রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৪১ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক : ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়কের যানজট পরিস্থিতির ক্রমে অবনতি ঘটছে। মহাসড়কে গাড়ি থামিয়ে পুলিশের চাঁদাবাজি, দুর্ঘটনা ঘটলে বা গাড়ি বিকল হলে রেকার নিয়ে গড়িমসি, মেঘনা সেতুর টোল প্লাজার অনিয়মের কারনে প্রতিনিয়ত যানজটের কবলে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট হচ্ছে। বাড়ছে ভোগান্তি।
সোমবার চার লেনের মহাসড়কের মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া অংশে ১৩ কিলোমিটার যানজট ছিল। হাইয়ে পুলিশের দাবি, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলায় লরির ধাক্কায় বাস উল্টে ১২ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল দুপুর থেকেই মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার জামালদি এলাকা সংলগ্ন মেঘনা সেতু থেকে বাউশিয়া মেঘনা-গোমতী সেতু পর্যন্ত যানজটে আটকে পড়েছিল শত শত গাড়ি। এ সময় গাড়িগুলোর গতি খুবই কম ছিল।
ভবেরচর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল ইসলাম বলেন, সোনারগাঁও অংশে দুর্ঘটনার পর থেকেই যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পেয়ে এ দীর্ঘ লাইন সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া মেঘনা সেতুর টোল প্লাজায় বাড়তি সময় লাগায় যানবাহনগুলোর গন্তব্যে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগছে বলেও জানান তিনি।
অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন হয়েছে আগেই। তবে চার লেনের এ মহাসড়কেই দুই লেনের সেতু পার হতে হচ্ছে যানবাহনকে। দুই লেনের মেঘনা সেতুর টোল আদায়ে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা হচ্ছে। এ দুইয়ে মিলে বাড়িয়ে দিচ্ছে মহাসড়কটির যানজট। শুধু মেঘনা সেতু পার হতেই একেকটি যানবাহনের ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা বাড়তি সময় লাগছে। যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ থাকলে সময় লাগছে আরো বেশি।
গতকাল সকালে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় আসা একজন যাত্রী জানান, রোববার রাত ১১টার দিকে বাসযোগে রওনা করে তিন ঘণ্টায় তিনি দাউদকান্দির কাছাকাছি চলে আসেন। অথচ ঢাকায় পৌছতে লেগে গেছে প্রায় ৯ ঘণ্টা।
তিনি জানান, রাতে মেঘনা সেতুর আগে কয়েক কিলোমিটার যানজটে আটকা পড়েন। ওই যাত্রী জানান, রাতে পুলিশ যানজট নিরসনের চেয়ে যানজট সৃষ্টির কাজই বেশি করে। প্রতিটি ট্রাক ও লরিকে থামিয়ে চালকের সাথে কথা বলে তারপর পুলিশ সেটিকে ছাড়ে। এতে করে সময় যেমন নষ্ট হয়েছে, তেমনি পেছনের দিকে যানজটও ক্রমে বেড়েছে।
নজের চোখে দেখা দুশ্যের বর্ণনা করে তিনি বলেন, যানজটের কারনে ট্রাক ও লরির চালকরা রাস্তার উপর গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে ঘুমিয়ে ছিল। কয়েক মিনিট পর দেখা গেল সামনের দিকের গাড়ি অনেক দুর চলে গেছে। তখন যাত্রীরা গাড় থেকে নেমে গিয়ে আবার সেই চালককে ঘুম থেকে জাগিয়ে গাড়ি সামনের দিকে নিতে বলেন।
এরকম দৃশ্য কয়েকটা দেখেছি উল্লেখ করে ওই ভুক্তভোগি বলেন, পুলিশ একটু সচেতন হলে এমন অবস্থা হতো না। পুলিশের গাফিলতির কারনেই মহাসড়কে এভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে হাজার হাজার যাত্রী।
জানা গেছে, চালুর পর মেঘনা সেতুতে টোলবুথ ছিল চারটি। গত বছরের ২২ জুলাই সেতুতে ডিজিটাল টোল আদায় পদ্ধতি উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। যানজট কমাতে ওইদিনই অতিরিক্ত বুথ বসানোর ঘোষণা দেন তিনি। এরপর কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে বসানো হয় আরো চারটি বুথ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে চালু হয় এসব বুথ। কিন্তু বুথ বাড়লেও দক্ষ জনবল নিয়োগ না দেয়ায় ডিজিটাল পদ্ধতির এই টোল বুথ তেমন কোনো কাজে আসছে না। শুধু তাই নয়, জনবলের অভাবে সবগুলো বুথ খুলেও রাখা হয় না। এতে করে সময় আর বেশি লাগছে।
শ্যামলী পরিবহনের চালক সোহরাব হোসেন বলেন, হাজার কোটি টাকা খরচ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন করা হয়েছে। কিন্তু এর সুফল মানুষ বোগ করতে পারছে না কিছু দুর্নীতি, অনিয়ম ও গাফিলতির কারনে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, হাইওয়ে পুলিশ ট্রাক ও লরি থামিয়ে নিজেরাই যানজটের সৃষ্টি করে। প্রতিটি ট্রাক ও লরিকে দাঁড় করিয়ে চালককে নানা প্রশ্ন করে হাতেনাতে ঘুষ নিয়ে তারপর সেগুলোকে যেতে দেয়। শত শত যাত্রীর সামনেই পুলিশ প্রকাশ্যে ঘুষ নেয়। এ ছাড়া টোল বুথেও অনেক বেশি সময় নষ্ট হয় বলে ওই চালক অভিযোগ করেন।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী গ্রীনলাইন পরিবহনের চালক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম থেকে মেঘনা সেতু আসতে সাড়ে তিন ঘণ্টাই যথেষ্ঠ। কিন্তু চার-পাঁচ কিলোমিটার যানজট পেরিয়ে সেতুতে উঠতে প্রতিনিয়ত দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। আবার সেতুর উপরে উঠেও কমবেশি ৩০ মিনিট আটকে থাকতে হয়। এ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে প্রায় নিত্যদিনই।
মহাসড়কের আরেক সেতু মেঘনা-গোমতীরও একই অবস্থা। দুই লেনের এ সেতুর দুপাশেও তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এরপর কাঁচপুর সেতুতে উঠতে গিয়ে আবারও যানজটের কবলে পড়তে হয়। সবমিলে চট্টগ্রাম থেকে মেঘনা সেতু পর্যন্ত আসতে সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগলে মেঘনা সেতু থেকে ঢাকার মতিঝিল পর্যন্ত আসতে লাগে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাঁচপুর হাইওয়ে পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, সেতুর টোলপ্লাজায় অনিয়মের কারণেই যানজট প্রতিনিয়ত তীব্র আকার ধারণ করছে। ওজন স্কেলে অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই যানবাহন থেকে অবৈধভাবে টাকা আদায় করা হচ্ছে। যেসব যানবাহনের চালক অবৈধভাবে টাকা দিতে আপত্তি জানায়, তাদের দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখা হয়। আটকে থাকা এসব যানবাহনের পেছনে তৈরি হচ্ছে গাড়ির দীর্ঘ সারি।
কালের খবর -/২৬/২/১৮