সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৯ পূর্বাহ্ন
মুরাদনগর (কুমিল্লা) প্রতিনিধি, কালের খবর :
মুখে একগাল দাঁড়ি। গায়ে থাকে সাদা রংয়ের পাঞ্জাবি।
তাকে দেখলে ধর্মপ্রাণ মুসল্লি বলেই মনে হবে। তিন একর জমির ওপর তার বাড়ি। চারপাশে দেয়াল। তার মধ্যে বড় বড় বিল্ডিং দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক কোনো শিল্পপতির বাড়ি। কিন্তু তিনি এ অঞ্চলের মাদক সম্রাট।
ভদ্রতার মুখোশ পরা মাদক সম্রাট আ. মোমেন পাঁচ থানায় কুড়িখানেক মামলার আসামি হয়েও মাদক ব্যবসা করে ইতিমধ্যে কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। নিজ বাড়িতে বসে মাদক ব্যবসা করেও পুলিশের নাগালের বাইরে ছিলেন মোমেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে বিজিবি সদস্য তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মাদকসহ তাকে আটক করে।
আটক মাদক সম্রাট মোমেন মিয়া (৬৫) কুমিল্লা জেলার বাঙ্গরা বাজার থানার ১২ নং রামচন্দ্রপুর উত্তর ইউনিয়নের আমিননগর গ্রামের মৃত আবদু মিয়ার ছেলে।
জানা যায়, দীর্ঘদিন মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত মোমেনের ছেলে সজলও তার ব্যবসার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। বাবা ছেলে মিলে মুরাদনগর, বাঙ্গরা বাজার, নবীনগর, হোমনা, বাঞ্চারামপুর ও দেবিদ্বার থানায় মাদক সরবরাহ করেন। ওই থানার ওসিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মোমেন ও তার ছেলে সজলের বিরুদ্ধে ২০টিরও বেশি মামলা রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে একদল বাংলাদেশ বডার গার্ড (বিজিবি) সদস্য মোমেনের বাড়ি চারদিক থেকে ঘিরে তাকে আটক করতে সক্ষম হয়। মোমেনের বাড়ি থেকে ২৪০ বোতল ফেনসিডিল, ২৬ কেজি গাঁজা, ৩,৩০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ও মাদক বিক্রির নগদ দুই লক্ষ এগারো হাজার ছয়শ টাকা উদ্ধার করা হয়। বিজিবি সদস্যরা তাকে আটক করে বাঙ্গরা বাজার থানায় হস্থান্তর করে। বাঙ্গরা বাজার থানার ওসি মনোয়ার হোসেন গতকাল শুক্রবার মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ করে মোমেন মিয়াকে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ অঞ্চলের মানুষ রামচন্দ্রপুর বাজারে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। কারণ রামচন্দ্রপুর বাজার থেকে নৌপথে ঢাকায় লঞ্চ যাতায়াত করে। ঢাকা থেকে ব্যবসায়ী মালামাল আনা-নেওয়ার সুবিধা থাকায় এই অঞ্চলের একটি বড় ব্যবসায়ী জোন রামচন্দ্রপুর বাজার। কিন্তু বর্তমানে বেশ কয়েকটি মাদকের স্পট গড়ে ওঠায় ব্যবসায়ীরা ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাদকের স্পটগুলো নির্মূল করতে পারলে রামচন্দ্রপুর বাজার স্বরুপে ফিরবে।
রামচন্দ্রপুর ছাড়াও মুরাদনগরে বিভিন্ন স্থানে অবাধে চলছে মাদকের ব্যবসা। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবসালী দলের নেতার ছত্রছায়ায় উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মদ, গাঁজা, ফেন্সিডিল ও ইয়াবা ব্যবসা চলছে রমরমা। পুলিশ মাদকসহ কারবারিদের গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠালেও জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার মাদক বিক্রি শুরু করে।
মদ
মুরাদনগর সদরে সরকারি হাই স্কুলের পাশে মুচিবাড়িতে বাংলামদ বিক্রি হচ্ছে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে। থানা থেকে আড়াইশ গজ দূরে অবস্থিত এই স্পটটি মুচিবাড়ির মুচিদের জন্য মদ তৈরি হলেও এই স্পট থেকে দেদারছে গ্যালনে গ্যালনে মদ নিচ্ছে মাদকসেবীরা। মুরাদনগরের সদরসহ উপজেলার দক্ষিণ অঞ্চলের ৭ ইউনিয়নে মদ যায় এই স্পট থেকে।
অপরদিকে, রামচন্দ্রপুর বাজারে রয়েছে বিশাল দুটি স্পট। একটি স্পটের মালিক হচ্ছেন সুকলা। তার বাড়ি ছাগল কাজারের সাথে। আরেকটি স্পট জাপানী বাড়ি নামে পরিচিত। এটাও রামচন্দ্রপুর বাজারের পাশে। এ দুই স্পট থেকে রামচন্দ্রপুর তথা হোমনা, বাঞ্চারামপুর ও নবীনগর থানায় যাচ্ছে বাংলামদ।
এ ছাড়াও নবীপুর পশ্চিম ইউপির শিবানীপুর গ্রামে রয়েছে একটি স্পট। এখান থেকে মুরাদনগরের উত্তর পূর্ব অঞ্চলসহ দেবিদ্বার থানা থেকে এসে মাদক সেবন করছে এবং সুযোগ বুঝে বহন করে নিয়েও যাচ্ছে মাদকসেবীরা।
ফেন্সিডিল
সদর থেকে ৫টাকা অটোরিক্সা ভাড়া লাগে নবীপুর বাজারে যেতে। কোম্পানীগঞ্জ রোডে রাস্তার পাশে ওই বাজারের পিছনে শাহিন নামের এক মাদক ব্যবসায়ী ফেন্সিডিল বিক্রি করছেন। বিকাল হলেই ঝাঁকে ঝাঁকে মোটরসাইকেলযোগে এই স্পটে পাশ্ববর্তি থানা হোমনা ও দেবিদ্বারের মাদকসেবীরা চলে আসেন। মাদকসেবীরা শাহিনকে ছদ্মনামে ডাক্তার আর ফেন্সিডিলকে ঔষধ হিসাবে ডাকেন। ইতিমধ্যে শাহিন একাধিকবার ডিবি পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও ছাড়া পেয়ে আবার চালিয়ে যাচ্ছেন মাদকের রমরমা ব্যবসা। এ ছাড়াও কোম্পানীগঞ্জ বাস ষ্টেশনের পিছনেও একটি স্পট আছে বলেও সূত্র জানায়।
ইয়াবা
কোম্পানীগঞ্জ বাজারের আওয়ামী লীগ নেতার ভাই, দারোরা নয়াকান্দির জালাল এবং রামচন্দ্রপর বাজারের সায়েম ইয়াবার মূল হোতা। তারা রামচন্দ্রপুর তথা মুরাদনগর, বাঙ্গরা বাজার, হোমনা, বাঞ্চারামপুর, নবীনগর ও দেবিদ্বার থানার ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারি সরবরাহ দেন। তারা ইয়াবা হোম ডেলিভারিও দিয়ে থাকেন বিকাশের মাধ্যমে আগে টাকা পেলে। তা ছাড়া উপজেলার নবীপুর পূর্ব ও পশ্চিম, বাঙ্গরা, মেটংঘর, আন্দিকোর্ট, দারোরা, শ্রীকাইল, জাহাপুর, ছালিয়াকান্দি, পাহাড়পুর, পূর্বধইর পূর্ব ও পশ্চিম, আকবপুর, রামচন্দ্রপুর উত্তর ও দক্ষিণ ইউনিয়নগুলোতে হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ১৩০-১৪০ জন কারবারি এই মরণনেশা মাদক বিক্রি করছেন। মোটরসাইকেল নিয়ে মাদকাসক্তরা হাজির হয় এসব স্থানে। দেশের সীমান্ত কাছে থাকায় মাদক কারবারিরা সহসায় ইয়াবা ও ফেন্সিডিল বিভিন্ন উপায়ে এনে ব্যবসা করে যাচ্ছেন দিব্যি।
স্থায়ী বাসিন্দারা বলছেন, কিছু ধনী পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান ও গরিব পরিবার থেকে রাজনৈতিক দলের ক্যাডার হয়ে উঠে আসা বখাটে ছেলেরাই মূলত ওই মাদক সেবন ও খুচরা বিক্রি করছে। মাদকের মূল ব্যবসায়ীরাও কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মী। সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়ায় প্রত্যেক এলাকাতেই খুচরা বিক্রেতা বেশ দাপটের সঙ্গে এই মরণনেশার ব্যবসা চালাচ্ছে। ফলে, এখানে মাদকসেবীর সংখ্যা ও সামাজিক অবক্ষয় দিন দিন বাড়ছে। মাদকসেবীরা মাদক কেনার জন্য চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মাদকের স্পট থেকে থানার ক্যাশিয়ার ও কিছু সাংবাদিক মাস শেষে মোটা সুবিধা গ্রহণ করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার ওসি মনোয়ার হোসেন ও মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি আরজু মিয়া বলেন, মাদকের বিষয়ে কোনো আপোস নেই। প্রতিদিনই মাদকসহ কেউ না কেউ আটক হচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছি।