সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:০৮ পূর্বাহ্ন
সম্প্রতি একটি জরুরি কাজে দেশের তিনটি জেলায় যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে, আর এই জেলা শহর তিনটি হলো কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা। জেলা শহরগুলোতে একটি বিষয় লক্ষনীয় তা হচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা শহরকে গ্রাস করেছে। পায়ে চালানো রিকশার স্থান দখল করেছে এসব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, যারা দাপটের সঙ্গে চলছে শহর ও গ্রামগঞ্জের প্রধান সড়কে, অলিতে-গলিতে আর এ কারণে বিভাগীয় শহর ময়মনসিংহ যা সিটি করপোরেশনভুক্তসহ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনায় অভাবনীয় যানজটের কবলে পড়ছে পৌরবাসী।
এক সময় এই তিনটি জেলা শহরে শুধু পায়েচালিত রিকশা যাত্রী নিয়ে চলাচল করত। গত কয়েক বছরে শহরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আসতে থাকে এবং জেলা শহরগুলোর প্রতিটিতে কমপক্ষে প্রায় ৬ হাজার অটোরিকশা চলছে বলে নাম না জানানোর অনুরোধে কিশোরগঞ্জ পৌরসভার এক কর্মকর্তার কাছ থেকে জানতে পারি।
কিন্তু জনগণের চাপে কিছুদিন আগে নেত্রকোনা পৌরসভা শহর থেকে ৮০০ অটোরিকশা কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল আর এসব অটোরিকশার দুটি রং- লাল আর সবুজ করা হয়েছে। এক দিন চলবে লাল রং করা অটো এবং পরদিন চলবে সবুজ রং করা অটো। এ নিয়ম মানতে কঠোর ব্যবস্থা নিলেও শহরের বাইরে থেকে অর্থাৎ ইউনিয়নের অনেক অটো পৌর এলাকায় ঢুকে প্রতিদিনই যানজট তীব্রতর করছে।
এ প্রসঙ্গে জনৈক অটোচালকের মতে অতিরিক্ত অটো হওয়ায় যানজটও বেড়েছে যেহেতু শহরের রাস্তার পরিমাণ সীমিত এবং প্রতিদিনই নতুন নতুন ব্যাটারিচালিত অটো এই নির্দিষ্ট রাস্তায় চলাচল করে ফলে পৌরসভা থেকে নিয়ম করে দিলেও অনেকে সেই নিয়ম মানছেন না। জনৈক ইঞ্জিনচালিত রিকশাচালক কাইয়ুম বলেন, ‘পায়েচালিত রিকশা কমে গেছে অটোর কারণে। তাই আমরাও রিকশায় ইঞ্জিন লাগিয়ে চালাচ্ছি। কিন্তু অটোতে যাত্রী তোলে আটজন, আর রিকশায় উঠতে পারেন মাত্র দুজন।’ এতে তাদের আয় কম। অটোতে চলাচল করেন, এমন যাত্রী মইনুল বলেন, ‘পৌরসভা থেকে এক দিন পরপর লাল ও সবুজ রঙের অটো চলবে- নিয়ম করে দেওয়া হয়েছে। এতে কিছুটা যানজট কমলেও বড় ধরনের কোনো উন্নতি হয়নি। যানজট আগের মতোই। তবে যানজটের সমস্যা নিরসন করতে হলে শহরের প্রতিটি সড়কের মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
পৌরসভার মেয়রের অনুপস্থিতিতে নাম না প্রকাশের অনুরোধে এক কর্মকর্তা বলেন ‘ইতোমধ্যে নতুন লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। বেআইনিভাবে রিকশা বা অটো চলাচলেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ‘তিনি আরও বলেন, বেআইনি যান চলাচল বন্ধের জন্য প্রশাসনকেও আরও কঠোরভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তবে জনগণ অবিলম্বে নেত্রকোনা শহরকে যানজটমুক্ত করতে বেআইনি অটো বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
বৈদ্যুতিক ব্যাটারিচালিত প্যাসেঞ্জার রিকশা হলো চীনের লিলং-এর একটি হট সেলিং ব্র্যান্ড।
২০০২ সালে একটি ছোট ট্রাইসাইকেল ওয়ার্কশপ লিলং-এর প্রথম প্রজন্মের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ২০০৪ সালে, লিলং কোম্পানির উন্নয়ন বিভাগের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল এবং সেইসঙ্গে প্রচুর বিনিয়োগও করেছিল এই ই-ট্রাইসাইকেল তৈরির জন্য। ২০০৮ সালে চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রয় নেটওয়ার্ক তৈরি করে, লিলং ওয়ার্কশপ নির্দিষ্ট স্কেল এবং অনুমোদিত ISO ৯০০১ মান ব্যবস্থাপনা সিস্টেম সার্টিফিকেশনের সঙ্গে আকার নিতে শুরু করে। ২০১৩ সালে, দ্বিতীয় প্রজন্মের লিলং জনগণ কোম্পানির ম্যান্ডেট গ্রহণ করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে নামকরণ করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে কোম্পানি লিলংকে অসীম শক্তির প্রতিনিধিত্ব হিসাবে পুনঃনামকরণ করে, ২০০৮ সালে, লিলং সাইলন ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে একটি কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে যা প্রথম ধাপ চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিকীকরণ, ২০২১ সালে, উচ্চ মান এবং মানের সঙ্গে ইউরোপ ইসিপি পণ্য আপগ্রেড করার অনুমোদন।
বৈদ্যুতিক ব্যাটারিচালিত যাত্রীবাহী রিকশায় রয়েছে বড় শক্তির মোটর ৬০ ভোল্ট ১০০০ ওয়াট, কম পরিশ্রমের দুর্দান্ত চক্রযান। এই অটোমেটিক ব্যাটারি রিকশা এখন আমাদের বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি জেলায়ই এসেম্লিং হচ্ছে। এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও চলাচল করছে ফলে দেশবাসীর যোগাযোগের ক্ষেত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে, সময় ও অর্থ দুটির ক্ষেত্রেই সাশ্রয় হচ্ছে।
বর্তমানে যেকোনো জেলা শহর এবং উপজেলাসহ জনবহুল এলাকা এমনকি ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সাধারণ রিকশার সঙ্গে বাজার থেকে ক্রয়কৃত ইউপিএসের ব্যাটারি এবং ছোট মটর সংযোগকারী রিকশা চালনা করা হচ্ছে। ফলে পায়ের সাহায্যে প্যাডেল দ্বারা রিকশা চালানো কষ্ট বিধায় রিকশা চালকরা ব্যাটারি রিকশা ব্যবহার করতে উৎসাহিত হচ্ছেন এবং দ্রুতগামী বিধায় যাত্রীরাও এই রিকশায় আরোহণে স্বাচ্ছন্দ্য মনে করছেন।
এর ধারাবাহিকতায় বর্তমানে এ ধরনের রিকশার হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখ্য, এ বিষয়ে সরকার কর্তৃক প্রয়োজনীয় নিরুৎসাহিত প্ররোচনা চালালেও সারা দেশের কোথাও কোনো অগ্রগতি লক্ষণীয় নয় বরং পরিবেশগত অবনতিই হয়েছে ব্যাপক। বর্তমানে প্রতিনিয়ত ও এরকম রিকশার সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শুধু সময় ও কষ্ট বাঁচানোর পরিবর্তে নিম্নবর্ণিত অসুবিধাগুলো বিশেষ লক্ষ্য করা যাচ্ছে:
১) রিকশার গতি সাধারণ রিকশার চেয়ে বেশি হওয়ার দরুন রিকশার নিয়ন্ত্রণ রিকশার চালক কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যার ফলে প্রায়শই দুর্ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে এবং এ দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ও জনগণের শংকার কারণ ঘটছে।
২) এ ধরনের রিকশার ব্যাটারিগুলো অনুমোদিত বৈদ্যুতিক লাইনে চার্জ করলে খরচ বেশি হয় বিধায় চালকরা অসাধ উপায় অবলম্বন করে বিভিন্ন এলাকায় এসব ব্যাটারি চার্জ করছে। যার ফলে বিদ্যুতের অপচয় এবং বিদ্যুৎ খাতে মোটা অঙ্কের অর্থের আয় হতে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
রিকশার সঙ্গে ব্যবহৃত ব্যাটারিগুলো অধিক ব্যবহারের ফলে খুব অল্প দিনেই নষ্ট হয়ে যায়। এসব ব্যাটারি সাধারণত সাবধানের সঙ্গে ধ্বংস করার কথা থাকলেও যত্রতত্রভাবে এ ব্যাটারি ফেলে দেওয়া হচ্ছে কিংবা ধ্বংস করা হচ্ছে। ফলে ব্যাটারির মধ্যে বিদ্যমান রাসায়নিক দ্রব্যগুলো সহসাই পুকুর, ডোবা অথবা অন্যকোনো মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে এবং পরিবেশের মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে যা সবারই ভেবে দেখতে হবে।
৩) পুরাতন মডেলের প্যাডেলে চালিত রিকশা চালনায় অধিক পরিশ্রমযোগ্য বিধায় শারীরিক শ্রমের পরিবর্তে নতুনভাবে উদ্ভাবিত ব্যাটারিচালিত রিকশা সহজ পরিশ্রমে চালনায় চালকরা অফটাইমে অনেক অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হতে পারে। যা ভবিষ্যতের জন্য আইনশৃঙ্খলার হুমকির সম্ভাবনা রয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন।
সুতরাং এ বিষয়ে করণীয়:
ক) অনতিবিলম্বে অননুমোদিত ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো বন্ধকরণ। নির্দিষ্ট বিশেষজ্ঞের মতামত এবং ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার জন্য বাড়তি পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতির সংযুক্তকরণ।
খ) চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ লাইসেন্সের নিয়মকরণ।
গ) ব্যাটারি অবাধে বিক্রয় বন্ধকরণ ইতাদি।
আরও একটি বিষয় এ ব্যাটারি গাড়ির জন্য সর্বত্র বিদ্যুৎ ঘাটতি হয়। কেন হয় এই ঘাটতি? একটু রাতে শহরের অলিগলিতে ঢুঁ মারলেই দেখা যায় ত্রিশটা, পঞ্চাশটা অটোরিকশা সারা রাত চার্জ দেওয়া হচ্ছে। একটা অটো রিকশার লোড 1200-1500 ওয়াট ধরলে শহরের হাজারটা গাড়ি চার্জ দিতে ১-২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যায়। সেখানে একটা এলাকায় বরাদ্দ থাকে ৩-৪ মেগাওয়াট করে। অটোরিকশা চার্জ দেওয়ার জন্য গ্রাহকরা কি আলাদা কানেকশন নেয়? নেয় না। গ্রাহকপ্রতি ১ কিলোওয়াট দিয়ে সেই বিদ্যুৎ গ্রাহক ৩.৫ কিলোওয়াট চালাতে পারে না। সেখানে অটোরিকশা চার্জার কত হাজার ওয়াট টানে তার একটু হিসাব করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন বিজ্ঞজনরা।
যাই হোক- এটা সত্য যে অটোরিকশার কারণে বহু লোক কাজ করে খাচ্ছে, সহজ হয়েছে জীবনযাত্রা যাতায়াত খরচও কমেছে এবং দ্রুত হয়েছে জনগণের যোগাযোগ ব্যবস্থা।
একটু খেয়াল করতে হবে যে রাস্তায় ইঞ্জিনচালিত গাড়ির জন্য যেমন রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা আছে, ফিটনেসের মেয়াদ বাড়ানোর ব্যাপার রয়েছে, চালকদের আইনকানুন মানার ব্যাপারে লাইসেন্সের বাধ্যবাধকতা রয়েছে ঠিক তেমনি এই ব্যাটারিচালিত অটোগাড়িগুলো রাস্তায় চলার ক্ষেত্রেও তা বাঞ্ছনীয় হওয়া উচিত। যানজটের কথা চিন্তা করে সড়কে, মহাসড়ক ও জেলা শহরগুলোর প্রধান প্রধান সড়কে এই ব্যাটারিচালিত গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করা উচিত বলে মনে করেন এই সমাজের সচেতন নাগরিকদের একাংশ। অন্যান্য অনেক খাতের মতো এই খাতেও সঠিক ব্যবহারের নিয়মরীতি রাখা ও মেনে চলা উচিত।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বিভিন্ন সময়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা বা ইজিবাইক বন্ধে বিগত সরকার ঘোষণা দিলেও এটি কার্যকর করতে পারেনি। বরং বিগত সরকারের আমলে গত মে মাসে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের ঘোষণার পর দুদিনব্যাপী আন্দোলনের মুখে আবারও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় তা চালু রাখার নির্দেশ দিয়েছে বিগত সরকার।
যা বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকরা সুনজরে নিয়ে তিলোত্তমা ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান সড়কে আইন করে তা নিষেধ করা সমীচীন বলে মনে করেন নগরবাসীরা।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক