বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৪১ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের খবর :
গাজীপুরে বন বিভাগের ২১.৫৬ শতাংশ জমিই বেদখল হয়ে গেছে। ঢাকা বন বিভাগের হিসাব মতে, জেলায় ৫২ হাজার ৭৩৭ একর বনভূমির মধ্যে ১১ হাজার ৩৭২.৩৯ একর ভূমি এরই মধ্যে দখলদারদের হাতে চলে গেছে।
বিভিন্ন করপোরেট হাউস ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান এসব জমি দখল করে চলেছে।
নামিদামি প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের এ দখলদারির কারণে ঢাকার পাশে সুবিশাল এই ভাওয়াল বন একদিকে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াইকে আরো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে।
ঢাকা বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, নীতিবিবর্জিত ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিদের একটি মহল বড় কিছু বেসরকারি কম্পাানির সহায়তায় বন বিভাগের মালিকানাধীন দখলকৃত এসব জমিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছে। তিনি জানান, গাজীপুরভিত্তিক অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান, তৈরি পোশাক কারখানা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান এই এলাকার বনভূমির দখলদারদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
ইউসুফ বলেন, দখলদারদের কাছ থেকে জমি উদ্ধারের লক্ষ্যে বন বিভাগ গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে আসছে এবং বেশ কিছু জমি উদ্ধারও করেছে। কিন্তু এরই মধ্যে গড়ে তোলা কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থাপনা উচ্ছেদ করা বন বিভাগের সক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। তিনি জানান, গাজীপুর ও এর আশপাশের এলাকায় ঢাকা বন বিভাগের মোট ১২ হাজার ৮৯৮.০৮ একর জমি বেদখল হয়ে গেছে। এর মধ্যে বন বিভাগ অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করতে পেরেছে এক হাজার ৫১৬.৬২ একর।
ঢাকা বন বিভাগের এই কর্মকর্তা আরো জানান, গাজীপুরের কচিঘাটা, কালিয়াকৈর, শ্রীপুর ও রাজেন্দ্রপুর এবং ঢাকার সাভার উপজেলার কালিয়াকৈর রেঞ্জে ঢাকা বন বিভাগের মোট ৫৩ হাজার ৬৭১.৮৯ একর বনভূমি রয়েছে।
এর মধ্যে ভূমি দখলদারদের হাতে এখনো রয়েছে ১১ হাজার ৮৩১.২০ একর জমি।
২০১৬ সালে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সাত সদস্যের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক সভা হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন তৎকালীন সাবেক বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। ওই সভায় গাজীপুরের শাল বন এলাকায় ১৫৫ জন ভূমি দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়, যাদের হাতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৫৫৬.২৮ একর ভূমি দখল হয়েছে।
দখলদারদের তালিকা : ওই সভায় ভূমি দখলদারদের মধ্যে ৯৭ জন শিল্পপতি, করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মালিক, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ধনাঢ্য মানুষকে চিহ্নিত করা হয়। সভার ওই তালিকা অনুযায়ী গাজীপুরের বন বিভাগের ভূমি দখলকারীরা হলো পানাস অটো ক্রিয়েশন লিমিটেড, ম্যাকডোনাল্ড বাংলাদেশ লিমিটেড, হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড, ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়স লিমিটেড, বিসিডিএস (ব্র্যাক), বেন্টলি সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, গিভেনসি অ্যাকসেসরিজ গার্মেন্টস লিমিটেড, এডিআই অ্যাকুয়া প্রাইভেট লিমিটেড, ক্লাসিক ফ্যাশন লিমিটেড, ওয়ান ডেনিম-ওয়ান স্পিনিং লিমিটেড, অ্যারিজমা গার্মেন্টস লিমিটেড, শরিফবাড়ী খামার (সিলভার ফরেস্ট), হলোগ্রাম বাংলাদেশ লিমিটেড, এপিলিয়ন স্টাইল লিমিটেড, আদি অ্যাগ্রো ফার্ম, এক্স ফার্মিকা, অ্যারিস্টোফার্মা, টিডেকে জিপার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এসএম নিটিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বিজি কালেকশন লিমিটেড, নুর পোল্ট্রি কমপ্লেক্স, বাংলাদেশ মেজ প্রডাক্ট, আইভিন্স টেক্স লিমিটেড, তিতাস স্কিং লিমিটেড, বেঙ্গল গার্মেন্টস লিমিটেড, মালা পোল্ট্রি ফার্ম, মাজকাত পোল্ট্রি ফার্ম, টিএস ট্রান্সফরমার লিমিটেড, ন্যাশানাল ফিড লিমিটেড, মডার্ন ফিড লিমিটেড, লিথি গ্রুপ, প্যারাগন পোল্ট্রি লিমিটেড, স্ক্রিন গ্রাফ, গরডন স্টিল মিলস, মোশারফ কম্পোজিট লিমিটেড, প্যাকলিন লিমিটেড, নিস্বর্গ পিকনিট স্পট, আর্টিজান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, সজনি ফিল্ম সোসাইটি, বিটি লিমিটেড, মিলেনিয়াম স্টিল মিলস লিমিটেড, কুইন্স পোল্ট্রি ফার্ম, ওমনি অ্যাগ্রো কমপ্লেক্স, ঢাকা ফিশারিজ, র্যাডিয়াম অ্যাকসেসরিজ, নির্জনা অ্যাপারেলস, গোলাম কিবরিয়া ফিশ ফার্ম, ইনডেক্স কনস্ট্রাকশন, নাজ বাংলাদেশ, শাহবা ইয়ার্ন, এটিআই সিরামিক, গিভেন্সি ডেনিমস, নেসলে বাংলাদেশ, গ্রিন টেক রিসোর্ট, সাত্তার টেক্স মিলস, নির্মলা বারোই, এম/এস আহসান কম্পোজিট, জালাল টেক্সটাইল মিলস, শিপি কুঞ্জ পিকনিক স্পট, শিহাব জুট মিলস, সোহাগ পল্লী স্পট, সমাহার, ক্যাসেন্দা কালারস, ফার ইস্ট কম্পানি লিমিটেড, মদিনা ট্যাংক, আজিজ ইন্টারন্যাশনাল, হারদি টেক্সটাইল, নায়াগ্রা টেক্সটাইল, হাজি মিলস, ফেয়ার ট্রেড লিমিটেড, পাশা মিলস, করোনি কম্পোজিট লিমিটেড, শামসুদ্দিন স্পিনিং মিলস, রহমত টেক্সটাইল মিলস, হাইড-অক্সাইড লিমিটেড, চৌধুরী মনোয়ার উদ্দিন সিদ্দিকী, হানিফ স্পিনিং মিলস, এনএম টেক্সটাইল, কোকোলা ফুড প্রডাক্টস, লেভিস টেক্সটাইল, এম এ ওয়াহিদ ব্রিকস, ভিসতোরিয়া টেক্সটাইল, ইকো মিলস প্রডাক্টস, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইলস, গ্রেট ওয়াল সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি, সোলার সিরামিকস, ইকো কটন মিলস, ভাওয়াল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড অ্যান্ড ট্রেড, ট্রেড ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন, ওনটেক্স লিমিটেড, হাউ আর ইউ, অরণ্য কুটির, মিতা টেক্সটাইল, মেঘনা কম্পোজিট, জুবায়ের স্পিনিং মিল, দ্য সোয়েটার, আরএকে সিরামিক, রসুয়া স্পিনিং মিলস, রিদিশা গার্মেন্টস, দুলাল ব্রাদার্স ডিফেন্স গ্রুপ, হংকং সাংহাই মাংগেলা টেক্সটাইল, অটো স্পিনিং মিলস, মনু ফিডস লিমিটেড, গোলাম মাহিদ মনসুর, মামুন প্রোপাইটর এইচ পাওয়ার, হোম ডিজাইন লিমিটেড, আকন্দ গার্ডেন, ডিএম অ্যাগ্রো কমপ্লেক্স, কুঞ্জ বীথি, বাংলাদেশ বিল্ডিং সিমেন্ট লিমিটেড, আলিফ অটো ব্রিকস, আল-নুর হ্যাচারি, ফয়সাল অ্যান্ড ফাহাদ ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ, চায়না-বাংলা প্যাকেজিং অ্যান্ড প্রিন্টিং, প্রাইম ফার্মাসিউটিক্যালস, এইচএস অ্যাগ্রো পোল্ট্রি, রেক্স অটো ব্রিকস, গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস, শিশু পল্লী প্রবাস, ম্যাগ হ্যাচারি, ডিবিএল লিমিটেড, এমওএম লন্ড্রি কমপ্লেক্স, ওয়ারবিট স্টিল বিল্ডিং, ডানা গ্রুপ, সান পাওয়ার সিরামিকস, খলিল গ্রুপ, মাসুমা গার্মেন্টস, জেসন অ্যাগ্রোভেট, গিভেন্সি গ্রুপ, ফার সিরামিকস, গ্যালাক্সি লিমিটেড, হুয়া থাই সিরামিকস, সুলতানা ডাইং, ফু-ওয়াং গ্রুপস লিমিটেড, চাং-ফুং অ্যাপারেলস লিমিটেড, মাসুমা খাতুন গার্মেন্টস, হোতাপাড়া গার্মেন্টস, স্যাং কোয়াং অ্যাপারেলস লিমিটেড, কমিউনিটি বেসজ ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট, আরণ্যক বাংলো, জাহানারা বেগম ও অন্যান্য এবং ইতেমাদ উদ দৌলা।
ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, দেড় বছর ধরে বনভূমি দখলের প্রবণতা বেড়ে গেছে। তিনি জানান, তাঁরা প্রভাবশালী দখলদারদের হাত থেকে বন বিভাগের জমি উদ্ধারে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অভিযোগ দিয়েছেন। সম্প্রতি তাঁরা শ্রীপুর এলাকায় হামীম গ্রুপের দখল থেকে ১০ একর, ডিবিএল গ্রুপ থেকে ছয় একর এবং গ্রিন ভিউ রিসোর্ট থেকে সাত একর জমি উদ্ধার করেছেন।
শুধু গাজীপুরে নয়, বাংলাদেশে দিন দিন বনভূমি সংকুচিত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বনভূমির জমি ইজারা এবং অবিবেচক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলদারির কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের উপাত্ত অনুযায়ী, দেশে এ পর্যন্ত এক লাখ ৫৮ হাজার ৩১ একর বনভূমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ইজারা দেওয়া হয়েছে। আর অবৈধভাবে দখল করে নেওয়া হয়েছে দুই লাখ ৬৮ হাজার ২৬৫ একর।
আর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফওএ) মতে, বাংলাদেশে গত ২৫ বছরে ৬৫ হাজার একর বনভূমি বিলীন হয়ে গেছে। গত পাঁচ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়েছে ১৩ হাজার একর বন। এফওএর ‘স্টেট অব দ্য ফরেস্ট ২০১৬’ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।
একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেশটির মোট এলাকার ২৫ শতাংশ বন থাকতে হয়। বাংলাদেশে বন রয়েছে ১০.৬৬ শতাংশ এলাকা। দেশের ৬৫.৮ শতাংশ বনই বিলীন হওয়ার উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ হচ্ছে ৬৩ লাখ ৬৮ হাজার ৮৫৯ একর। এর মধ্যে বন অধিদপ্তরের অধীন রয়েছে ৪৬ লাখ ৫২ হাজার ২৪৯ একর।