শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৫ পূর্বাহ্ন
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি, কালের খবর :
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে অদ্বৈত মল্ল বর্মণ লিখেছিলেন, ‘তিতাসে কত জল, কত স্রোত, কত নৌকা। সব দিক দিয়াই সে অকৃপণ। … তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়।
অদ্বৈত মল্ল বর্মণের কালজয়ী সেই উপন্যাসের এই বর্ণনার তিতাস এখন শুধুই ইতিহাস, শুধুই স্মৃতি। সেই তিতাস এখন আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলা থেকে জেলা সদরে যেতে সড়ক কিংবা রেলপথ নেই।
যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। লঞ্চ, স্পিডবোট, নৌকায় তিতাস নদ দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ব্রাহ্মণবাড়িয়া-নবীনগর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া পথে যাতায়াত করে। তবে এই নৌপথে ঝক্কির অন্ত নেই। নদীতে অসংখ্য মাছের ঘের, কচুরিপানার স্তূপ চলাচলে সীমাহীন বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। এ কারণে ঘটছে দুর্ঘটনাও। তিতাস নদ দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আখাউড়া পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী আনা-নেওয়া করা হয়। তবে বর্তমানে বর্ষা মৌসুম ছাড়া এসব পণ্য পরিবহন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্য সময় তিতাসে পানি না থাকায় নৌযান চলাচল করতে পারে না। একই অবস্থা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের উজানিসার থেকে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে আখাউড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তিতাস নদ দিয়ে চলাচলের অবস্থাও। এসব এলাকার কোথাও কোথাও রীতিমতো তিতাসকে খুঁজে পাওয়াই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এসব এলাকায় উপরিভাগের মাটি খনন করে নদীর গতিপথ বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ তো গেল তিতাসের পানি প্রবাহের কথা। তিতাসের ডাঙায়ও রয়েছে নানা বিপত্তি। পাড় ঘেঁষে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গড়ে উঠেছে অনেক অবৈধ স্থাপনা। আর ময়লা-আবর্জনা ফেলে পাড়ের পরিবেশ বিষিয়ে তোলা হয়েছে। এসব দখল-দূষণের কারণে বিভিন্ন স্থানে সংকীর্ণ হয়ে এসেছে তিতাসের গতিপথ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার মেড্ডা থেকে কাউতলী পর্যন্ত তিতাসের পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। অবৈধ দখলদাররা প্রতিনিয়ত নদীর তীর দখল করতে কৌশল হিসেবে এসব স্থানের তিতাসের পাড় ঘেঁষে তৈরি করছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। অবশ্য আশার কথাও আছে। তিতাসকে বাঁচাতে খনন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত নদের প্রায় ৩০ কিলোমিটারের খনন কাজ শেষ হয়েছে। ২০২০ সালের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে তিতাস নদের ৯০ কিলোমিটার অংশ খননের টার্গেট নিয়ে এগিয়ে চলেছে কাজ।
এ ছাড়া তিতাসের শাখা নদী পাগলা ও এন্ডারসন খালের মোট ১৩ কিলোমিটার অংশও একই সঙ্গে খনন করা হবে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৯ কোটি টাকা। বিভিন্ন সূত্রের তথ্যানুযায়ী, তিতাস একসময় কালীদাহ সায়র (সাগর) নামে পরিচিত ছিল। পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা-বেষ্টিত এই তিতাস। জেলা সদর, নবীনগর, আশুগঞ্জ, সরাইল, নাসিরনগর, আখাউড়া, বিজয়নগর উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে তিতাস নদ। সরাইলের বোমালিয়া খাল দিয়ে এসে নবীনগরের চিত্রি গ্রাম দিয়ে মেঘনায় মিলেছে তিতাস। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিতাস নদে সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মেড্ডা থেকে কাউতলী এলাকা পর্যন্ত কচুরিপানার স্তূপ। এ কারণে নৌকা চলাচল করতে পারছে না। তিতাসপাড়ের পূর্ব পাশের বিভিন্ন স্থানে স্তূপ করে রাখা হয়েছে ময়লা-আবর্জনা। পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে একের পর এক স্থাপনা। এপারের মেড্ডা থেকে ওপারের কাশিনগর, এপারের কারখানাঘাট থেকে ওপারের সীতানগরের দূরত্ব ২০০ থেকে ৩০০ গজ। কচুরিপানার কারণে নৌকায় করে এই অংশটুকু পার হতে সময় লেগে যাচ্ছে ১৫ থেকে ২০ মিনিট। তিন থেকে চারজন মিলে এপার থেকে ওপারে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নৌকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২১ জানুয়ারি থেকে আখাউড়ার ধরখার অংশ দিয়ে শুরু হয় তিতাসের উপরিভাগ খননের কাজ। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক এ খনন কাজের উদ্বোধন করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড, পানি বিভাগ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহীনুজ্জামান বলেন, তিতাসের যেসব অংশে খনন করা হয়েছিল সেগুলো মরে গিয়েছিল। বর্তমানে খুব দ্রুত খনন কাজ এগিয়ে চলেছে। তবে পানি না থাকায় ড্রেজার নেওয়া যাচ্ছে না কিছু জায়গায়। ফলে কাজের ব্যাঘাত ঘটছে।