বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৫১ পূর্বাহ্ন
মোহাম্মদ এবাদুল করিম বুলবুল ।। কালের খবর :
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে এ পূর্ব বাংলার সচেতন জনগণ অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে মুসলিম লীগের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছিল। অবিভক্ত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভৌগোলিক অবস্থান, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জাতিগত অস্তিত্বকে অস্বীকার করে পশ্চিমা মুসলিম লীগের শাসকগোষ্ঠী শুধু ধর্মকে পুঁজি করে জাতিগত বৈষম্য সৃষ্টি করে পূর্ব বাংলার জনগণকে দাবিয়ে রেখে অস্তিত্বহীন এক জাতিতে পরিণত করতে চেয়েছিল।
হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতি কখনোই সাম্প্রদায়িক ছিল না। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মাবলম্বী একই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিমণ্ডলে প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করেছে। বাঙালি জাতির মননে তাদের সম্মিলিত জীবনচর্চায় ধর্ম কখনোই অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়নি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত পশ্চিমাদের শোষণ, নির্যাতন, অবহেলা, বঞ্চনা ও জাতিগত বৈষম্যের শিকার হয়ে পূর্ব বাংলার জনগণ গর্জে ওঠে আন্দোলন-সংগ্রামে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির মুক্তির দিশারি হয়ে কল্যাণকারী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে দীর্ঘ ২৩ বছর বাংলার সব অলিগলি, রাজপথ ঘুরে এক মরুতৃষ্ণায় সব ধর্মের-বর্ণের জাতিগোষ্ঠীর নেতাকর্মী ও জনসাধারণকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলমন্ত্রের এক রাখিবন্ধনে আবদ্ধ করে জাতীয় ঐক্যের মোহনায় মিলিত করেছেন।
জীবনের ১৪টি বছর জেল খেটেছেন, দুবার ফাঁসির মঞ্চে গেছেন, কিন্তু গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে দাঁড়াননি। বাঙালির ভাষাকে কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ হিসেবেই ১৯৫২ সালে রক্তাক্ত রূপ নেয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফার আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন। সর্বোপরি জাতির জনকের ৭ই মার্চের কালজয়ী ভাষণ। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালির মুক্তির আন্দোলন-সংগ্রাম ধাপে ধাপে বিকশিত হয়েছে।
এসব আন্দোলনের পেছনে কাজ করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণা। কাজ করেছে শোষণহীন সমাজের অঙ্গীকার। কাজ করেছে সামরিকতন্ত্রের প্রতি ঘৃণা ও গণতান্ত্রিক সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। ১৯৭০ সালে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠের ম্যান্ডেট নিয়ে একটি সাংবিধানিকভাবে বৈধ, কিন্তু সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অধুনা পৃথিবীর মানচিত্র বদলে দেওয়ার বঙ্গবন্ধুর যে কৃতিত্ব তা সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে এক ও অদ্বিতীয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে রংধনুর সাতরঙে অফুরন্ত জীবন ফোয়ারা ফুটিয়ে উজ্জ্বল বর্ণিল কালপর্বে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের এক অনবদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করে অসাম্প্রদায়িক মননে আভিজাত্যের চির উন্নত মম শিরে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উত্তাল জনসমুদ্রে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে চরমপত্র ঘোষণা করেছিলেন। জাতির জনক তর্জনী আঙুল তুলে পরিষ্কারভাবে জগত্বাসীর কাছে প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁর প্রত্যয়দৃঢ় কণ্ঠে সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। ’ বঙ্গবন্ধুর ১৯ মিনিটের এ ভাষণে এত কুশলী শব্দচয়ন, এত অনন্যসাধারণ প্রত্যয়দৃঢ় উচ্চারণ স্বাধীনতা ও গেরিলাযুদ্ধের এমন স্পষ্ট দিকনির্দেশনা, এটিই ছিল মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা এবং পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত সূর্যকে ছিনিয়ে আনার জন্য প্রদর্শিত রণকৌশল। এই একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত করে একই মোহনায় এক কাতারে দাঁড় করিয়েছেন। এই একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বাঙালি জাতিতে রূপান্তরিত করেছেন। এই একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। আমরা আজ একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন পতাকার মালিক।
‘বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু’ ইতিহাসে সমার্থক শব্দ হয়ে আছে। জাতি তাঁকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকদের হাতে লুপ্ত হওয়া বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি এই দুটি নামের পুনরুদ্ধার এবং বাঙালির জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দ্বারা তিনি হয়েছেন জাতির পিতা। বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নামের সঙ্গে দুটি কথাই যোগ করেছে, জাতির পিতা এবং বঙ্গবন্ধু।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি বাঙালি জাতির জনক, স্বাধীনতার মহানায়ক, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বাধীনতার স্থপতি। বঙ্গবন্ধুকে এখনো দেশের না ভেবে একটি দলের বঙ্গবন্ধু হিসেবে ভাবা হয়। এই মনোভাব থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। দিতে হবে সর্বোচ্চ সম্মান। বঙ্গবন্ধু সম্মান পেলে বাংলাদেশ সম্মানিত হবে। তখন বহির্বিশ্বও বাংলাদেশকে সম্মানিত জাতি হিসেবে ভাবতে শুরু করবে। ‘রাজনীতি যার যার, বঙ্গবন্ধু সবার’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ু্ল শেখ মুজিবুর রহমান মহাত্মা গান্ধী বা নেহরুর মতো ফ্যাসিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করতেন। রাজনীতির আদর্শের মডেল হিসেবে জাতির মহত্তম নেতা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, কৃষকের বন্ধু শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ও আদর্শ এবং তাঁদের সাহচর্য পেয়ে আপাদমস্তক সৎ, নির্লোভ, নিরাবরণ, সাদামাটা জীবন নিয়ে প্রখর ব্যক্তিত্ব, অমিত সাহসী কর্মী ও মানুষের প্রতি অগাধ প্রেম, দেশপ্রেমের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি লক্ষ্য অর্জনে অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায় সাধকের মতো বাঘা বাঘা নেতাদের ভেতর দিয়ে নিজেকে মানুষের গভীর আস্থা, বিশ্বাস ও হৃদয় নিঃসৃত ভালোবাসা অর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি বারবার বলেছেন, ‘মহৎ কিছু অর্জনের জন্য মহান ত্যাগের প্রয়োজন’। ত্যাগ থেকে পরম শান্তি লাভ হয়, সর্ববিষয়ে সমত্ব বুদ্ধি জন্মে। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন সততার আদর্শ, সততা মানুষের বড় সম্পদ। মানুষের ভালোবাসা পেতে হলে সৎ হতে হবে। মানুষকে ভালোবাসতে হবে, মানুষের কাছে যেতে হবে, মাটির কাছে থাকতে হবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের কালজয়ী ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্বের শোষিত, নির্যাতিত ও পরাধীন মানুষের পূর্ণাঙ্গ মুজিব নির্দেশনা। যে কারণে ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিতে গিয়ে ইউনেসকো বলেছে যে, এই ভাষণটির একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর সর্বজনীনতা আর মানবিকতা। যেকোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য এই ভাষণটি সব সময়ই আবেদন সৃষ্টিকারী। এই ভাষণটি জাতিসংঘের (ইউনেসকোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভের অসামান্য অর্জন) স্বীকৃতি লাভ আমাদের জাতির জন্য একটি অনন্যসাধারণ সম্মাননা। রেসকোর্স ময়দানে উত্তাল জনসমুদ্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিলে স্বীকৃতি দিয়ে ইউনেসকো বুঝিয়ে দিল শেখ মুজিব শুধু বাংলাদেশের নন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ারও নন, গোটা বিশ্বের মুক্তিকামী, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী শক্তির আরেক মহানায়ক। এ স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বকে আন্তর্জাতিকভাবে ভিন্নমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। আজ বিশ্বের কাছে মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব, আমাদের অহংকার। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ববাসী পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে। আমরা বিশ্বের কাছে বাঙালি জাতি হিসেবে গর্বিত। তিনি চলনে-বলনে আচার-আচরণে সত্যিই ছিলেন একজন মহামানব।
লেখক : আওয়ামী কৃষক লীগ নেতা, সংসদ সদস্য ও তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য
ebadul@beaconpharma.com.bd