। অভিনয়জীবনে ৫০ জন নায়িকার বিপরীতে নায়কের ভূমিকায় সুপারহিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন। অভিনয় করেছেন প্রায় আড়াইশ সিনেমায়। ফাইট ডিরেক্টর, প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবেও তিনি সমান সফল। ১৭টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন, যার সবগুলোই সুপারহিট। নায়ক রুবেলের মুখোমুখি হয়েছেন এম আই ফারুক।
এম আই ফারুক : ঈদ মোবারক। ঈদ কেমন কাটল?
রুবেল: ঈদ মোবারক। সকালে বৃষ্টি ছিল। তারপরও ঈদের নামাজ পরে উত্তরা ভাইয়ার (সোহেল রানা) বাসায় গিয়ে তাকে সালাম করে বাসায় ফিরেছি। ঈদের সারাদিন বাসায় ছিলাম। চলচ্চিত্রে যখন ব্যস্ত সময় পার করেছি তখনও ঈদের দিন সকালে আমি উত্তরা গিয়ে মা ও ভাইয়াকে সালাম করে তারপর বাসায় ফিরতাম। তখন অনেক পরিচালক ও সহশিল্পীরা বাসায় আসতেন, ফোন করতেন। পরদিন ঘুরতে বের হতাম।
এম আই ফারুক : আপনি চলচ্চিত্রে আগ্রহী হলেন কীভাবে?
রুবেল : চলচ্চিত্রে আগ্রহের বিষয়টা ছিলো একটু ভিন্ন। আমি কিন্তু সিনেমায় প্রথমে প্লেব্যাক করি। ‘জীবন নৌকা’ সিনেমায় ‘মেঘ যদি সরে যায় দেখতে চাঁদমুখ ভালো লাগে’ গানটি গেয়েছিলাম। পর্দায় এই গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন সোহেল রানা। এই সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছি। মাত্র ২২ বছর বয়সেই আমি পরপর দুইবার জাতীয় কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক পাই। এই বিষয়টি আমার অভিনয়জীবনে ভীষণ প্রভাব ফেলেছে। আমি ‘হিরণ পাশা’ নামে একটি সিনেমায় ফাইট ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছি।
একদিন ভাইয়া হঠাৎ আমাকে ডাকলেন। আমার গোল্ড মেডেলগুলো নিয়ে তার বাসায় যেতে বললেন। আমি গেলাম। বিভিন্নভাবে আমার অনেক ছবি তোলা হলো। প্রথমে কারণটা বুঝতে পারিনি। পরে জানলাম, আমি হিরো হতে যাচ্ছি। আমার ক্যামেরার সামনে আসার ইচ্ছা ছিলো না। আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন আলমাসুদ ভাই। তিনি আমাদের সিনেমার স্ক্রিপ্ট করতেন। ১৯৮৬ সালের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়ছি। তখন ভাইয়া ‘লড়াকু’ করার কথা ভাবছিলেন। তিনিই ডেকে বললেন, আমরা একটা সিনেমা করতে যাচ্ছি তুমি হিরো হবে। ওই সিনেমার মাধ্যমে নায়ক হিসেবে আমার চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয়ে গেলো। শুধু তাই নয়, সিনেমাটি সুপার ডুপার হিট হলো। যে কারণে পরের সিনেমাগুলোতে আমি কাজ করতে পেরেছি।
এম আই ফারুক : তখন সামাজিক ছবির জোয়ার। সিনেমায় মার্শাল আর্ট ব্যবহারের চিন্তা কীভাবে এলো?
রুবেল : বাংলা সিনেমায় এর আগে মার্শাল আর্ট ছিলো না এটা বললে অন্যায় হবে। ভাইয়া ‘শরীফ বদমাশ’ সিনেমায় প্রথম মার্শাল আর্ট দেখানোর চেষ্টা করেন। শুরুটা সেখান থেকেই হয়েছে। এর পরিপূর্ণরূপ দর্শক দেখেছে ‘লড়াকু’ সিনেমায়।
এম আই ফারুক : এই ভাবনাটা এলো কীভাবে?
রুবেল : মধুমিতা হলে ‘চাইনিজ বক্সার’ দেখেছিলাম। এই সিনেমাটি দেখার পর আমি খুব উৎসাহ পাই। আমি ভেবে দেখলাম, একজন মানুষের পক্ষে দুই-চার-দশজনের সঙ্গে মারামারি করা সম্ভব। আত্মরক্ষা করা সম্ভব। এরপরই আমি কারাতে শেখা শুরু করি। আমি চেয়েছি ফিল্মের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে কারাতে ছড়িয়ে দিতে। আত্মরক্ষার কৌশল ছড়িয়ে দিতে পারলে সমাজিক জীবনে অনেক সুফল মিলবে। তাছাড়া এটা শরীর চর্চারও অংশ। আমাদের তরুণদের অবশ্যই ফিটনেসের প্রয়োজন রয়েছে। সে কারণেই আমি আমার প্রত্যেকটা সিনেমায় পজেটিভ চরিত্রের পাশাপাশি কারাতে ব্যবহার করেছি। গ্রামগঞ্জে আমাকে এখনও দেখলে মানুষ হু হা করে ওঠে। ওদের ভিতরে সেই প্রভাবটা আমি ফেলতে পেরেছি। এখনও আমি কারাতে শেখাচ্ছি। আমার কারাতের স্কুল আছে। আমি সেখানে একশ ছাত্রছাত্রীকে শেখাচ্ছি। আমি এখনও চাই বাংলাদেশের প্রত্যেকটা স্কুল কলেজে কারাতে শেখানো হোক। এখন প্রত্যেকদিন পত্রিকা খুললেই দেখতে পাবেন ধর্ষণের খবর। শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। নারী আত্মরক্ষায় শিক্ষিত হলে তারা নিরাপদে নির্ভয়ে সমাজে চলতে পারবে। আমি মনে করি, সরকারীভাবে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ।
এম আই ফারুক : আশি-নব্বই দশকে ফোক সিনেমার জয়জয়কার। ঠিক সেই সময় অ্যাকশন সিনেমা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়নি?
রুবেল : সেই সময় ভাইয়া হয়তো বুঝে উঠতে পারেননি ‘লড়াকু’ এতোটা হিট হবে। যে কারণে সিনেমাটা সাদাকালো করা হয়েছিলো। ওই সিনেমাটাই আমার টার্নিং পয়েন্ট। এরপর ‘বীরপুরুষ’ করেছি। এটাও দর্শক খুব ভালোভাবে নিয়েছে। এরপর আমরা বুঝে গেলাম দর্শক এই ধরনের সিনেমা দেখতে চায়। তারা হয়তো তখন সিনেমায় নতুন কিছু চাইছিল। ফলে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, বাংলা সিনেমায় আমরা মার্শাল আর্টের ট্রেন্ড চালু করবো। দীর্ঘ বিশ বছর আমি সিনেমায় ছিলাম। কখনও আমার অবস্থান থেকে সরে আসিনি।
এম আই ফারুক : আপনার অভিনীত অধিকাংশ সিনেমা ব্যবসা সফল হয়েছে। তুলনামূলক বিচারে আপনি কখনো পুরস্কারের জন্য মনোনীত হননি। বা রাষ্ট্র আপনাকে …।
রুবেল : জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাদেরই জুরি বোর্ডের সদস্য হওয়া উচিৎ যারা সিনেমা সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন। আমি গান সম্পর্কে কিছু না জেনে গানের বিচারক হলে, অন্য কেউ পাশ থেকে বলে দেবে কাকে প্রথম বানাতে হবে। জুরি বোর্ডের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমি বলছি না- আমি ভালো অভিনয় করি। আমি ভালো অ্যাকশন করি এটা সত্য। কিন্তু আমি যেটা ফিল করি, পৃথিবীতে যেটা হয়, একটি চরিত্র যখন অভিনেতা ফুটিয়ে তুলতে পারেন তখন তাকে সেই চরিত্রের জন্য পুরস্কার দেয়া হয়। ‘ভন্ড’ সিনেমায় আমি কেন পুরস্কার পাইনি জানি না! ‘বিচ্ছু বাহিনী’, ‘বেয়াদব’, ‘যোদ্ধা’সহ আমার বেশ কিছু সিনেমা; আমি মনে করি পুরস্কার পাওয়ার মতো ছিল। কিন্তু কেন পুরস্কার পেলাম না আমি আজও জানি না।
এম আই ফারুক : অ্যাকশন হিরো হিসেবে আপনার অনুপ্রেরণা কে?
রুবেল : জ্যাকি চ্যান। তিনি কখনও স্টান্ট ব্যবহার করতেন না। আমি তাকে অনুসরণ করতাম। আমিও কখনও স্টান্ট ব্যবহার করিনি। শুটিং করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে অনেকবার ফিরে এসেছি। ‘বিপ্লব’ সিনেমায় আমি জ্যান্ত ইঁদুর কামড়ে ধরেছিলাম। এমন কাজ আজ পর্যন্ত কোনো নায়ক করেছে কি না আমার জানা নেই। ‘লড়াই’ সিনেমায় দুইশ ফুট উপর থেকে নামতে গিয়ে প্রায় ৭০ ফুট উপর থেকে পরে প্রায় মরেই গিয়েছিলাম। শুটিং ইউনিটের সবাই ধরেই নিয়েছিল আমি মারা গেছি। একটি সিনেমায় প্লেনের সঙ্গে দৌড়ানোর দৃশ্য ছিল। দৌড়াতে দৌড়াতে এমন একটা অবস্থা হয়েছিলো যে, আমি জোরে না দৌড়ালে পাখায় গলা কেটে যাওয়ার অবস্থা! এমন দৃশ্যেও আমি স্টান্ট ব্যবহার করিনি। ‘রুবেল আমার নাম’ সিনেমায় লাফ দিতে গিয়ে পা ভেঙে প্রায় পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলাম। ‘পলাতক আসামী’ সিনেমায় নয় ফিট উপর থেকে লাফিয়ে পড়ার দৃশ্য ছিল। লাফানোর সময় আমার মাথা নিচের দিকে পড়ে গিয়েছিলো। জ্ঞান ফিরে দেখি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। ‘শাহেনশাহ’ সিনেমায় আমি গেঞ্জি পরে সরাসরি কাচের ভেতর দিয়ে ভেঙে বেরিয়ে গেছি। শট শেষে দেখি সারা শরীর রক্তাক্ত। এরপর আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। এই ধরনের ঘটনা আমার একটা-দুটো নয়, অসংখ্য।
এম আই ফারুক : আপনার পরে কেন মার্শাল আর্ট অ্যাকশন হিরো তৈরি হলো না?
রুবেল : আমি অনেকটা চেষ্টা করেছিলাম। আলেকজান্ডার বোকে নিয়ে অগ্রসরও হয়েছিলাম। আমি মনে করি, আমার যে ধারাটা ছিলো, সেটা ও ধরে রাখতে পারতো। কিন্তু সেটা ও পারেনি। আলেকের মধ্যে সে সম্ভাবনা ছিলো। আজকে শাকিব সুপারস্টার। শাকিব কমপক্ষে ২৩টা সিনেমায় আলেকের সঙ্গে দ্বিতীয় হিরো হিসেবে কাজ করেছে। এখন আলেক কোথায় আর শাকিব কোথায়?
এম আই ফারুক : পর্দায় সহশিল্পী হিসেবে কোন নায়িকার সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন?
রুবেল : তিনজনের সঙ্গে কাজ করতে বেশি ভালো লাগত- পপি, মৌসুমী ও পূর্ণিমা। এর মধ্যে স্পেশাল পপি। তার আগে ছিলো কবিতা।
এম আই ফারুক : ফিল্ম পলিটিক্সে কখনও পড়েছেন?
রুবেল : ফিল্ম পলিটিক্স কি আমি কখনও জানতে চাইনি। তবে পলিটিক্স যে হয়েছে বুঝতে পেরেছি। আমি শ্রদ্ধেয় বড় ভাই সোহেল রানা এবং ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমের কারণে এতটুকু অর্জন করতে পেরেছি। এর সঙ্গে ছিল আমার কর্ম, শ্রম, মেধা। কখনও কোনো পরিচালক বা প্রযোজকের কাছে কাজ চাইনি। একটা সময় বড় বড় হিরোরা বড় বড় হিরোইনদের আমার সঙ্গে কাজ করতে দিত না। তাদের নাম বলতে চাচ্ছি না। তাতে আমারই লাভ হয়েছে। আমি অন্যদের নিয়ে কাজ করেছি। একটা সময় তো বাজারে চালু হয়ে গেল- রুবেলের সঙ্গে কোনো হিরোইন লাগে না!
এম আই ফারুক : চলচ্চিত্রের এখন খারাপ সময় যাচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী বলে মনে করেন?
রুবেল : চলচ্চিত্রকে সুন্দর করতে পারতো শাকিব। কোনো মানুষ যখন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যায় তখন আর চারপাশে খেয়াল করে না। শাকিব একটা সময় ছবি প্রতি ৩০ লাখ টাকা নিয়েছে। আমাদের সিনেমার মার্কেট কতটুকু সেটা আগে চিন্তা করতে হবে। শুধু নিজের চিন্তা করলেই হবে না। শাকিব যদি চাইতো ওর পক্ষে সিনেমার অনেক কিছু চেঞ্জ করা সম্ভব হতো। এখনও সময় আছে। সরকার যদি পৃষ্ঠপোষকতা করে তা হলে সিনেমা আবার ঘুরে দাঁড়াবে। দর্শক এখনও সিনেমা দেখতে চা্য়। তাদের ভালো সিনেমা দিতে হবে। আমি বলবো, এখন সিনেমা বানাতে ব্যর্থ হচ্ছেন পরিচালক। তারা নাটকটাকে একটু বড় করে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেয়। সিনেমার যারা অনেক ভালো নির্মাতা আছেন তাদের সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় সিনেমা নির্মাণ করা উচিৎ। আর তিনশ সিনেপ্লেক্স হলে সিনেমার অবস্থা আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
এম আই ফারুক : আশি-নব্বই দশকের শিল্পী ও নির্মাতা এবং এখনকার শিল্পী, নির্মাতাদের মধ্যে কোথায় পার্থক্য বলে মনে হয়?
রুবেল : এখনকার পরিচালকদের দৃষ্টিভঙ্গি বড় নয়। অনেক ছোট। তাদের অনেকেই ছোট পর্দা থেকে এসেছেন। শিল্পীদের অনেকেই আবার শুধু টাকার জন্য সিনেমায় কাজ করছেন। ফিল্মকে কিছু দেয়ার জন্য না। আমরা সিনেমাকে দেয়ার জন্য কাজ করতাম।