শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৪৯ পূর্বাহ্ন
কালের খবর রিপোর্ট :
শূন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক দেলু
তার বাবা ছিলেন হকার। তারপর রেলের খালাসি হিসেবে চাকরি নেন। সে সুবাদে তার বেড়ে ওঠা কমলাপুর রেল কলোনিতে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু বাবার কিছু না থাকলেও ছেলে এখন মহারাজ। গুলিস্তানের তিনটি মার্কেট লিজ নিয়েই তিনি শত শত কোটি হাতিয়ে নিয়েছেন। শুধু কি তাই, ফুটপাথ দখল, চাঁদা আদায়, টেন্ডারবাজি, দখলবাজিতেও তার জুড়ি নেই। তাতেই বদলে গেছে তার ভাগ্য। এখন তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক। রাজধানীতে প্রথম ক্যাসিনো ব্যবসা তার হাত ধরেই চালু হয়। বলা হচ্ছিল, যুবলীগ নেতা সম্রাটের অন্যতম সহযোগী দেলোয়ার হোসেন দেলুর কথা।
দেলুর ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালে নগর প্লাজা, সিটি প্লাজা ও জাকের প্লাজা এই তিন মার্কেটের প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা দামে ১ লাখ ৩৬ হাজার বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ দেয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সম্পত্তি বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে হাত করে অবৈধভাবে এসব বরাদ্দ নেন দেলু। এই তিন মার্কেট বরাদ্দের নামে পুরোটাই দখল করেন দেলু। তার পছন্দসই লোকজন দিয়ে মার্কেট তিনটিতে সমিতিও করেন। তারাই এখন এগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন।
দেলু দক্ষিণ সিটির কাছ থেকে লিজ নিয়ে বরাদ্দকৃত দোকান ছাড়াও আরও দোকান নির্মাণ করেন। এসব মার্কেটে নকশার বাইরে গিয়ে অবৈধভাবে গড়ে তোলেন ১২শ’ দোকান। বাথরুম, বাথরুমের সামনের খোলা জায়গা, লিফটের জায়গা, ফ্লোর স্পেস, বারান্দা, বেজমেন্ট, ক্রেতাদের হাঁটাচলার জন্য রাখা খোলা জায়গা দখল করে এসব দোকান বানানো হয়েছে। তিনটি মার্কেটে ১২শ’ দোকান তৈরি করে প্রতিটি দোকান থেকে ৩০-৩৫ লাখ টাকা করে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন দেলু।
এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা দিদারুল আলম শাহবাগ থানায় একটি জিডিও করেন। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দেলুর গুলিস্তান এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য। তার কথায় সব হতো। এখনও তার লোকজন গুলিস্তানের বিভিন্ন ফুটপাথ থেকে চাঁদা তুলছে। এছাড়াও তিন মার্কেটে ভাড়া আদায় অব্যাহত আছে। যদিও দেলু এখন বিদেশে অবস্থান করছেন। দেলু পলাতক থাকলেও একই কায়দায় মার্কেট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে তার অনুসারীরা। তার রয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট। মার্কেটে কী হচ্ছে, কারা ঢুকছে সবকিছুই একটি দল নিয়ন্ত্রণ করে। জাকের প্লাজার কথিত সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ, সিটি প্লাজার সাধারণ সম্পাদক মাহবুব, নগর প্লাজার সাধারণ সম্পাদক মাসুদ, স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল ওরফে বড় দাড়িওয়ালা দিলু সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য। তাদের পক্ষে কালেক্টর হিসেবে কাজ করে মার্কেট সমিতির কেরানি মো. আবুল কাশেম।
সিটি কর্তৃপক্ষও যেন অসহায় : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দক্ষিণ সিটির কানুনগো মোহাম্মদ আলীর যোগসাজশে দেলোয়ার হোসেন দেলু এসব দোকান অবৈধভাবে গড়ে তোলেন। সে সময় এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরে দক্ষিণ সিটি প্রশাসক বরাদ্দের আদেশ বাতিল করেন। ওই চক্রটি আদেশের কপি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়। তখন আদালত উচ্ছেদ নোটিসে স্থিতিবস্থা দিয়ে দক্ষিণ সিটিকে মামলা নিষ্পত্তি করার আদেশ দেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাত্র ১৮৫টি দোকান বকেয়া ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করছে। বাকি দোকানের ভাড়া আদায় কেন সম্ভব হচ্ছে না? জানা গেছে, সম্পত্তি বিভাগ থেকে বরাদ্দপ্রাপ্তদের যে তালিকা রাজস্ব বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল সেই তালিকার দোকানদারদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে মার্কেটটির কয়েকজন দোকানি জানিয়েছেন, ২০১৬ সালে স্থানীয় তিন কাউন্সিলরের নেতৃত্বে মার্কেট তিনটি দখল নেওয়া হয়। এরপর সেখানে দোকানের কাগজ দেওয়ার নাম করে ৭০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায় ওই চক্র। এই চক্রের সঙ্গে দেলুও ছিল। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের বের করে দিয়ে অবৈধভাবে এসব দোকানদারকে বসান ওই তিন কাউন্সিলর। এরপর বংশাল থানায় এ সংক্রান্ত একটি মামলাও করা হয়।
দোকানিরা আরও জানান, দীর্ঘ ২২ বছর ধরে মার্কেটগুলো থেকে চাঁদাবাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ থেকে শুরু করে সবকিছু চলে দেলুর ইশারায়। ভুয়া কাগজ দিয়ে একই দোকান থেকে পাঁচ-ছয়বার টাকা উত্তোলন করেন। কেউ প্রতিবাদ করলে চাঁদার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যায়। জানা গেছে, ক্যাসিনো কাÐের ধরপাকড়ের শুরুতেই দেলু বিদেশ পাড়ি দেন। বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুরে রয়েছেন। সিঙ্গাপুরই দেলুর সেকেন্ড হোম বলে জানা গেছে।
দেলুর উত্থান হয় ওয়ার্ড কমিশনার সাহাবুদ্দিন হত্যার মধ্য দিয়ে। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার দখল ও চাঁদা বাণিজ্য। গড়ে তোলেন বিশাল ক্যাডার বাহিনী। দেলুর নারায়ণগঞ্জে পাঁচটি বহুতল ভবন, পল্টনে জামান প্রীতম টাওয়ার, সেগুনবাগিচায় ১৫টি ফ্ল্যাট, পল্টনের আজাদ প্রোডাক্টস বিল্ডিংয়ে নিজস্ব বাণিজ্যিক অফিস রয়েছে। তিন মার্কেটের মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কিন্তু তা হওয়া সত্তে¡ও সিটির কর্মচারীরা ভয়ে মার্কেটগুলোতে ঢুকতে চান না। যে কারণে হাজার হাজার ব্যবসায়ী দেলুর বাহিনীর কাছে জিম্মি। কেউ প্রতিবাদ করলে তার ওপর নেমে আসে নির্যাতন। এছাড়া প্রতিবাদকারীকে সামাজিকভাবেও হেনস্থা করা হয়। তিন মার্কেটের পানি, বিদ্যুৎ, টয়লেট সবই দেলুর লোকদের নিয়ন্ত্রণে।
দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তারা যা বলছেন : দক্ষিণ সিটির একজন রাজস্ব কর্মকর্তা জানান, দোকানদানরা অপপ্রচার করে অবৈধভাবে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। উচ্ছেদ, দোকানে তালা দেওয়া অথবা রাজস্ব আদায়ের জন্য গেলে অবৈধ দোকানদাররা বলে চাঁদা চাইতে আসছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। অথচ এসব মার্কেট দক্ষিণ সিটির মালিকাধীন। করপোরেশনের এখতিয়ার রয়েছে অবৈধ দোকানদারদের উচ্ছেদ করার। সিটির এক কর্মকর্তা জানান, অবৈধ দোকান দখলদারদের জায়গা ছেড়ে দিতে বললেও দোকানদাররা নানা ছলচাতুরী করে বলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাতে পারছি না। দক্ষিণ সিটির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সর্দার সময়ের আলোকে জানান, আমি অসুস্থ থাকায় এ বিষয়ে কথা বলতে পারছি না।