সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৫ পূর্বাহ্ন
হাসান মাহমুদ রিপন,কালের খবর :
জন্মগত ত্রুটি নিয়ে ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। পরিবেশ দূষণ, ভেজাল খাদ্য, না জেনে ওষুধ গ্রহণ ও বেশি বয়সে গর্ভধারণসহ নানা বিষয়ই এর মূল কারণ। স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাবে, প্রতি ঘণ্টায় নানা ত্রুটি নিয়ে জন্ম নিচ্ছে অন্তত ৩৬ শিশু। চিকিৎসকরা বলছেন জন্মের আগেই এ ধরনের সমস্যার ৯০ ভাগ প্রতিরোধ সম্ভব। কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় শিশুমৃত্যুর সঙ্গে বাড়ছে প্রতিবন্ধিতার হারও।
জানা গেছে, বর্তমানে শিশুমৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ জন্মত্রুটি। এই হার দুই শতাংশ থেকে বেড়ে দশ হলেও তা প্রতিরোধে নেই বড় কোনো উদ্যোগ। শিশুর জন্মগত ত্রুটি এড়াতে নারীদের ৩৫ বছরের আগেই সন্তান ধারণ, স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের (বিএসএমএমইউ) প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিম কাজল বলেন, সন্তান নেয়ার পূর্বে চিকিৎসকের কাছে যাবেন। তাহলে চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানবেন মায়ের শরীরে কোনো সমস্যা আছে কি না। আর গর্ভধারণের ৩ মাসের মধ্যেই এই ত্রুটি শনাক্ত করা সম্ভব।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে, ব্রেন ও হার্টের সমস্যাসহ নানা ধরনের শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে শতাধিক শিশু। চিকিৎসকদের মতে এর পেছনে রয়েছে পরিবেশ দূষণ, ভেজাল খাদ্য, গর্ভাবস্থায় না জেনে ওষুধ গ্রহণসহ নানা কারণ।
রাজধানীর পুরান ঢাকা এলাকার বাসিন্দা আল-আমিন। বয়স আনুমানিক বারো বছর। নিজে অন্য সবার মতো স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না। এমনকি মায়ের সাহায্য ছাড়া বলতে পারে না নিজের নামও। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতার শিকার এই কিশোরকে নিয়ে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে তার মায়ের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের এই বিশেষ (মহিলা ও শিশু) ওয়ার্ডে গত বছর ভর্তি ৭০৫ প্রসূতির মধ্যে ১২৫ জনের শিশুই শিকার হয় জন্মগত ত্রুটির। চিকিৎসকরা বলছেন, গর্ভধারণের তিন মাসের মধ্যেই এই ত্রুটি শনাক্ত করা সম্ভব। চিকিৎসকদের মতে, দ্রুত শনাক্ত করা গেলে জন্মগত কিছু ত্রুটি ভালো করা সম্ভব। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসা খরচ বেশি হওয়ায় নিঃস্ব হয়ে যায় অনেক পরিবার। তাই জন্মত্রুটি প্রতিরোধে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
জন্মগত ত্রুটি পর্যবেক্ষণ প্রকল্প পরিচালক ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেন, সচেতনা, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি করতে পারলে জন্মগত ত্রুটি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের (এটি সরকারের পক্ষ থেকে পরিবেশ দূষণ কমিয়ে আনার জন্য কাজ করছে) পরিচালক নাসির উদ্দীন জানান, পরিবেশ দূষণের ফলে শিশু, বৃদ্ধ এবং হৃদরোগীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, শীতকালে পরিবেশ দূষণের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। যার ফলে ওই সময়ে পরিবেশ দূষণের নেতিবাচক প্রভাব আরো প্রকট আকার ধারণ করে।
সম্প্রতি ইঁদুরের ওপর করা এক গবেষণায় থেকে জানা যায়, গর্ভাবস্থায় পরিবেশ (বায়ু) দূষণের মাঝে থাকলে প্রিম্যাচিউর বার্থ এবং জন্মের সময়ে ওজন কম হতে পারে। এ সময়ে ইঁদুরগুলো এমন বায়ুতে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল যাতে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো কণিকা ছিল, যা কিনা পরিবেশ দূষিত এলাকাগুলোর মতোই। গবেষণায়, গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে বায়ু দূষণের মাঝে থাকলে প্রিম্যাচিউর বার্থের ঝুঁকি থাকে ৮৩ শতাংশ। পরের দিকে বায়ু দূষণের কারণে ৫০ শতাংশ ইঁদুর শিশুর ওজন কমে ১১ শতাংশেরও বেশি।
গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর যে বিষয়গুলো প্রভাব ফেলে তার মধ্যে পুষ্টির পরই পরিবেশের অবস্থান। তবুও ঢাকা শহরের পরিবেশ উন্নয়নের ব্যাপারে সরকারের নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই।
তিনি জানান, শব্দ ও বায়ু দূষণের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে মানুষ সরাসরি আক্রান্ত হয়। এর পাশাপশি ঢাকা শহরের পরিত্যক্ত ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার ক্ষেত্রে ঢাকাবাসী সুষ্ঠুভাবে তাদের দায়িত্ব পালন না করায়ও পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। ঢাকা শহরকে ময়লা-আবর্জনামুক্ত রাখতে হলে জনগণের পাশাপাশি সরকারেরও ভূমিকা পালন করতে হবে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ঢাকার পরিবেশ রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পার্ক এবং খেলার মাঠ থাকা খুবই প্রয়োজন। উন্মুক্ত পরিবেশের অভাবে ঢাকা শহরে মাদকাসক্তের পরিমাণ বাড়ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
তিনি মনে করেন, পার্কের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে কোনো রিয়েল স্টেট প্রতিষ্ঠানকে ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়া উচিত নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ু দূষণবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, বাংলাদেশে বায়ু দূষণের মোট পরিমাণ চীন ও ভারতের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তবে বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে দ্রুত বায়ু দূষণ বাড়ছে, তার মধ্যে অবশ্যই বাংলাদেশ প্রথম সারিতে থাকবে।
তিনি বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশে যে নির্মাণ কাজ হচ্ছে, তাতে প্রচুর ধুলা ও ধোঁয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে বাতাসে ওই ক্ষুদ্র কণাগুলো এমনিতেই বেশি পরিমাণে পরিবাহিত হয়। আর এই সময়ে বেশি নির্মাণ কাজ চলায় এবং সব ক’টি ইটভাটা চালু থাকায় দূষণের পরিমাণ বেড়ে যায়।
পরিবেশ অধিদফতরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে যে নির্মাণ কাজগুলো হচ্ছে, তাতে সকাল ও বিকেল দুই বেলা নির্মাণসামগ্রী, বিশেষ করে বালু, ইট ও পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু রাজধানীর বেশিরভাগ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র ফেলে রেখে ধুলা সৃষ্টি করছে।
কালের খবর -/৩/৪/১৮