সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২২ অপরাহ্ন
নারী পাচার রোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিগত বছরগুলোতে কিছুটা প্রশংসা পেলেও পাচারের নতুন নতুন খবর আবার উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। পাচারকারীরা ব্যবহার করছে অভিনব সব কৌশল। সেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে বিয়ে, মডেলিং এবং বিদেশে চাকরির প্রলোভনসহ নানা ধরনের ফাঁদ।
ট্রাফিকিং ইন পার্সন (টিআইপি) সূচকে ২০২০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান কিছুটা আগানো ছিল। বাংলাদেশ টায়ার মাই্নাস টু থেকে টায়ার টু-তে ২০২০ সালের মানব পাচার, তথা টিআইপি সূচকে বাংলাদেশ টায়ার মাইনাস টু থেকে টায়ার টুতে উন্নীত হয়েছিল।
বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্র বলছে, গত দশ বছরে, ভারতে অথবা ভারত হয়ে অন্য দেশে ৫০ হাজার বাংলাদেশি নারী পাচার হয়েছেন। তবে এখন আর পাচার শুধুমাত্র দালালদের মাধ্যমেই হচ্ছে তা নয়, পাচারের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ‘বিশ্বাসযোগ্য’ উপায় ব্যবহার করছেন পাচারকারীরা।
পাচারের জন্য যত খুশি বিয়ে :
সম্প্রতি ২০০ জন নারীকে ভারতে পাচারের অভিযোগে গুজরাটের সুরাট থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে বাংলাদেশের যশোরের মনিরুল ইসলাম মনিরকে। এই পাচারকারী নারীদের পাচার করার সহজ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছেন ‘বিয়ে’কে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর আনুযায়ী, আটকের পর মনির স্বীকার করেছে, বাংলাদেশের দরিদ্র মেয়েদের বিয়ে করে তাদের পাচার করাই তার পেশা। পাচারের উদ্দেশ্যে মনির বিয়ে করেছে ৭৫টি। বিয়ের পর স্ত্রীদের অবৈধভাবে সীমান্ত পার করে নিয়ে যেতো কলকাতায়। তারপর তাদের বিক্রি করে দিতে ভারতের বিভিন্ন পতিতাপল্লীতে। ভারতীয় পুলিশ গত ১১ মাসে ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১১ বাংলাদেশি নারীকে উদ্ধার করে এবং তাদের কাছে মনিরের নাম জানতে পেরে তার খোঁজে ১০ হাজার রুপি পুরস্কার ঘোষণা করে এবং শেষ পর্যন্ত মনিরকে আটক করে।
এর আগে গত মাসেই আরেক পাচারকারীর বিষয়ে জানা গিয়েছিল। গণমাধ্যমের খবর, লিটন নামের এক পাচারকারী প্রথমে বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন নারীর সাথে পরিচিত হতেন। এর পাশাপাশি তার দেশি সিন্ডিকেট সদস্যরাও নারীদের বিদেশে পাঠানোর কথা বলে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতো। এভাবে সখ্য গড়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতেন এবং কখনো টেলিফোনে, আবার কখনো কখনো দেশে এসে সরাসরি বিয়ে করতেন। এভাবে তিনি অন্তত ছয়জনকে বিয়ে করেছেন এবং তাদের মধ্যে পাঁচজনকে ইরাকে পাচার করে বিক্রি করে দিয়েছেন। চক্রটি ৩০-৪০ জন নারীকে পাচার করে মধ্যপাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বিক্রি করেছেন বলে জানা গেছে।
শুধু যে বাঙালি নারীরাই এই পাচারের শিকার হচ্ছেন, তা নয়। উপজাতি নারীরাও বিভিন্নভাবে পাচার হচ্ছেন। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, গত ৫ বছরে প্রায় ৪৫০ জন উপজাতি নারী পাচারের শিকার হয়েছেন। এই পাচারের সাথে ১০টি ম্যারেজ মিডিয়ার সম্পৃক্ততাও খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জানা গেছে, এই ধরনের ম্যারেজ মিডিয়ার মাধ্যমে প্রাথমিক যোগাযোগের পর চীনা নাগরিকরা বাংলাদেশে এসে বিয়ের পর চীনে নিয়ে যাওয়ার কয়েক মাস পরই তাদের মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে সেখানকার বিভিন্ন যৌন ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি মেয়েরাই এই ধরনের পাচারের শিকার হচ্ছেন।
ফাঁদের নাম টিকটক তারকা :
এ বছরের জুন মাসেই নারী পাচারের আরেকটি অতি অভিনব কৌশলের কথা জানা গিয়েছিল এবং সেটিরও সূত্র ছিল ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি নারী নির্যাতনের ভিডিও। সেই ভিডিওর সূত্র ধরেই বেরিয়ে আসে বিশাল ঘটনা।
জানা যায়, টিকটকের তারকা বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচার করা হয়েছে অনেক নারীকে। পাচারের শিকার এক তরুণী ভারত থেকে ফিরে বীভৎস নির্যাতনের তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে। তার পাচারের সমন্বয়ক হৃদয় বাবু। এই চক্রের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার নারী পাচারের শিকার হয়েছেন বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে।
চাকরির প্রলোভন :
বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের নারীরা বিভিন্ন দেশেই কম-বেশি পাচার হচ্ছে। তবে পাচার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থাকা পাচারকারী সিন্ডিকেট চাকরিসহ নানা লোভ দেখিয়ে ২০-৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে নারীদের বিক্রি করে দিচ্ছে ভারতীয় সিন্ডিকেটের কাছে। সেখানে আবার নানা হাত ঘুরে অনেকেরই ঠিকানা হচ্ছে পতিতাপল্লী। তারা শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ও রাইটস যশোর নামের দুই বেসরকারি সংস্থার তথ্য থেকে জানা যায়, ভারতে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর ভারতের সরকারি ও বেসরকারি সেফহোমে এখনো ৫০ জনের বেশি বাংলাদেশি নারী রয়েছেন। তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা জারি রয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে কত নারী প্রতি বছর পাচার হয় সে বিষয়ে সরকারিভাবে খুব বেশি তথ্য নেই। তবে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৮টি রুট দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার নারী, শিশু ও কিশোরী ভারতে পাচার হচ্ছে।
আইন কী বলে?
২০১২ সালে দেশে প্রথমবারের মতো মানব পাচার অপরাধের বিচারের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এই আইনের অধীন অপরাধগুলো আমলযোগ্য, আপসের অযোগ্য এবং জামিন অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
আইনের ৬ ধারায় মানবপাচার নিষিদ্ধ করে এই অপরাধের জন্য অনধিক যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে।
৭ ধারায় আছে সংঘবদ্ধ মানবপাচার অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা কমপক্ষে সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদন্ডের কথা।
ধারা ৮-এ অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা, ষড়যন্ত্র বা চেষ্টা চালানোর দন্ড হিসেবে অনধিক সাত বছর এবং কমপক্ষে তিন বছর সশ্রম কারাদন্ড ও কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
১১ ধারায় পতিতাবৃত্তি বা অন্য কোনো ধরনের যৌন শোষণ বা নিপীড়নের জন্য আমদানি বা স্থানান্তরের দন্ড অনধিক সাত বছর এবং কমপক্ষে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে।
অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ৫ ধারায় নারী পাচারকে অপরাধের স্বীকৃতি দিয়ে এর বিচারের জন্য তিনটি ধারা রাখা হয়েছে। প্রথমটি হলো, ‘যদি কোনো ব্যক্তি পতিতাবৃত্তি বা বেআইনি বা নীতিবিগর্হিত কোনো কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে কোনো নারীকে বিদেশ হতে আনয়ন করেন বা বিদেশে পাচার বা প্রেরণ করেন, অথবা ক্রয় বা বিক্রয় করেন বা কোনো নারীকে ভাড়ায় বা অন্য কোনোভাবে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে হস্তান্তর করেন, বা অনুরূপ কোনো উদ্দেশ্যে কোনো নারীকে তার দখলে, জিম্মায় বা হেফাজতে রাখেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা অনধিক ২০ বছর কিন্তু অন্যূন ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন।
ফিরে আসা নারী কী বলেন, কী করেন?
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি জানায়, বিগত ১০ বছরে ভারতে পাচার হওয়া ২ হাজার নারীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ফিরে আসা নারীদের খুব কমই তাদের অভিজ্ঞতা অন্যদের জানায়। অনেকের হয়তো বলার মতো মানসিক অবস্থাও থাকে না। এর পিছনে কাজ করে সমাজ, পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনের কাছে হেয় হওয়ার ভয়। কারণ অনেক নারী ফিরে এসে সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে আবারো হেনস্থার শিকার হয়েছেন। অনেকেই ভোগেন অনিরাপত্তায়। পারিবারিকভাবে সমর্থন না পাওয়ায় অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আবার হতাশ হয়ে পড়ছেন।
আমাদের দুর্বলতা এবং করণীয় :
বাংলাদেশ থেকে নারী পাচারের ইতিহাস অনেকদিনের হলেও এটি বন্ধের জন্য খুব বেশি যে সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তা নয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে একমাত্র উদ্যোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। কিন্তু এটি যে শুধুমাত্র আইন দিয়েই বন্ধ হবে, তা কিন্তু নয়। এই বিষয়ে আমাদের দুর্বলতাগুলো আগে চিহ্নিত করতে হবে। কীভাবে এই পাচারগুলো ঘটছে এবং সেই হিসেবেই প্রতিরোধের উপায়গুলোও হাজির করতে হবে। পাচারকারীরা কিন্তু প্রতিনিয়তই নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে পাচার অব্যাহত রাখছে। পাচার প্রতিরোধে আইনের পাশাপাশি সেই কৌশলগুলোর বিপরীতে কৌশল ঠিক করেই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে প্রতিরোধের উপায়গুলো। সূত্র : ডয়চে ভেলে