শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৭ পূর্বাহ্ন
কালের খবর ডেস্ক :
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় স্থাপিত একটি অটো ইটভাটার ধোঁয়ার সাথে নির্গত বিষাক্ত গ্যাসে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা। ভাটার ধোঁয়ার সাথে বের হওয়া বিষাক্ত গ্যাসে ঝসলে গেছে কৃষকের বোরো ধান।
মরে যাচ্ছে ভাটার চারপাশের গাছপালা। এ ছাড়া বিষাক্ত গ্যাসের কারণে ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন স্থানীয়রা। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের ক্ষতিপূরণের বদলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
২০১৮ সালে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের কামাতপাড়া এলাকায় এঅ্যান্ডএ অটো ব্রিকস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি অটো ইটভাটা স্থাপন করেন পঞ্চগড়ের এইচ এম জাহাঙ্গীর আলম রানা। এই ইটভাটাটি গত এক বছর ধরে ইট উৎপাদন করে আসলেও গত ১৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, জনবসতি ও ফসলি জমিতে ইটভাটা স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সব মহলকে ম্যানেজ করেই গড়ে তোলা হয় এই অটো ইটভাটা। জমি গ্রহণের সময় তারা স্থানীয়দের জানিয়েছিল যে পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু তারা করবেন না।
কিন্তু বর্তমানে এই অটো ইটভাটায় স্থানীয়রা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পরিবেশবান্ধব বলা হলেও গোপনে গাছপালা কেটে পোড়ানো হচ্ছে এই ভাটায়। প্রতিদিন ভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় সাথে বিষাক্ত গ্যাস চারপাশে পরিবেশসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করছে বলে জানান স্থানীয়রা। একরের পর একর বোরো ধান ঝসলে গেছে। বের হওয়া শীষ কালো হয়ে গেছে। সেচ দিয়ে কষ্ট করে বোরো ধান করে ভাটার ধোঁয়ায় চোখের সামনে তা নষ্ট হতে দেখে মাথায় হাত পড়েছে চাষিদের। এ পর্যন্ত ওই ভাটার চারপাশের প্রায় ১০ একর জমির বোরো ধানের শীষ বের হতে না হতেই তা নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন নতুন যেসব ক্ষেতে ধানের শীষ বের হচ্ছে সেসব ঝলসে কালো হয়ে যাচ্ছে। দিন দিন এই পরিমাণ আরো বাড়ছে। ভাটার চারপাশে গাছপালা এমনকি ঘাসও জ্বলে গেছে।
ভাটার বিষাক্ত গ্যাসে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন স্থানীয়রা। বেশির ভাগ সময় তারা রাতে গ্যাস ছেড়ে দেন। যখনি গ্যাস ছেড়ে দেওয়া হয় শিশুসহ অনেকেরই বমি হয়। এ ছাড়া কাশি ও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। রাতে ভাটার তাপের গরমে ঘুমাতে পারেন না তারা। এ বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গেলেই ভাটা সংশ্লিষ্টদের হুমকির মুখে পড়তে হয়। তাই তারা পরিবেশ ও ফসল রক্ষায় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
কামাতপাড়া এলাকার কৃষক হাসিবুল ইসলাম বলেন, আমার ২ বিঘা জমির ধান ভাটার বিষাক্ত গ্যাসে পুড়ে গেছে। শীষগুলো বের হওয়ার সাথে সাথেই ঝলসে গেছে। কত কষ্ট করে ধার দেনা করে বর্গা নিয়ে এই বোরো ধান করেছি। এখন ধানগুলোর দিকে দেখলেই কান্না পায়। এই ধান দিয়েই আমার পরিবারের কয়েক মাসের খাবার জোগান হয়। এখন আমি খাবার ধান কোথায় পাব। আবার ভাটার গ্যাসে থাকা যায় না শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে।
একই এলাকার আলম হোসেন জানান, এরা কৌশল করে রাতে বিষাক্ত গ্যাস ছেড়ে দেয়। যখনি গ্যাস ছেড়ে দেয় আমরা থাকতে পারি না। গরমে রাতে ঘুমানো যায় না। আমাদের কাশি ও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গেলেও তারা হুমকি দেয়।
ওই এলাকার শাহজামাল জানান, আমার ৯ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এই ভাটার ধোঁয়া ও বিষাক্ত অনেক ক্ষতিকারক। চারপাশের গাছপালা এমনকি ঘাসও মরে যাচ্ছে। আমরা চাই আমাদের ফসলি ও জনবসতির পাশে এই ক্ষতিকারক ইটভাটা বন্ধ করা হোক।
আনিছুর রহমান নামে ওই এলাকার আরেক ব্যক্তি বলেন, এই অটো ভাটায় শুধু মানুষ ও ফসলের ক্ষতি হচ্ছে না ঘরবাড়িরও ক্ষতি হচ্ছে। বাড়ির টিন মরিচা ধরে কয়েকদিন পর তা ফুটো হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশবান্ধব কারখানা করবে বলে ওরা জমি নিয়েছিল। এখন আমাদের সাথে বেইমানি করে পরিবেশের ক্ষতি করে যাচ্ছে।
জমিলা খাতুন নামের এক বৃদ্ধা জানান, জমির ধানগুলো সব নষ্ট হয়ে গেছেই। রাতে ভাটার জন্য গরমে ঘুমাতে পারি না। গ্যাস ছেড়ে দিলেই মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। শিশুরা বমি করে। এত বলি ওরা কোনো কথা শোনে না।
স্থানীয় কৃষক নাদেরুল ইসলাম বলেন, এই ভাটাকে ওরা বলে পরিবেশবান্ধব। আসলে এই ভাটা ক্ষতিকর। আমনের সময়েও আমাদের ধান এই ভাটার গ্যাসে ঝসলে গিয়েছিল। তারা আমাদের ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েও এখনো দেয়নি। আবার বোরো ধানে একই রকম ক্ষতি হচ্ছে। এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। আমাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সেই সাথে ভাটার উৎপাদন কার্যক্রমও বন্ধ করতে হবে।
এঅ্যান্ডএ অটো ব্রিকস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আজিজুল হক শফিক বলেন, একদিন ঝড়ের রাতে আমাদের জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেছে। তখন গ্যাস বের হয়ে যায়। ফসলের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তবে আরো কতটা ক্ষতি হয় সে জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবু হানিফ বলেন, এ বিষয়টি আমাদের কৃষি কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে গিয়ে দেখেছে। সেখানে আসলেই কৃষকের ধান ভাটার ধোয়ার সাথে উত্তপ্ত গ্যাসে পুড়ে গেছে। বিষয়টি আমরা জেলা সমন্বয় সভায় উত্থাপন করে প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছি।
পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন জানান, আমি বিষয়টি আপনাদের মাধ্যমে শুনলাম। যেকোনো ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রয়োজন হয়। তারপরও বিষয়টি আমি খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।