রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৪ পূর্বাহ্ন
কালের খবর ডেস্ক :
১৯৫০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান আমলে হঠাৎ জাল নোট বের হতে শুরু করলো বাজারে। পুরো প্রশাসন তটস্থ। কোনভাবেই সেই জালনোট উৎপাদন বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছেনা। তখন পুলিশের সহকারী পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত এক ভদ্রলোক।
জাল নোট বিষয়েরই বেশ কয়েকটি মামলার তদন্তভার এসে পড়লো তাঁর কাঁধে। সেই মামলার শেষমেশ সুরাহা হলো।
পুলিশের সেই ভদ্রলোক ছিলেন আদতে একজন কথাসাহিত্যিক। এরই মধ্যে লিখে ফেলেছেন তিনি ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ নামের একটি উপন্যাস ও। সেই উপন্যাস লেখা শেষ হয়েছিলো ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে। কিন্তু চার
বছরেও প্রকাশক না পাওয়ায় স্বভাবতই তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তাই ভাবলেন যদি গোয়েন্দা উপন্যাস লেখা হয় তবে হয়তো পাঠক জুটবে। সেই জালনোটের মামলা নিয়ে ১৯৫৪ সালে অবশেষে তিনি শেষ করলেন তাঁর সেই উপন্যাস। উপন্যাসের নাম ‘জাল’। তবে সেই উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিলো আরো ৩৪ বছর পরে।
লেখকের নাম আবু ইসহাক। কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক। কিন্তু তাঁর চেয়ে কম কি তিনি বাংলা ভাষার অভিধানবিদ ও? তাঁর লেখা ‘সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধানে’ কেবল ‘অন্ধকার’ শব্দটির প্রতিশব্দই আছে ১২৭টি!
বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের অন্যতম প্রবাদপুরুষ। গ্রাম্য বাংলার চরম বাস্তবতা ও কঠিন কোমল জীবনকে যে কতোটা নিপুণ ভাবে তুলে ধরা যায় তার প্রমাণ পাওয়া যায় আবু ইসহাকের লেখায়। সূর্য দীঘল বাড়ী চিরকাল বাংলা সাহিত্যে সর্বসেরা উপন্যাসগুলোর একটি হয়ে থাকবে এজন্যই। ভাবতে অবাক লাগে সূর্য দীঘল বাড়ীর মতো উপন্যাস তিনি লিখেছেন মাত্র ২১ বছর বয়সে!
সূর্য দীঘল বাড়ি উপন্যাসের পটভূমি নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তখন সিভিল সাপ্লাইয়ে কাজ করি, পোস্টিং নারায়ণগঞ্জ। তো মাঝে মাঝে ট্রেনে করে ঢাকায় আসার সময় দেখতাম ওরা ট্রেনের মেঝেতে বসে আছে। প্রত্যেকের হাতে থলি। কোথায় যাচ্ছে? যাচ্ছে ময়মনসিংহে, ওখান থেকে চাল কিনে নারায়নগঞ্জে কিছু বেশি দামে বিক্রি করে ওরা। এই ওদের পেশা। ওদের নাম যে জয়গুন বা এরকম কিছু তা হয়তো নয়…
কিন্তু এদের সঙ্গে সূর্য-দীঘল বাড়ির সম্পর্ক কী?
সেটা আবার আলাদা ব্যাপার। এদেরকে দেখে আমার মাথায় একটা গল্পের প্লট আসে। ভাবতে চেষ্টা করি, এরা কেন এত কষ্ট করে প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মসিংহ যাওয়া-আসা করে? তার মানে, নিশ্চয়ই গ্রামে কোনো উপায় খুঁজে পায়নি। ঘর ছেড়ে তাই পথে নেমেছে। ভিক্ষা করছে না, কাজই করছে, কিন্তু তাদের এই নিত্য যাতায়াত, তাও ট্রেনের মেঝেতে বসে, বিনা টিকেটে, টিকেট- চেকারের বকাঝকা শুনতে শুনতে, এসবই বলে দেয়, এরা স্বাভাবিক জীবন পায়নি, উপযুক্ত কাজও পায়নি, এমনকি হয়তো গ্রামে থাকতেও পারেনি। এরা কি তবে বাস্তুত্যাগি নাকি বাস্তুহারা? কেউ তো সহজে তার বাস্তুভিটা ত্যাগ করতে চায় না। তখনই আমার সূর্য-দীঘল বাড়ি নামটা মনে আসে।
সূর্য-দীঘল মানে সূর্যের দিকে লম্বালম্বি। অর্থাৎ গ্রামের যে বাড়িটি পুব-পশ্চিম লম্বালম্বি করে বানানো হয় তাকে সূর্য-দীঘল বাড়ি বলে। তো আমার নানার গ্রামে এ ধরনের একটা বাড়ি ছিল। গ্রামের বাড়িগুলো সাধারণত উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি হয়, কারণ মানুষের বিশ্বাস সূর্য-দীর্ঘল বাড়ির লোকজন উজাতে পারে না, মানে এগোতে পারে না, অর্থাৎ টিকতে পারে না এবং জীবনযুদ্ধে হেরে যায়। আমার মনে হলো, এই যে মেয়েগুলো ট্রেনে করে যাওয়া আসা করছে, তাদের ধরে নিয়ে আমার নানার গ্রামের ওই সূর্য-দীঘল বাড়িটিতে বসিয়ে দিলে কেমন হয়?’
আমাদের ছোটবেলাতে তাঁর গল্পের মধ্য দিয়ে ছোটগল্পের জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিলো। ‘মহাপতঙ্গ’ কিংবা ‘জোঁক’। কি দারুণ দুই ছোটগল্পের মাধ্যমে শৈশবেই রেখাপাত ঘটিয়েছিলেন তিনি।
সাহিত্য কিংবা কর্মজীবন দুই জায়গাতেই তিনি ছিলেন সফল। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার খুলনা বিভাগের প্রধান ছিলেন। কলকাতায় বাংলাদেশ দূতাবাসে ছিলেন ভাইস-কনসাল ও ফার্স্ট সেক্রেটারি। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন ভীষণ নিরহংকারী।
বাংলা কথাসাহিত্যের এই অবিস্মরণীয় স্রষ্টার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
ছবিতে আবু ইসহাক ও তাঁর স্ত্রী সালেহা ইসহাক।
সৌজন্যে – সপ্তসুর