মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:২২ পূর্বাহ্ন
চাঁদপুর প্রতিনিধি, কালের খবর :
চাঁদপুরের মেঘনা নদীর দুর্গম চরে সমন্বিত চাষাবাদে বিপ্লব ঘটিয়েছেন স্থানীয় এক উদ্যোক্তা। যেখানে বছরে একবার ফসল ফলানোই ছিল কষ্টসাধ্য, সেখানে পরিকল্পিত চাষাবাদে সারা বছরই ফলানো হচ্ছে হরেক রকমের সবজি ও ফল। ঝিলে উৎপাদন হচ্ছে মাছ।
এই কাজে সফলতাও পেয়েছেন বেশ।
বছর না ঘুরতেই প্রতিদিন আয় হচ্ছে এক লাখ টাকা। এই কৃষি বিপ্লবে সুযোগ হয়েছে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের।
চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার এক দুর্গম জনপদ নীলকমল চর। মেঘনা নদীর বুকে জেগে থাকা এই দুর্গম চরে যাওয়ার একমাত্র উপায় নৌকা কিংবা জলযান। এই চরের অধিকাংশ জমি বর্ষায় তলিয়ে থাকে পানির নিচে। কিন্তু নীলকমল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন সর্দারের উদ্যোগে বদলে গেছে চিরায়িত এই চিত্র। শুধু শীতের মৌসুমেই নয়, এখন সারা বছরই চাষাবাদ হচ্ছে এই দুর্গম চরে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, জঙ্গলে ভরা দুর্গম এই চরের বিরাট একটি অংশ ফল আর ফসলের সমারোহ। মাটি কেটে জায়গা উচু করে গড়ে তোলা হয়েছে পরিকল্পিত কৃষি খামার।
কৃষি উদ্যোক্তা মো. সালাউদ্দিন সর্দার বলেন, জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালনের পরের সময়টুকু কাজে লাগানোর ইচ্ছায় পরীক্ষামূলকভাবে চাষাবাদ শুরু করি। চরাঞ্চল হওয়ায় এখানে বর্ষা মৌসুমে পানিতে তলিয়ে যায়। তাই শুধুমাত্র শীতকালে চাষাবাদের সুযোগ পাওয়া যেত। আমি সেই প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতি বদলে দিতে পরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু করি।
তিনি বলেন, এর শুরুটা হয় তিন বছর আগে। পৈত্রিক জমিতে মাটি কেটে মাছ চাষ দিয়ে শুরু। এতে সফলতা পেয়ে ১২০ একর জমির ৭০ একরে চাষাবাদ করছেন বিভিন্ন শাক-সবজি ও হরেক রকমের ফল। অল্প দিনেই ব্যাপক সফলতা পাওয়ায় বাড়ানো হয় বিনিয়োগের পরিমান। বর্তমানে ১২০ একর জমিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। যা থেকে এখন প্রতিদিন আয় হচ্ছে ১ লাখ টাকা।
এই উদ্যোক্তা বলেন, কাজের শুরুর দিকে অনেকে নিরুৎসাহিত করেছেন। অনেকে বলেছেন, বিনিয়োগের টাকাসহ জলে ভেসে যাবে। আমি মনোবল না হারিয়ে কাজ চালিয়ে যাই। আজ আমার এই সফলতায় তারাই এখন মুগ্ধ। বর্তমানে অনেকেই আসছেন আমার খামার দেখতে।
তিনি বলেন, এখানে স্থায়ীভাবে কাজ করছেন ৫০ থেকে ৬০ জন শ্রমিক। অস্থায়ীভাবে আরও ৩০ থেকে ৪০ জন বেকার যুবক কাজ করে ঘুছিয়েছেন নিজেদের বেকারত্ব।
এই খামারের শ্রমিক সোহেল সরকার বলেন, কাজ কাম না থাকায় আগে বেকার ছিলাম। পরিবারপরিজন নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটতো। এখানে কাজ পেয়ে দিন ভালোই কাটছে।
আরেক শ্রমিক জব্বার সিকদার বলেন, বর্ষায় চরাঞ্চলগুলো পানিতে ডুবে থাকায় কোন ফসল ফলানো সম্ভব না। তাছাড়া নদীতে মাছ না পাওয়ায় বেকার সময় কাটতো। এখন এই কৃষি খামারে কাজ করে যেই টাকা পাই, তা দিয়ে সুন্দর মত সংসারের খরচ চলে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. ফারুখ বলেন, শুরুর দিকে আমরা সন্দিহান ছিলাম ওনার কর্মকাণ্ডে। চরে কোনদিন সারা বছর ফসল ফলাতে দেখি নাই, কেউ চিন্তাও করে নাই। এখন তিনি এই কাজ করে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন।
কৃষি উদ্যোক্তা সালাউদ্দিন সর্দার বলেন, আমার এই খামারে সকল ফসল কিটনাশকমুক্ত। বর্তমানে এখানে আম, কাঠাল, তরমুজ, কলা, শসা, করলা, লাউ, বেগুন, চালকুমড়ো, বরবটি, ঝিঙে, মরিচসহ বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজি চাষাবাদ করা হচ্ছে। একাধিক ঝিলে করা হচ্ছে মাছ চাষ।
তিনি বলেন, বর্তমানে এই কৃষি খামারে গড়ে প্রতিদিন ২০-২৫ মণ করলা, ৭০০-৮০০ লাউ, ৩০-৩৫ মণ শসা, ২-৩ মণ বরবটি, ৫-৭ মন ঢেঁড়শ উৎপন্ন হচ্ছে। যা চাঁদপুরের স্থানীয় বাজারগুলোসহ বিক্রি করা হচ্ছে শরীয়তপুর, ফেনী, লক্ষ্মীপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলায়।
সালাউদ্দিন সর্দার বলেন, আমার এই কাজে কৃষি কর্মকর্তাদের খুব একটা সহায়তা পাইনি। তাই যে কোনো প্রয়োজনে ইন্টারনেট সহায়তায় জেনে সেভাবে করার চেষ্টা করেছি। তবে সকলের সার্বিক সহযোগিতা পেলে দেশকে খাদ্যে সংয়সম্পূর্ণ করতে আরো ভূমিকা রাখতে পারবো। এই কৃষি খামার থেকে প্রতিদিন ৫ লক্ষ টাকা আয় করার লক্ষ্য আমার। যাতে এই অঞ্চলের আরো অনেক বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়।
চাঁদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. জালাল উদ্দিন বলেন, সাধারণত চরাঞ্চলের জমি শীতকাল ছাড়া অন্যান্য সময় পানিতে তলিয়ে থাকে। তাই একাধিক বার চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু মেঘনার দুর্গম চরাঞ্চলে সমন্বিত চাষাবাদ করছেন একজন উদ্যোক্তা। তাকে দেখে উৎসাহিত হচ্ছে অনেক মানুষ, এবং আশপাশে অনেকে গড়ে তুলছেন খামার। এভাবে পরিকল্পিত কৃষিকাজে সুজলা-সুফলা হয়ে উঠছে ওই এলাকা।
তিনি আরো বলেন, আমরা তার এই কাজে পরামর্শ দান ও সহায়তা করেছি। জায়গাটি অত্যন্ত দুর্গম হওয়ায় এবং আমাদের প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় হয়তো কিছুটা ঘাটতি থাকতে পারে। তবে ভবিষ্যতে আরো বেশি সহায়তার চেষ্টা করবো আমরা।