রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:২৩ অপরাহ্ন
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি, কালের খবর :
পথে ঘাটে শুধুই ভোগান্তি। এই ভোগান্তি ঠেলেই মানুষ চলছে ঢাকায়। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য। নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়েই ফিরতে হচ্ছে ঈদ ফেরত যাত্রীদের। এমন দৃশ্য পাটুরিয়া ও আরিচা ঘাট থেকে শুরু করে ঢাকার গাবতলি পর্যন্ত। সোমবার সকাল থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের গাবতলী পর্যন্ত প্রত্যেকটি বাস স্টপেজে ঢাকামুখো যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়। এছাড়া দৌলতদিয়া প্রান্ত থেকে দুর্ভোগ নিয়ে ফিরতে হচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঈদ ফেরত যাত্রীদের।
সরজমিন মানিকগঞ্জের ঘাটে পথে ঘুরে দেখা গেছে ঈদ ফের মানুষের দুর্ভোগের করুন দৃশ্য। দৌলতদিয়া ঘাট থেকে ফেরি ও লঞ্চযোগে যাত্রীরা পাটুরিয়া ঘাটে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন গণ-পরিবহনের কাউন্টার গুলোর সামনে। সকাল থেকে দিনভর ঠেলা ধাক্কায় চলে গণ-পরিবহনে ওঠার প্রতিযোগিতা। তাও আবার নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে দ্বিগুণ বেশি ভাড়া গুনে। এছাড়া আরিচা, উথুলী, টেপড়া, বরংগাইল, বানিয়াজুরী, তরা, মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড, গোলড়া, নয়াডাঙ্গিসহ ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের প্রত্যেকটি বাস স্টপেজে ঢাকামুখো যাত্রীরা দিনভর চরম ভোগান্তি নিয়ে ফিরছে যে যার গন্তব্যে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসের অপেক্ষায় থেকে কেউ গন্তব্যে যেতে পারছে আবার কেউ বাসে উঠতে না পেরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে পাটুরিয়া ও আরিচা থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত বিআরটিসি’র নির্ধারিত ভাড়া ১৬০ টাকা। কিন্তু ঈদ ফেরত যাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া গচ্ছে আড়াইশ’ টাকা করে। এছাড়া পদ্মা লাইন, নবীনবরণ, ভিলেজ লাইন, যাত্রীসেবাসহ লোকাল বাসগুলো একই কায়দায় নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে দ্বিগুণ ভাড়া নিয়ে যাচ্ছে গাবতলী, সাভার, নবীনগরসহ বিভিন্ন প্রান্তে। বাসের ভেতরে সিট না পেয়ে ভেতরে গাদাগাদি করে এমনকি ছাদেও যাচ্ছেন মানুষজন। এছাড়া ঈদকে পুঁজি করে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বাইরের রোডের গাড়ি চলছে এই রুটে। তারা ভাড়া হাকাচ্ছে দ্বিগুণ। যাত্রীদের অভিযোগ- সাধারণ সময়ে পাটুরিয়া কিংবা আরিচা ঘাট থেকে গাবতলী পর্যন্ত ভাড়া ৮০-৯০ টাকা হলেও যাত্রী চাপকে পুঁজি করে ঈদের পর ভাড়া নেয়া হচ্ছে কমপক্ষে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। শুধু তাই নয়, আরিচা-পাটুরিয়া ঘাট থেকে নবীনগর ও সাভারের ভাড়াও একই সমান গুনতে হয়। এতে কম আয়ের মানুষজন সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন।
পাটুরিয়া ঘাটে কথা হয় কয়েকজন বাসযাত্রীর সঙ্গে। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ এলাকার রহিম মিয়া তার স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে লঞ্চযোগে আসেন পাটুরিয়া ঘাটে। সকাল ৯টা থেকে বাসের অপেক্ষায় বসে থাকেন পরিবারটি। বেলা ১১টায়ও বাসে উঠতে পারেনি। ভাড়তি ভাড়ার অভাবে তারা কোনো বাসেই উঠতে পারছেন না বলে তাদের অভিযোগ। রহিম মিয়া জানালেন, আমরা নিম্ন আয়ের মানুষ। ঢাকার বাসাবো এলাকায় কাজ করি। ঈদে বাড়ি এসে অধিকাংশ টাকাই খরচ করে ফেলেছি। ফেরার জন্য যে টাকা রেখে দিয়েছি তা দিয়ে বাসের ভাড়াই হচ্ছে না, তার ওপর বাড়তি ভাড়া কোথা থেকে পাবো? দেখি কম টাকায় যাওয়া যায় কিনা তার জন্য অপেক্ষায় আছি।
ফরিদপুরের নারী শ্রমিক রোকেয়া বেগম ও সাহেলা বেগম কাজ করেন নবী নগরের ইপিজেড-এ। ঈদের ছুটি শেষে নবীনগর যাওয়ার উদ্দেশে তিনি পাটুরিয়া ঘাটে আসে। তিনি জানান, গাবতলী যেতেও ২০০ টাকা আর নবীনগর যেতেও একই ভাড়া নেয়া হচ্ছে। অথচ পাটুরিয়া থেকে নবীনগরের ভাড়া মাত্র ৫০-৬০ টাকা দেই। তাই কম ভাড়ার গাড়ির জন্য অপেক্ষায় আছি। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার সাহেব আলী জানালেন, পরিবারের ৫ সদস্য নিয়ে পাটুরিয়া ঘাটে এসে বেকায়দায় পড়ে গেছি। ঢাকা যেতে দ্বিগুণ বেশি ভাড়া চাচ্ছে। তাই সকাল থেকে বসে আছি কম ভাড়ায় যাওয়ার কোনো বাস আছে কি-না।
আরিচা ঘাটের চিত্র একই রকম। সেখানেও পাবনা, বাঘাবাড়ি, কাজিরহাট, সুজানগর, ভেড়াসহ আরো বিভিন্ন এলাকার ঈদ ফেরত মানুষজন ঢাকা ফিরতে বাস ভাড়ার রোসানলে পড়ে বেকাদায় পড়েছেন। যাত্রী সেবা ও নবীনবরণ পরিবহনসহ অনান্য পরিবহনের ভাড়া কয়েকগুণ বেশি হওয়ায় ক্ষুব্ধ হচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। নগরবাড়ীর শফি উদ্দিন জানালেন, সাধারণ সময়ে আরিচা থেকে গাবতলী যেতে বাস ভাড়া লাগে সর্বচ্চ ৮০-৯০ টাকা। কিন্ত ঈদকে পুঁজি করে এখন ৯০ টাকার ভাড়া ২০০ টাকা নিচ্ছে। বিআরটিসি বাসের উঠতে গেলে ভাড়া চাচ্ছে আড়াইশ’ টাকা। পাবনার সুজানগর এলাকার আকমল হোসেন জানালেন, বর্তমানে যে ভাড়া বাসে নেয়া হচ্ছে এটা টাকাওয়ালাদের জন্য। আমাদের মতো গবির মানুষের এটা ওপর বোঝা। ঘাটে প্রশাসনের লোকজন এই অনিয়ম দেখেও দেখে না।
বাস চালকরা জানিয়েছেন, ঈদের পর গাবতলী থেকে খালি গাড়ি নিয়ে তাদের ঘাটে আসতে হচ্ছে। তাই ভাড়া পুষিয়ে নিতে কিছুটা বেশি নেয়া হচ্ছে।
এছাড়া পাটুরিয়া ও আরিচা লঞ্চ ঘাটে ঈদ ফেরত মানুষের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করে প্রত্যেকটি লঞ্চে উঠানো হচ্ছে অতিরিক্ত যাত্রী। এসব রুটে ৩৩টি লঞ্চ চলাচল করছে। যাত্রীর চাপ বেশি থাকায় লঞ্চে গাদাগাদি করে যাত্রী পরাপার হচ্ছে।
এদিকে দৌলতদিয়া ঘাটের যানবাহনের চাপ বেশি থাকায় সেখানে যানজট দেখা দিয়েছে। সকাল থেকেই ঘাট ছাড়িয়ে যানবাহনের লম্বা লাইন কয়েক কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে। এতে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ঈদ ফেরত যাত্রীরা ঘাটে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকছে ফেরির সিরিয়াল পেতে। ফলে যানবাহনের যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ঘাট এলাকায়। পাশাপাশি রয়েছে পদ্মায় তীব্র স্রোতে। স্রোতের কারণে বিলম্ব হচ্ছে ফেরি পারাপার। বিআইডাব্লিউটিসি আরিচা অঞ্চলের এজিএম জিল্লুর রহমান কালের খবরকে জানিয়েছেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ২০টি ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। ঈদের আগে মাওয়া এলাকায় নব্যতা সংকটের কারণে সেখানে ফেরি চলাচল বিঘ্নিত হওয়ায় পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে যানবাহনের চাপ বেশি ছিল। ঈদের পর মূলত দৌলতদিয়া ঘাটে যানবাহনের চাপ বেশি থাকে। কয়েকদিন ধরেই সেখানে চাপ বেশি। তবে পদ্মায় তীব্র স্রোতের কারণে ফেরি চলাচল করছে কিছুটা ধীর গতিতে। যার কারণে টিপও কমে গেছে। পাটুরিয়া ঘাটে কোনো সমস্যা নেই বলে তিনি জানান। পাটুরিয়া ঘাটের ট্রাফিক পুলিশের ইন্সপেক্টর (টিআই) একে এম ফজলুল হক কালের খবরকে বলেন, বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করার অভিযোগ পেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবে যাত্রীরা কোন অভিযোগ করছে না।