রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:২৩ পূর্বাহ্ন
চলতি বছরের ১৯ নভেম্বর রোজ রোববার। দুপুর থেকেই রাত পর্যন্ত দক্ষিণখানের হাজী ক্যাম্প রোডের নিজ কার্যালয়ে অফিস করেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৪৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর উত্তর সেচ্ছাসবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান নাঈম। অথচ ওই দিন বিকেল ৪টায় তিনি ও তার সহযোগীসহ একটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা প্রকল্পে গিয়ে চাঁদাবাজি ও মারধরের অভিযোগে আদালতের নির্দেশে ২৩ সেপ্টম্বর দক্ষিণখান থানায় একটি মামলা করেন নুরুল আক্তার নামের একজন ময়লা ব্যবসায়ী। ওই মামলায় কাউন্সিলর নাঈমকে এক নম্বর, রাজু ও মাসুদকে দুই ও তিন নম্বর এবং অজ্ঞাত আরো ৮/১০ জনকে আসামী করা হয়। যদিও ঘটনাস্থলের আশে পাশের লোকজন ও বাদীর স্ত্রী সন্তানও দেখেননি মারধর ও চাঁদাবাজির ঘটনা।
আদালতের নির্দেশে দক্ষিণখান থানায় কাউন্সিলরেরে বিরুদ্ধে করা মামলার এজাহারে বলা হয়, ময়লা ব্যবসায়ী নুরুল আক্তার ১৯৯০ সাল থেকে ডিএনসিসির ৪৯ নং ওয়ার্ডের গাওয়াইর, আশকোনা, হাজী ক্যাম্প এলাকার রাস্তা ঘাট, দোকানপাট, বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ ও অপসরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় কাউন্সিলর ও তার সহযোগীরা নিয়মিত চাঁদা দাবি করতো। এক পর্যায়ে চাঁদা না পেয়ে কাউন্সিলর ও তার সহযোগীরা নুরুল আক্তারের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মারধর করে চারটি ময়লার ভ্যানগাড়ি নিয়ে যায়। সেই সাথে গত ১৯ নভেম্বর বিকেল ৪টার দিকে তার আশকোনা গাওয়াইর পরিষ্কার পরিচ্ছনা জনকল্যাণ প্রকল্পের অফিসে কাউন্সিলর নাঈম, রাজু, মাসুদসহ আরো অজ্ঞাত ৮/১০ জন গিয়ে দুই লাখ টাকা দাবি করে। অতঃপর কাউন্সিলর নাঈম নুরুল আক্তারের শার্টের কলার ধরে মারধর করে এবং তার কর্মচারী মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা নিয়ে যায় রাজু ও মাসুদ।
কিন্ত সরেজমিনে অনুসন্ধান করে এসব বিষয়ের কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। সেই সাথে মামলার স্বাক্ষীরাই মারধর করে চাঁদাবাজির ঘটনা প্রসঙ্গে কিছুই জানেন না। মামলার এজাহারে ঘটনাস্থলটি আশকোনা গাওয়াইর পরিষ্কার পরিচ্ছনা জনকল্যাণ প্রকল্পের অফিস উল্লেখ করা হলেও ৩ সেপ্টেম্বর থেকে সেখানে নুরুল আক্তারের স্ত্রী সন্তান সেখানে বসবাস করেন বলে জানিয়েছেন তার মেয়ে মারিয়া আক্তার। এজারের উল্লেখিত সময় পরিবারের লোকজন ওই বাড়িতে থাকলে কেউ-ই কিছুই দেখেননি বলে জানিয়েছেন। অপরদিকে স্বাক্ষীরাই মামলার বিষয়ে না জানায়, স্বাক্ষী থেকে নাম বাদ দিতে থানায় ঘুরঘুর করছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। এছাড়াও চাঁদাবাজি মামলার সুনির্দিষ্ট তথ্য, প্রমাণ পায়নি পুলিশ।
অনুসন্ধানে ডিএনসিসির ৪৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কার্যালয়ে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ তল্লাশি করে দেখা যায়, ঘটমার দিন দুপুর ১টা ৫১ মিনিটে প্রবেশ করেন কাউন্সিলর নাঈম। পরবর্তীতে বিকেল ৪টা ২০ মিনিটের দিকে তিনি অফিস কার্যালয় থেকে বের হন। পরে তার কার্যালয়ের নির্মাণ কাজ পর্যবেক্ষণ করেন বলে জানিয়েছেন কার্যালয়ের পাশের দোকানদাররা। বিকেল ৫টা ২৩ মিনিটে ফের কার্যালয়ে প্রবেশ করেন তিনি। সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিটে কার্যালয়ের সামনের গেটে দাঁড়িয়ে লোকজনের সাথে কথা বলেন। সেখান থেকে ৬টা ১৬ মিনিটে আবার তার কক্ষে প্রবেশ করেন। তখন ডিএনসিসির সংরক্ষিত আসনের মহিলা কাউন্সিলর জাকিয়া সুলতানা ও অন্যান্য লোকজনের সাথে রাত ৭টা ৫৮ মিনিট পর্যন্ত বৈঠক করে ৭টা ৫৯ মিনিটে কার্যালয় থেকে বের হন।
এদিকে সরেজমিনে ঘটনাস্থলের আশকোনার ৭০ (পুরাতন ২০২) নম্বর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মামলার এজাহারে এটিকে আশকোনার গাওয়াইর পরিষ্কার পরিচ্ছনা জনকল্যাণ প্রকল্পের অফিস উল্লেখ করা হলেও সেখানে নুরুল আক্তার তার পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। ছিল না কোন অফিসের অস্বিত্ব। আশেপাশের বাসিন্দা ও তাদের বাড়ির ভাড়াটিয়াদের মধ্যে কেউই দেখেননি কাউন্সিলর ও তার সহযোগীরা নুরুল আক্তারকে মারধর করে টাকা পয়সা নিয়ে যেতে।
নুরুল আক্তারের মেয়ে মারিয়া আক্তার সিএনআই’কে বলেন, গত ৩ সেপ্টম্বর থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা প্রকল্পের অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আগে আমরা একটি ফ্যাটে ভাড়া থাকতাম। সেখানে ভাড়া পরিশোধ না করতে পারায় ওই দিন থেকেই আমরা এখানে বসবাস করা শুরু করেছি।
তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস সিএনআই’কে বলেন, চাঁদাবাজি ও মারধরের ঘটনার সময় আমরা পাশের রুমে ছিলাম। তখন কে বা কারা এসেছে তা জানি না। পরবর্তীতে শুনতে পেরেছি রাজু, মাসুদ, মুনসুর এসে মারধর করে টাকা পয়সা নিয়ে গেছে।
বাড়ির পাশের রুমেই থাকেন নুরুল আক্তারের ভাই দেলোয়ার। তিনি সিএনআই’কে বলেন, মারধর করে টাকা পয়সা নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বাহির থেকে আইসা শুনেছি। আনিসুর রহমাম নাঈম কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকে ময়লা ব্যবসায় বাধাদান শুরু করেন।
মামলার এক নম্বর স্বাক্ষী হলেই বাদী নিজেই। দ্বিতীয় স্বাক্ষী জামাল উদ্দিন ভূঁইয়া সিএন আই’কে বলেন, ওই দিন মাগরিবের নামাজ
পড়ে মসজিদ থেকে বের হতেই নুরুল আক্তার আমাকে ডাকে। তখন আমাকে জানায়, মজিবুর রহমান ও সাইফুল ইসলাম নামের তার দুই কর্মচারী রাজু ও মাসুদকে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়েছে। তিনি বলেন, তবে কখন ও কোথাও দিয়েছেন তা জানি না, দেখিও নি। এছাড়াও কাউন্সিলর ও তার লোকজনকে নুরুল আক্তারকে মারধর করা তো দূরের কথা, তাদেরকে আক্তারের এলাকায় আসতেও দেখি নাই।
মামলার তৃতীয় স্বাক্ষী মজিবুর রহমান সিএনআই’কে বলেন, চাঁদাবাজি ও মারধরের বিষয়ে কিছুই জানি না। আগে ওই মালিকের কাজ করতাম, তাই আমাকে না জানিয়ে স্বাক্ষী বানাইছে।
মামলার চতুর্থ স্বাক্ষী সাইফুল ইসলাম সিএনআই’কে বলেন, আমরা আমাদের কাজ বন্ধ রাখিনি। কাজ চালিয়েই যাচ্ছি। আগে ম্যানেজারকে বাদ দিয়ে নতুন ম্যানেজার রাখছে, তার আন্ডারেই কাজ করছি।
‘যে দিনের ঘটনায় মামলা কাউন্সিলরসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, ওই দিন আমি বাসায় ছিলাম। হামলা, মামলা, চাঁদাবাজির বিষয়ে কিছুই জানি না আমি’ বললেন সাইফুল।
মামলার স্বাক্ষীরা আরো বলেন, ‘নুরুল আক্তার আমাদেরকে কখনো বলেও নি কারো বিরুদ্ধে মামলা করবো, তোমরা স্বাক্ষী দিবে নাকি। আগে তার ওখানে কাজ করতাম, তাই কিছু না জানার পরও আমাদেরকে স্বাক্ষী বানিয়ে দিয়েছে।’
আশকোনা গাওয়াইর পরিস্কার পরিচ্ছতা জনকল্যাণ প্রকল্পের সাবেক ম্যানেজার আবুল মুনসুর সিএনআই’কে বলেন, ওই পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা প্রকল্পে চার বছর কাজ করেছি। কিন্তু এলাকার কিছু প্রভাবশালীরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় ময়লার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে করে তার নিজের আর ব্যবসা নেই।
তিনি বলেন, আগে নুরুল আক্তার কন্টাকদারের মাধ্যমে কন্টাকে ১১টি সাইটের ময়লার ব্যবসা করতেন। ময়লার গাড়ীগুলো ছিল কন্টাকদারদের। কিন্তু আস্তে আস্তে চারটি সাইট দখল হয়ে গেছে। বাকি সাইটগুলোও দখল হয়ে যাচ্ছে। পরে আমরা ও কন্টাকদাররা সবাই মিলে ময়লার ব্যবসাটি রাজুদেরকে দিয়ে দেয়। কারণ ময়লার ব্যবসা করার জন্য রাজু’রা বহু আগেই একবার গাড়ী বানাইছিল। আবার নুরুল আক্তারও তার সাইট ধরে রাখতে পারছেন না, অন্যরা দখল করে নিচ্ছেন।
‘সব সাইটগুলো দখল হয়ে গেলে আমরা যারা সাধারণ কর্মচারীরা যাবো কোথায়, খাবো কি? আমরা তো সবাই ময়লার কাজ করেই নিজেরা খাই, আবার পরিবারকেও খাওয়াই’ বললেন ম্যানেজার আব্দুল মুনসুর।
চাঁদাবাজি ও মারধরের অভিযোগে করা মামলার দুই নাম্বার আসামী মো. রাজু সিএনআই’কে বলেন, ২০২০ সালে আমি আমার এলাকার ময়লার পরিচ্ছন্নতার কাজ করার জন্য ভ্যান গাড়ী তৈরি করি। তখন নুরুল আক্তারের পক্ষ থেকে ডুবাই থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও জোসেফ, ভারত থেকে মোহাম্মদপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাৎ একের পর এক মেরে ফেলার জন্য মুঠোফোনে হুমকি-ধামকি দিয়েছে। সেই সাথে আমরা যখন যেখানেই থাকতাম সেই জায়গার নাম বলে তারা হুমকি দিয়ে বলতো, ‘তুই তো এখন ওই জায়গায় আছস না। এখন তোরে গুলি করে মেরে ফেললে কি করতে পারবি। অযথাই ঝামেলায় করিস না। এখান থেকে সরে যা।’
এমতাবস্থায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ভয়ে নুরুল আক্তারের কাছে ময়লার গাড়ী বুঝিয়ে দিতে বাধ্য হই। কিন্তু যখন চলতি বছরের শুরুতে নুরুল আক্তার তার ময়লার সাইট ধরে রাখতে পারছিল না এবং একের পর একজন দখল করে নিচ্ছিল। তখন তার ময়লার ঠিকাদার ও ম্যানেজার সাইটটি আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তারাই ওই সাইটগুলো দেখভাল করছে। কিন্তু আমরা নুরুল আক্তারকে মারধরও করি নাই, চাঁদাও নেই নাই। সে শুধু শুধু আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নুরুল আক্তারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া চারটি সাইট রয়েছে বিমানবন্দর থানা আওয়ামীলের সহ-সভাপতি সোহেল রেজা এবং ঢাকা মহানগর উত্তর জাতীয় শ্রমিকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাশেম শেখের ছেলে কাইয়ুম শেখ, ডিলার মাসুদ ও বাবুর দখলে। এরমধ্যে দক্ষিণখানের আশকোনার পূর্ব বাজার থেকে সিটি কমপ্লেক্স, সাততলা গার্মেন্টস, আইনুছবাগ ও চাদনগরের তিনটি সাইট সোহেল রেজার দখলে। অপরদিকে দক্ষিণখানের রসুলবাগ ও আমতলা এলাকা রয়েছে কাইয়ুমের দখলে। তাদের সহযোগী হিসাবে কাজ করছে ডিলার মাসুদ ও বাবু। এছাড়াও মামলায় যে চারটি গাড়ী দখল করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে, তা হল বিমানবন্দর থানা জাতীয় শ্রমিকলীগের সোহেল রেজার দখলে। আর ওই চারটি গাড়ী বর্তমানে দক্ষিণখানের রসুলবাগ জামে মসজিদের পাশে সোহেল রেজার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এদিকে কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে দক্ষিণখান থানায় করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল হক মিঞা সিএনআই’কে বলেন, মামলার স্বাক্ষীদের মধ্যে মাত্র একজনের সাথে কথা বলতে পেরেছি। তিনি ওই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। পরবর্তীতে শুনেছেন বলে জানতে পেরেছি। অপরদিকে বাকি স্বাক্ষীদের এখন পর্যন্ত পাইনি।
অপরদিকে দক্ষিণখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ মামুনুর রহমান সিএনআই’কে বলেন, আদালতের নির্দেশা মামলা হয়েছে, তদন্ত শেষে আদালতে রিপোর্ট পেশ করা হবে। কিন্তু তদন্তে কি পাওয়া গেল সেটি অন্য কাউকে রিপোর্ট পেশ করার আগে বলা যাবে না।
তিনি আরো বলেন, যেহেতু এটি সিটি কর্পোরেশনের এলাকা, সেহেতু ময়লা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সিটি কর্পোরেশন টেন্ডারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা কথা।
এ বিষয়ে ডিএনসিসি’র ৪৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর উত্তর সেচ্ছাসবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান নাঈম সিএনআই’কে বলেন, আমার একটাই সমস্যা ‘আমি রাজনীতি করি, দলীয় একটি পদে আছি। আওয়ামীলীগ আমায় দলের একটি পদ দিয়েছে। জনগণ আমাকে কাউন্সিলর বানিয়েছে। আমি উচিত কথা বলি, সত্যা কথা বলি।’ এর জন্য কেউ কেউ ভাবছেন আগামীতে আমি এমপি ইলেকশন করবো। যার কারণে আমার নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা ও জিডি করে জনপ্রিয়তা কমানোর জন্য পায়তারা চলছে।’
তিনি বলেন, ‘তারা আসলে আমার বিরুদ্ধে ময়লার ভ্যান গাড়ী চুরি ও চাঁদাবাজির মামলা দিয়ে কি প্রমাণ করতে চায়? আমিও তো চাইলে তাদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে পারি, তাদের অপকর্ম মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারি। কিন্তু আমি আওয়ামীলের জন্য কাজ করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থার মানুষ হিসাবে থাকতে চাই। তাই তাদের মত করে আমি আমার দলকে খারাপ বানাতে পারি না।’