সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:০৬ অপরাহ্ন
২)০১৭ সালের ২১ আগস্ট আব্বা না ফেরার দেশে চলে গেলেন। বিশেষ কোনো দিনে নয়, সবসময় তাকে মিস করি। তারপরও আজ বাবা দিবস। এই দিনকে ঘিরে রয়েছে অনেক স্মৃতি। বাবা দিবসে আব্বার জন্য ফুল নিয়ে আসতাম। সর্বশেষ বাবা দিবসে আমরা একটা এলইডি টিভি কিনে দিয়েছিলাম। অনেক সময় মোবাইল কিনে দিতাম। তার মোবাইলের শখ ছিল।
২০১৫ সালে রমজানে আব্বাকে ডাক্তার বলেছিল- রোজা রাখা যাবে না। এরপরও জোর করে তিনি রাখলেন। জুমার নামাজ পড়ে বাসায় ফেরার পর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখনও বললাম, আপনার শরীর খারাপ লাগছে, আপনি রোজা ভেঙে ফেলেন। তিনি বললেন, আমি পারব না। ইফতার করার পর তিনি আরো অসুস্থ হলেন। আমরাও সেদিন ইফতার করতে পারিনি। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। এতটাই বাজে অবস্থা হলো যে, আব্বাকে আইসিইউতে নিতে হলো। আব্বা কোমায় চলে গেলেন। ১৭ দিন তিনি একটানা সমস্যায় ছিলেন। এর ফাঁকে মাঝে মাঝে তার জ্ঞান ফিরত। ইশারায় কথা বলতেন। আমরা জিজ্ঞেস করতাম- কষ্ট হচ্ছে?
তখন তার চোখ দিয়ে পানি ঝরত আর মাথা নাড়তেন। বলতে চাইতেন- কষ্ট হচ্ছে। সেবার আব্বা সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার পর মাঝখানে ঘটে যাওয়া সবকিছু ভুলে গিয়েছিলেন। প্রায়ই বলতেন, গাড়ি বের করো, এফডিসিতে যাব। নয়টায় যেতে হবে, শুটিং আছে। আমরা যেতে না দিলে খুব জেদ করতেন। বলতেন, এফডিসিতে আমার কাজ আছে। একবার ঈদের সময় খুব জেদ করল- সিগারেট খাবে। মামাকে বলল, সিগারেট দাও। মামা না দিতে চাইলে তাকে লাঠি দিয়ে তাড়া করল। এরপর আমাদের বলল, সিগারেট দিবি, না হলে বাড়ি ভেঙে ফেলব। বাচ্চাদের মতো করতেন। তখন ভাইয়া বললেন, আপনি যদি সিগারেট খান, তা হলে আপনার ছেলেরাও আজ সিগারেট খাবে। আপনার কোনো ছেলে সিগারেট খায় না। এই বলে ভাইয়া সিগারেট এনে আব্বা এবং আমাদের হাতে দিলো। বাবা সিগারেট হাতের মুঠোয় চাপ দিয়ে ভেঙে ফেলে দিলেন। এরপর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সিগারেট ছুঁয়েও দেখেননি।
ড্রাইভারকে আমরা বলে রাখতাম, আব্বা এফডিসিতে যেতে চাইলে গুলশান ঘুরে বাসায় নিয়ে আসতে। বাসায় আসতে আসতে বাবা সব ভুলে যেতেন। প্রায়ই বলতেন- আমি কি আর কাজ করতে পারব? অনেক কাজ করতে চাইতেন। এজন্যই আমি বাবাকে নিয়ে নাটক বানিয়েছিলাম। ‘দায়ভার’ নাটকে বাবা অভিনয় করেছেন। দুদিনের কাজ কষ্ট করে চারদিন বসে করেছি। শুটিংয়ে গিয়ে ডলি জহুর আন্টির সঙ্গে কথা বলেছেন। শুটিং ইউনিটের সবার সঙ্গে মন খুলে কথা বলার কারণে আব্বা মানসিকভাবে অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। তিন বছর পর্যন্ত আব্বা কোথাও যেতেন না। ২২ আগস্ট তিনি চলে গেলেন চিরতরে। এর এক মাস আগে ফ্যামিলি ট্যুরে আমরা থাইল্যান্ড যাই। তখনই আব্বার মধ্যে একটা পরিবর্তন খেয়াল করলাম।
আব্বা আমাদের মাথার উপরে ছায়া হয়ে ছিলেন। এখনও তার আদর্শের উপরই আছি। যেকোনো বিষয় আব্বাকে জিজ্ঞেস করতাম। তিনি একটা সমাধান দিতেন। এগুলো আমরা মিস করি। আব্বা থাকলে যেটা হতো- আব্বা বলতেন- বসে আছিস, চল একটা প্রোডাকশন করি।
মেয়র আনিসুল হক অসুস্থ হয়ে লন্ডনে যখন চিকিৎসাধীন ছিলেন তখন বাবা আমাকে বলেছিলেন, উনার পরিবারের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলে বল- আমি তার জন্য দোয়া করেছি। এই যে আন্তরিকতা; সবার জন্য আব্বার দরদ ছিল। এগুলো আব্বার কাছ থেকে শিখতাম। এখন খুব মিস করি। রমজান মাস এলে আব্বাকে খুব বেশি মিস করি। কারণ তখন আব্বা নিজে বাজার করতেন। মাগরিবের নামাজ আমাদের সকলকে নিয়ে জামাতে পড়তেন। রমজানে বিভিন্ন মানুষ আসতেন। আব্বা কাউকে খালি হাতে ফেরাতেন না।
চলচ্চিত্রে আমার শুরুটা আব্বার মাধ্যমে। আমি তার সঙ্গে মাত্র চারটা সিনেমায় কাজ করেছি। তার কাছ থেকে শিখেছি। আমার পরিচালনা শেখা তার কাছ থেকে। আমার পরিচালনার পরের দিকের কাজগুলো আব্বা দেখতে পেলেন না। দেখলে হয়তো অনেক বেশি খুশি হতেন। আব্বার জন্য দোয়া ও প্রার্থনা করছি। আর আমি যেন তার মতো আদর্শবান হতে পারি।
শ্রুতিলিখন: