দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ফলপ্রসূ শিক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা, এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উৎকণ্ঠিত হওয়ার যৌক্তিক কারণ তৈরি হয়েছে। এর সাথে জড়িত আছে সেশন জট, শিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য (লার্নিং আউটকাম), বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজ উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোভিড মহামারীর সময়ে পর্যায়ক্রমে পোশাক শিল্প, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, দোকানপাট, শপিংমল, মসজিদ, ও মন্দিরসহ সকল জনপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলেও, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। অথচ শিক্ষার ব্যাপারে আমরা সরকারের কাছে অধিকতর দায়িত্বশীলতা ও কর্মতৎপরতা আশা করেছিলাম।
দুই
মহামারীর ভয়াবহতা সত্ত্বেও, নানা দেশে তাদের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ও কোভিড পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক, ও শিক্ষা সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধাপে ধাপে চালু করা হয়েছে। যে সব দেশ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে, সেসকল দেশে মহামারীর ক্ষয়ক্ষতি তত কম হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, মহামারীর ভয়াবহতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজানো হবে, কিন্তু গত দুটি বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ কিছুটা বাড়ানো ও ১০ হাজার কোটি টাকা করে থোক বরাদ্দই কেবল দেওয়া হয়েছে। অথচ স্বাস্থ্যখাতের লাগামহীন দুর্নীতি দমন, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বরাদ্দ টাকার যথাযথ ব্যয়, বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সীমাহীন বাণিজ্য, এবং মাস্ক, স্যানিটাইজার ও ওষুধপত্রের অতিরিক্ত মূল্যের ব্যাপারে সরকারি সংস্থাগুলো কোন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এর সাথে ছিল এবং আছে টীকা নিয়ে নানা অনিয়ম, অস্বচ্ছতা ও বিভ্রান্তি।
কোভিড মহামারীর ভয়াবহতার প্রেক্ষিতে ২০২০ সালের মার্চ মাসে সাধারণ ছুটি ঘোষণা, ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্তটি যথার্থ ছিল। শিশু, কিশোর, ও তরুণ শিক্ষার্থীরাই সমাজ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নাগরিক; ফলে, তাদের ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতা প্রত্যাশিত ও কাম্য। মহামারী শুরুর প্রথম দিকের হতবিহ্বল ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা কাটিয়ে উঠে ৩/৪ মাসের মধ্যে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, অফিস-অদালত, দোকানপাট, গণপরিবহন, মসজিদ-মন্দির সবই খুলে দেওয়া হল। তখনও মনে হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের বেলায় আরও ভেবে-চিন্তে ও সতর্ককতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, এবং এব্যাপারে সরকারি কর্মতৎপরতাকে যৌক্তিক ও সন্তোষজনক মনে হয়েছে। কিন্তু ৮ থেকে ৯ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান হল না, তখন আমরা শঙ্কিত হতে শুরু করলাম। এর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে আগের পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ২০২০ সালের উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ‘অটো-পাস’ এর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, যা ছিল পুরো জাতির জন্য একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
গত এক দশক ধরে কোমলমতি শিশুদের শিক্ষা নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট, মানের চেয়ে সংখ্যার ওপর গুরুত্ব দেওয়া, পিইসি, জেএসসি, ও এসএসসিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা তহবিলের ঘাটতিসহ নানা কারণে শিক্ষাখাতে এক বিপর্যয় নেমে এসেছে। বর্তমানে অনলাইনে ক্লাশ চালু থাকলেও বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ডেটা দেওয়া হয়নি, যদিও এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী ও প্রযুক্তিমন্ত্রী কয়েকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
তিন
বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মনের ভেতরে গভীর হতাশা জমাট বেঁধেছে। কবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলবে, সে বিষয়ে নীতি নির্ধারকদের কোন ‘রা’ না দেখে, হতাশা যন্ত্রণাদায়ক উৎকণ্ঠায় পরিণত হয়েছে। ১৫ জুলাই শিক্ষামন্ত্রী এসএসসি, ও এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের যে রূপরেখা দিয়েছেন, তার সঙ্গে অটোপাসের কী পার্থক্য, আমি সেটি বুঝতে পারিনি। অনেকটা নিরূপায় হয়ে ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করতে শুরু করলাম যে, অন্যান্য দেশের সরকারগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে কী করেছে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম যে, ৪ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, ও শ্রীলংকা তাদের বিদ্যালয়, ও মহাবিদ্যালয়গুলো খুলে দিয়েছে।
গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে পর্যায়ক্রমে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানেও কয়েক হাজার স্কুল ও কলেজ খুলে দেওয়া হয় ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকা ৪ মাস পরেই অর্থাৎ জুন/জুলাই মাসে তাদের সব স্কুল খুলে দেয়। উল্লেখ্য যে, পরিস্থিতি খারাপ হলে এসব দেশ তাদের স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়েছে, আবার পরিস্থিতি ভালো হলে খুলে দিয়েছে। কিন্তু তারা এক নাগাড়ে ১৫ মাস ধরে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখেনি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত, পাকিস্তান, ও শ্রীলংকা ৪ থেকে ৬ মাসের মধ্যে স্কুল-কলেজ খুলে দিলেও, আমরা পারলাম না কেন? সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি বাংলাদেশের শিক্ষাকে ধ্বংস করে দেওয়ার ঠিকাদারি নিয়েছে? তাই যদি না হবে, তাহলে বিভিন্ন খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হলেও শিক্ষাখাতে প্রণোদনা নেই কেন?
চার
নানা উৎসের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, মোট শিক্ষার্থীর ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ হত-দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে, যাদের ইন্টারনেট ডেটা কিনে অনলাইনে ক্লাশ করার সামর্থ্য নেই। আবার শিক্ষার্থীদের একটি অংশ টিউশনি করে তাদের শিক্ষা খরচ মিটিয়ে পরিবারের জন্যও টাকা পাঠান। কিন্তু হলগুলো বন্ধ থাকায় এ ধরনের হাজার হাজার শিক্ষার্থী মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
মহামারী শুরু হওয়ার পরে ৬ মাসের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের ক্লাশ, পরীক্ষা, ফলাফল প্রকাশসহ একটি মহাপরিকল্পনা প্রস্তুত করা, যাতে শিক্ষাব্যবস্থার সকল কিছু সবিস্তারে বিবৃত হওয়া কাম্য ছিল। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত ছিল পর্যায়ক্রমে হলসমূহ খুলে পরিস্থিতির স্বাভাবিকতা অনুযায়ী সশরীরে পরীক্ষা ও ক্লাশসমূহ নেওয়ার ব্যবস্থা করা। পরিস্থিতি খারাপ হলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা এবং বিকল্প বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতেই ছিল এবং আছে।
পরিশেষে বলতে চাই, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য, সেশন জট, কার্যকর শিক্ষা (অনলাইনে কতটা ফলপ্রসূ শিক্ষা হচ্ছে, সেটি নিয়ে বিতর্ক আছে), শিক্ষার্থীদের পারষ্পরিক মিথস্ক্রিয়া, শিক্ষক-শিক্ষার্থী প্রত্যক্ষ যোগাযোগ, ভবিষ্যতের কর্মসংস্থান, শিক্ষা অতিরিক্ত কর্মকাণ্ড (এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস) ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজই নয়, ধাপে ধাপে সব উচ্চ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া হোক। সঙ্গে সঙ্গে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে ইন্টারনেট ডেটার সুবিধা দেওয়া, বিনা সুদে শিক্ষা ঋণ দেওয়া, এবং চরম দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সরাসরি অর্থসাহায্য দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।