সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৯ পূর্বাহ্ন
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি, কালের খবর :
ঘিওর, দৌলতপুর ও শিবালয় উপজেলা নিয়ে মানিকগঞ্জ-১ সংসদীয় আসন গঠিত। এর আগে ঘিওর ও দৌলতপুর উপজেলা এই আসনটির আওতায় ছিল।
২০০৮ সালে আসনটি বিএনপির কাছ থেকে পুনরুদ্ধারের পর এখন পর্যন্ত দখলে রেখেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় এ দুটি বড় দলের মধ্যেই। আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক কমিটি রয়েছে। কিন্তু তিনটি উপজেলাতেই নেতাদের মধ্যে রয়েছে বড় ধরনের বিভক্তি।
জানা গেছে, বর্তমান সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয়, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম, যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাংঠনিক সম্পাদক এস এম জাহিদের নেতৃত্বে তিনটি গ্রুপ রয়েছে। এ ছাড়া সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল হকের একটি গ্রুপ নীরবে সক্রিয় রয়েছে। তাঁরা সবাই আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী।
অন্যদিকে সাংগঠনিকভাবে অগোছালো বিএনপিতেও মনোনয়ন নিয়ে রয়েছে বিভক্তি। এই আসন থেকে পাঁচবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য বিএনপির সাবেক মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন।
তিনি জীবিত থাকলে এই আসনে অন্য কেউ বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে বিএনপিতে বড় ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। সেই শূন্যতা পূরণ করতে তাঁর দুই ছেলে তৎপর। কিন্তু খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে ছাড় দিলেও তাঁর ছেলেদের ছাড় দিতে রাজি নয় বর্তমান প্রজন্মের নেতৃত্ব। যে কারণে এই আসনে আরো অন্তত তিনজন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত মানিকগঞ্জে জাতীয় সংসদের আসন ছিল চারটি। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে চারটি আসনেই জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এই চারটি আসনের কোনোটিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিততে পারেননি। জাতীয় পার্টি কিংবা বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। ১৯৯১-এর নির্বাচন থেকে ২০০১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত সব আসনই ছিল বিএনপির। ২০০৮ সালের নির্বাচনে একটি আসন কমে মানিকগঞ্জের আসন হয় তিনটি। ওই নির্বাচনে বিএনপিকে পরাজিত করে মানিকগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের আনোয়ারুল হক ও মানিকগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের জাহিদ মালেক স্বপন বিজীয় হন। মানিকগঞ্জ-২ আসনটি পান এরশাদের জাতীয় পার্টির প্রার্থী আব্দুল মান্নান। সেবার এই আসনে আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থী না দিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে সমর্থন দেয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনটি আসনের মধ্যে মানিকগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম ও মানিকগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহিদ মালেক স্বপন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। মানিকগঞ্জ-১ আসনে জাসদের প্রার্থীকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের এ এম নাঈমুর রহমান দুর্জয়।
আওয়ামী লীগ : নবম সংসদ নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-১ আসনটি আওয়ামী লীগ পুনরুদ্ধার করতে পারে, এমন একজনের হাত ধরে যিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোনো নেতা ছিলেন না। সেবার সবাইকে অবাক করে সড়ক ও জনপথের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী আনোয়ারুল হককে মনোনয়ন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। স্থানীয় নেতাদের ক্রমাগত ব্যর্থতার কারণেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তকে যথার্থ প্রমাণ করে আনোয়ারুল হক জয়লাভ করেছিলেন পাঁচবারের সংসদ সদস্য বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে। তবে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে আনোয়ারুল হক মনোনয়ন থেকে ছিটকে পড়েন। আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয় জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়কে।
দুর্জয়ের পুরো পরিবারই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁর বাবা ১৯৭৩ সালে এই আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, মা জেলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী দীর্ঘদিন ধরে। তবে খেলাধুলার জন্য তিনি কখনোই সরাসরি রাজনীতির মাঠে ছিলেন না। তাই বয়সে তরুণ দুর্জয়কে মনোনয়ন দেওয়াটাও ছিল একটা চমক। সিদ্ধান্তটি যে সঠিক ছিল, তা প্রমাণ করে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) প্রার্থী ঘিওর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আফজাল হোসেন জকিকে পরাজিত করেন বিপুল ভোটে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনেও নাঈমুর রহমান দুর্জয় এই আসনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। তাঁর সময়কালে এলাকায় রাস্তাঘাট, সেতু, নদী শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। গড়ে উঠেছে বেশ কিছু অবকাঠামো। এ ছাড়া একটি আন্তর্জাতিকমানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আস্থাভাজন ও স্নেহের ব্যক্তি হিসেবে এসব প্রতিশ্রুতি আদায়ে সমর্থ হয়েছেন দুর্জয়। শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, সেটা কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। তা ছাড়া তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের কারণে এলকায় রয়েছে বিশেষ ভাবমূর্তি।
অবশ্য স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুর্জয়ের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম, যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম জাহিদ, সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল হক ও মানিকগঞ্জ পৌরসভার কাউন্সিলর সুভাষ সরকার। তাঁরা সবাই মনোনয়নপ্রত্যাশী।
আব্দুস সালাম আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত নেতা। ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগে আসা এই নেতা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন। দলের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও তিনি সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এলাকায় তাঁর ব্যাপক পরিচিতি আছে। গত ২০০১ সালে এই আসনে তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। বিএনপির প্রার্থী খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত তরুণ আব্দুস সালাম ভালোই লড়াই করে পরাজিত হন। তবে সময়ের আবর্তে তিনি এখন অনেক বেশি অভিজ্ঞ এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা মনে করেন।
মনোনয়ন চাইবেন—এমনটি নিশ্চিত করেছেন আব্দুস সালাম। তবে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, দল যাঁকেই মনোনয়ন দেবে, তাঁর পক্ষেই তিনি কাজ করবেন।
আওয়ামী লীগের সংকট মুহূর্তে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য এস এম জাহিদে বহুল আলোচিত। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ঢাকা মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। তিন বছর ধরে তিনি এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। দুই হাত খুলে ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা দিচ্ছেন এলাকার দুস্থদের। তাঁর সহায়তা পেয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে তিনি যুবক, তরুণদের আকৃষ্ট করতে পেরেছেন তাঁর ব্যক্তি ভাবমূর্তি দিয়ে।
এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল হকও এবার মনোনয়নপ্রত্যাশী। সংসদ সদস্য থাকার সময় এলাকায় বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করায় তাঁর রয়েছে পরিচিতি। বিশেষ করে দৌলতপুর ও শিবালয় উপজেলার কয়েকটি চরাঞ্চলের ইউনিয়নে রয়েছে তাঁর রয়েছে ব্যাপক প্রভাব। তিনিও চরাঞ্চলের লোক হওয়ায় আঞ্চলিকতার টানে তাঁকেই পছন্দ করে ওই সব ইউনিয়নের লোকজন।
মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুভাষ সরকারও এবার এই আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী। এলাকার মানুষদের সাহায্য-সহায়তা দিয়ে আসছেন নিয়মিত। সম্প্রতি মধ্যস্থতা করে শিবালয়ের চরাঞ্চলের কয়েক ডাকাতকে আত্মসমর্পণ করিয়ে আলোচনায় আসেন সুভাষ। আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক রয়েছে।
বিএনপি : এই আসনে বিএনপির পাঁচবারের সংসদ সদস্য প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের শূন্যতা পূরণ করতে তাঁর দুই ছেলে ড. খোন্দকার আকবর হোসেন বাবলু ও অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ ডাবলু মনোনয়নপ্রত্যাশী। খোন্দকার দেলোয়ারের প্রতি সন্মান দেখিয়ে এবং তাঁর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে এই আসনে তাঁর পরিবারের কাউকে বিএনপি মনোনয়ন দেবে, এমনটাই শোনা যাচ্ছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে কে মনোনয়ন পাবেন, সেটা নিশ্চিত নয়। দুই ভাই মাঠে আছেন। মনোনয়ন নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যেও রয়েছে মতপার্থক্য।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন জীবিত থাকতে আব্দুল হামিদ ডাবলু বাবার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে মাঠে থাকতেন। যে কারণে নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। অন্যদিকে আকবর হোসেন বাবলু পরে রাজনীতিতে এলেও এখন সক্রিয়। তিনিও নিজস্ব একটি বলয় সৃষ্টি করতে পেরেছেন। তবে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছেন দলের জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য এস এ জিন্না কবির। বিএনপির প্রতিষ্ঠার সময় থেকে ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। মানিকগঞ্জে ছাত্রদল গঠনে তাঁর ভূমিকা ছিল। বর্তমানে সাংগঠনিকভাবে অগোছালো এবং বিভক্ত জেলা বিএনপির নেতদের মধ্যে একমাত্র তিনিই নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের পছন্দের তালিকায়ও স্থান করে নিতে পেরেছেন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের কারণে। তিন বছর ধরেই তিনি পরিকল্পিতভাবে এলাকায় জনসংযোগ করে আসছেন।
এস এ জিন্না কবির বলেন, ‘আমি কখনোই দলের বিরুদ্ধে কিংবা অমতে কিছু করিনি। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নেতাকর্মীদের একসঙ্গে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দলের নেতারাও আমার ভূমিকা সম্পর্কে জানেন। এর মূল্যায়ন নিশ্চয়ই তাঁরা করবেন। ’
দৌলতপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তোজাম্মেল হক তোজাও এই আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে অন্যতম। ২০০৮ সালে তিনি বিএনপির ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হয়ে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে নির্বাচন করেন। ব্যক্তি ভাবমূর্তির কারণে প্রায় ২৬ হাজার ভোট পান তিনি। এরপর দৌলতপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে তাঁর জনপ্রিয়তার প্রমাণ রাখতে পেরেছেন তোজা। একসময় জেলা ছাত্রদলের অত্যন্ত জনপ্রিয় এই নেতার তরুণ যুবকদের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। আঞ্চলিকতাও তাঁর একটি বড় পুঁজি। তিনি মনোনয়ন চাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে এই আসনে জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খানম রিতা মনোনয়ন পেলে তিনি প্রার্থী হবেন না বলে জানান।
অবশ্য আসনটি পুনরুদ্ধারে স্বয়ং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রার্থী হতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। তবে তা আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ।
জাসদ : দীর্ঘদিন ধরে বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আফজাল হোসেন জকি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশ নিয়ে তিনি রাজনীতির মাঠে একজন পরীক্ষিত নেতা হিসেবে পরিচিত। জাসদের তিনিই একমাত্র মনোনয়নপ্রত্যাশী। দলটি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলেও তিনি মনোনয়ন চাইবেন বলে নিশ্চিত করেছেন।
কালের খবর-/১/৩/১৮