বলছিলাম মো.শাহ আলমের কথা। ইতিমধ্যে জীবনের অর্ধশত বছর পার করে ফেলেছেন। বাবা আলী আকবর। কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার ৫নং পশ্চিম জোড় কানন ইউনিয়নের দরিবট গ্রামে তার জন্ম। পিতা মাতার পাঁচ মেয়ে ও চার ছেলের মধ্যে শাহ আলম সবার বড়। বড় আশা করে শাহ আলমকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিল বাবা। মোটামুটি ভাল ছাত্র হওয়ায় স্কুলের শিক্ষকরাও আদর করত তাকে। বলত শাহ আলম একদিন বড় কিছু হবে। কিন্তু পিতা একা ১১ জনের সংসার আর চালাতে পারছিল না। ফলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়ই শুয়াগাজী বাজারে পিতার রেস্তোরাঁয় লেগে যান কাজে। শুরু হয় শাহ আলমের জীবন সংগ্রাম। পিতা মারা যাওয়ার পরেও শাহ আলম রেস্তোরাঁ ব্যবসা চালিয়ে যান। রেস্তোরাঁ ব্যবসা চালিয়ে সংসার চলছিল না বলে ভিটা মাটি বিক্রি করে চলে যান মালদ্বীপে। সেখানে দুই বৎসর নয় মাস কাটানোর পর হয়ে যান অসুস্থ। বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হয় দেশে। স্ত্রী ছেলে মেয়েদের নিয়ে যখন তার অবস্থা একেবারেই টালমাটাল তখন তার মাথায় আসে পৈতৃক রেস্তোরাঁয় ব্যবসা শুরু করার। কিন্তু এতে যে অনেক পুঁজি বিনোয়োগ করতে হয়। এত টাকা সে পাবে কোথায়। তাই রেস্তোরাঁ ব্যবসার চিন্তা বাদ দিয়ে শুরু করেন রাস্তার পাশে চা বিক্রি। স্বল্প আয়ে ভাল লাভ। কিন্তু প্রচলিত রং চা আর দুধ চা বিক্রি করে তার চার মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে গড়া সংসার চালাতেও যখন হিমশিম খাচ্ছে তখনি তার মাথায় এলো প্রযুক্তির কথা।
শাহ আলম ভাবল, না, প্রচলিত চা আর বিক্রি করব না। চা বিক্রিতেও প্রযুক্তির সুফল নিয়ে আসতে হবে। দেশ যখন ডিজিটাল হচ্ছে তখন আমি কেন এনালক চা বিক্রি করব, না,তা হতে পারে না। তাই একটি স্মার্ট ফোন সংগ্রহ করে নেটে সার্চ দিতে লাগলেন নেট দুনিয়ায় কত রকম চা তৈরি হয়। প্রতিদিন রাতেই তিনি নানা রঙের চায়ের খোঁজে সার্চ দেন ইন্টারনেটে। পেয়ে যান নানা রকম চা বানানোর রেসিপি।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার নাভি হিসেবে পরিচিত মিয়া বাজার। এই মিয়া বাজারের রয়েছে বিশাল ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এই মিয়া বাজারের একেবারে ভিতর পান বাজার সংলগ্ন ছোট একটি খোলা জায়গায়। জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে পরিত্যক্ত জায়গার মতো কক্ষটি। আসলে এটি কোন দোকানঘর না। চতুর্দিকে দোকান। দরজা জানালা নেই। মাথার ওপর নানা সামিয়ানা টানানো হয়েছে। বসার কোন জায়গা নেই। কয়েকজন এক সাথে দাঁড়িয়ে চা খেলে বাজারে চলাচলকারী মানুষদের কিছুটা বিড়ম্বনাও হয়। আবার এই স্থানটিরই ভাড়া মাসিক তিন হাজার টাকা। বাজারের মানুষজন ছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন ছুটে আসেন শাহ আলমের নানা রকম চা খেতে।
শাহ আলমের নিপুণ হাতের তৈরি এই আট রকম সুস্বাদু চা কিন্তু আবার একই দামের না। স্বাদের যেমন ভিন্নতা রয়েছে ঠিক, তেমনই রয়েছে দামেরও তারতম্য। এজন্য শাহ আলমকে মুখে কিছু বলতে হয় না। তিনি কোন চায়ের দাম কত তা বোর্ডে লিখে রেখেছেন। যেমন, মালটা চা ও মালাই চা ১৫ টাকা করে,তেতুল চা, মসলা চা,পুদিনা পাতা চা ও পাঁচ মিশালি চা ১০ টাকা করে,গরুর দুধ ও লেমন চা আবার ৫ টাকা করে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চা বিক্রেতা শাহ আলম জানান,স্যার, বিদেশ থেকে এসে খুব অসহায় অবস্থায় ছিলাম। স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে চলতে খুব কষ্ট হতো। চিন্তা করলাম প্রচলিত রং চা আর দুধ চা দিয়ে সংসার চালানো যাবে না। তাই চা বিক্রিতে আধুনিকায়ন আনতে চিন্তা ভাবনা শুরু করলাম। মোবাইল ফোন দিয়ে ইন্টারনেটে খোঁজ করে বিভিন্ন রকম চা বানানোর কৌশল রপ্ত করেছি। এখন আমি আট রকম চা তৈরি করছি। আরো কয়েক রকম চা বানানোর চিন্তা মাথায় রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার টাকা বিক্রি করি। সকাল সাড়ে ৫টায় দোকান খুলি আর রাত ৮টায় বন্ধ করি। আপনার দোয়ায় এই চা বিক্রি করে এখন আমি স্বাবলম্বী। সংসার চালানোর জন্য কারো কাছে এখন আর আমার হাত পাততে হয় না। আজ এই জায়গায় আসতে স্যার আমাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমার ধারণা , আমার মতো এত রকমের চা আর কুমিল্লা জেলায় কেউ বানায় না। চা নিয়ে সব সময় চিন্তা করি। কীভাবে আরো নতুন নতুন চা বানিয়ে কাস্টমারকে খাওয়াতে পারি। চা খেয়ে কাস্টমার আনন্দ পেলেই আমি আনন্দ পাই স্যার। এর বেশি কিছু আমার চাওয়ার নেই। আমার চা খেতে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসে। গর্বে আমার বুকটা ভরে যায়।
কুমিল্লা নগরীতে কোন স্বজন আসলে যেমন রসমালাই খাওয়ানো একটা ঐতিহ্যে দাঁড়িয়েছে। ঠিক তেমনি মিয়া বাজার ও তৎসংলগ্ন আশেপাশের গ্রামগুলোর অবস্থাও এখন একই রকম দাঁড়িয়েছ। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আত্মীয়স্বজন বন্ধু বান্ধব আসলেই তার স্বজনরা বলবে, চলেন মিয়া বাজারে শাহ আলমের নানা রকমের চা খেয়ে আসি।
আপনি মিয়া বাজার যাবেন আর শাহ আলমের চা খাবেন না তা কী হয় !।