বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:০২ অপরাহ্ন
হাফিজ মুহাম্মদ, কালের খবর, :
মো. হাবিবুল্লাহ। বাবা মানিকগঞ্জের একটি মসজিদের ইমাম। মা গৃহিণী। গ্রামের বাড়ি ভোলায়। রাজধানীর একটি কওমি মাদরাসার হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। থাকা-খাওয়া বাবদ তার প্রতি মাসে মাদরাসায় দিতে হয় এক হাজার টাকা। হাবিবুল্লাহর বাবার অল্প বেতন দিয়ে তাদের দুই ভাই আর বোনকে পড়াতে হিমশিম খেতে হয়। এরপরেও আলেম বানানোর স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি করান মাদরাসায়। হাবিবুল্লাহ পড়ে মিরপুরের ‘জামিয়া ইসলামিয়া দারুল আলম ঢাকা (মসজিদুল আকবর) মাদরাসায়’।
হাবিুবল্লাহর মতো আরো অনেক ছাত্র আছেন যারা আলেম হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছেন কিংবা মা-বাবা ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন মাদরাসায়। রাজধানীর মিরপুরের এ মাদরাসার আরো একাধিক ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের স্বপ্ন, বেড়ে ওঠা, লেখা-পড়াসহ নানা বিষয়। এ প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য কওমি মাদরাসা থেকে একটু আলাদা। এখানে যারা পড়েন তারা আলিয়া মাদরাসা থেকে ৫ম শ্রেণি সমাপনী, জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) এবং দাখিল পরীক্ষা অংশ নেয়ার সুযোগ পান। তবে অনেকে এসব সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশ নেন না বলেই জানা যায়। মাদরাসার নিয়ম অনুযায়ী এখানে খাবার পরিবেশন করা হয় দুই বেলা। দুপুর এবং রাতে। আর সকালে নিজেদের টাকায় কিনে নিতে হয়। আবাসিক চার্জ ফ্রী। এ মাদরাসায় পড়ানো হয় দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) পর্যন্ত। এর সঙ্গে রয়েছে হেফজ বিভাগ, নুরানী ও মক্তবখানা। গরিব ও ইয়াতিম ছাত্রদের খাওয়া দাওয়ার জন্য রয়েছে লিল্লাহ বোর্ডিং ও ইয়াতিমখানা। মিজান (অষ্টম) শ্রেণির ছাত্র মহিববুল্লাহ বলেন, আমার বাবা নেই। তাই বাড়ি থেকে মা টাকা দিতে পারে না। তিনশত টাকা খাওয়ার চার্জ বাবদ দিতে হয়। আমি বড় আলেম হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এখানে ভর্তি হয়েছি। শিক্ষকদের পাঠ-দানে আন্তরিকতার কথা তুলে ধরে বলেন, আমাদের শিক্ষকরা নিষ্ঠার সঙ্গে লেখা-পড়া করান। কওমি মাদরাসার বাহির থেকে যে বদনাম শোনা যায় সেটা সঠিক নয়। সাধারণ মানুষের একটি ভুল ধারণা মাত্র। মো. আশিক পড়েন ২য় শ্রেণিতে। এ ছাত্র জানান, তার বাবা ভ্যান চালক আর মা গার্মেন্টস কর্মী। মাদরাসার পাশেই ভাড়া বাসায় থাকেন তার বাবা-মা। আশিক দিনের বেলায় মাদরাসায় থাকলেও রাতে বাবা-মায়ের সঙ্গে বাসায় থাকেন। খাওয়া দাওয়াও করেন বাসায়। ক্লাসে আরবী, বাংলা, ইংরেজি, গণিত এবং সাধারণ জ্ঞান পড়ানো হয়। তার স্বপ্ন বড় আলেম হয়ে দেশ ও জাতির খেদমত করা। তবে পড়াশোনা কতদূর চালিয়ে যেতে পারবেন তা তিনি জানেন না।û
হাফেজ তরিকুল ইসলাম নামে এক ছাত্র জানায়, সে তাইসি ক্লাসে (৫ম শ্রেণি) পড়ে। মাদরাসা তার কাছ থেকে খাবার বাবদ প্রতি মাসে ১২০০ টাকা নেয়। এ মাদরাসায় সমাপনী পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই এটা কওমি মাদরাসা হলেও এখানে সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে। এছাড়াও এখানে পরিবেশ এবং পড়ালেখার মান অনেক ভালো। আমি হাফেজ হওয়াতে ক্লাসে একটু পিছিয়ে পড়েছি। তবে বড় আলেম হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে নিয়মিত পড়াশোনা করে যাচ্ছি। মাদরাসার সার্বিক পরিবেশ, ধর্মীয় জ্ঞানের সঙ্গে সমসাময়িক যেসব বিষয় ছাত্রদের পাঠদান করানো হয় সে বিষয়ে এ মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা মুফতি জাকারিয়ার বলেন, আগে কওমি মাদরাসায় যে নিয়ম বা সিলেকবাস ছিল সেখান থেকে অনেকটা বেরিয়ে এসেছে মাদরাসাগুলো। বর্তমানে আরবী উর্দুর সঙ্গে সাধারণ এবং বিজ্ঞানের বিষয়ও সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মাদরাসায় নিয়মিত একাধিক পত্রিকা রাখা হয় যাতে ছাত্ররা দেশের সব ধরনের অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিয়মিত আলোচনা করা হয়। যাতে কেউ ভুলেও ভ্রান্ত পথে পা না বাড়ায়। এ শিক্ষক আরো বলেন, আমাদের এখানে ছাত্রদের একরকম ফ্রী পড়ানো হয়। কোন কোন ছাত্র থেকে নামে মাত্র টাকা নেয়া হয়।
মূলত দানের টাকায় এ মাদরাসাটি ২০০০ সাল থেকে পরিচালিত হয়ে এসেছে। এ মাদরাসার অন্য একজন শিক্ষক জামাল নাসরুল্লাহ বলেন, আধুনিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে এখানে আলেম তৈরি করা হয়। সরকারের স্বীকৃতির ঘোষণায় তা আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল। আমাদের চাওয়া হল কওমি মাদরাসার ছাত্ররা যাতে এগিয়ে যায়। তারা এখন আর পিছিয়ে নেই। এজন্য তাদের সনদ পাওয়া উচিত। অনেক আগ থেকেই এ মাদরাসাটি কওমি মাদরাসা বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত। বোর্ড পরীক্ষা তাদের অধীনে পরিচালিত হয়ে এসেছে। কওমি মাদরাসা শিক্ষার মূল ধারার বাহিরে থাকলেও বড় একটা অংশ লেখাপড়া করেন এ মাধ্যমে। সরকারের সব ধরনের সহযোগিতা ছাড়াই যুগ যুগ ধরে পরিচালিত হয়ে এসেছে মাদরাসাগুলো।
সাধারণ মানুষের দানই মূলত তাদের আয়ের প্রধান উৎস। এ বছর এপ্রিলে সরকার কওমি মাদরাসার স্বীকৃতির গেজেট প্রকাশ করলে তারা নিজেরাও নড়েচড়ে বসেন।
দৈনিক কালের খবর /৮/৪/১৮