রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৬ পূর্বাহ্ন
এম আই ফারুক, কালের খবর :
বাংলাদেশের পরিবহন খাতে সব অনিয়মের আঁতুর ঘরে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। অভিযোগ রয়েছে সরকারি এই সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম, দুর্নীতি এবং ঘুষ বাণিজ্যের কারণেই অধিকাংশ চালক লাইসেন্স পান না, ভুয়া লাইসেন্সে চলেন। আর অধিকাংশ গাড়ির মালিক ফিটনেস সনদ নেন না। দালালের সহযোগিতা ছাড়া এই সংস্থার কর্মকর্তা কর্মচারীদের কোনো ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যায় না। গতকাল বুধবার সরেজমিন ঘুরে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
রাজধানীর সড়ক ছাড়াও মহাসড়ক, বিভিন্ন গ্রামীণ সংযোগ সড়কে চলছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনার বড় কারণ এই ফিটনেসবিহীন গাড়ি। বিআরটিএর সর্বশেষ তথ্যানুসারে, দেশে নিবন্ধিত গাড়ির মধ্যে মোটরসাইকেল ছাড়া প্রায় ১২ লাখ গাড়ির ৫ লাখ চলাচলের উপযোগী নয়। মোটরসাইকেলের ফিটনেস সনদ নিতে হয় না।
বিআরটিএর সূত্রে জানা গেছে, কোনো গাড়ির ফিটনেস আছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য রাজধানীর মিরপুর কার্যালয়ে গাড়ি পরিদর্শন কেন্দ্র আছে। বিআরটিএর অন্যান্য কার্যালয়ে এ ধরনের কেন্দ্র নেই। মোটরযান পরিদর্শকদের বেশির ভাগ খালি চোখে গাড়ি দেখে সনদ দেন। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা জানান, ঘুষ দিলেই সনদ দেয়া হয়। চলাচলের জন্য গাড়ি উপযোগী কিনা তা পরীক্ষার যন্ত্র বসানোর প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও ওই প্রকল্পের কাজ এগোতে দেয়া হয়নি। কারণ, এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপন করা হলে তাদের ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে।
গাড়ির নির্মাণকালীন নকশা অক্ষত থাকা, ব্রেক-গিয়ার ঠিক থাকা, দরকারি বাতি থাকা, কালো ধোঁয়া বের না হওয়া এবং রং ঠিক থাকলেই কেবল গাড়ি রাস্তায় চলাচলের উপযোগী বলা যাবে। মোটরযান অধ্যাদেশ অনুসারে, ফিটনেস পেতে অন্তত ৩৬ ধরনের কারিগরি ও বাহ্যিক বিষয় পরীক্ষা করতে হয়। মোটরযান অধ্যাদেশ অনুসারে, মোটরসাইকেল ছাড়া বাস-মিনিবাস বা প্রাইভেটকারের মতো গাড়ি বছরে একবার ফিটনেস পরীক্ষা করে নিতে হয় বিআরটিএ কার্যালয় থেকে। বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শকরা তা খালি চোখেই পরীক্ষা করেন।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সময় দেখা গেছে, অধিকাংশ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই। এমনকি মন্ত্রী, এমপি, পুলিশসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের অধিকাংশ গাড়ির বৈধ কাগজপত্র নেই। চালকেরও নেই। গণপরিবহনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ যানবাহনের ফিটনেস সনদ নেই। চালকেরও নেই বৈধ লাইসেন্স। লাখ টাকায় গাড়ি কেনার পর সামান্য টাকার ফিটনেস সনদ ও চালকের লাইসেন্স না থাকার কারণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে থলের বেড়াল।
ভুক্তভোগীরা জানান, বিআরটিএ কর্মকর্তাদের ঘুষ বাণিজ্য থেকে শুরু করে নানা ধরনের হয়রানির কারণে অভিজ্ঞ চালকরা ড্রাইভিং লাইসেন্স না পেলেও ঘুষ দিয়ে স্বল্প সময়ে লাইসেন্স পাচ্ছে অদক্ষরা। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বিআরটিএ গিয়ে কর্মকর্তাদের চড় থাপ্পড় দিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
গতকাল দুপুর ১২টা। বিআরটিএর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন জুবায়ের। মটর বাইকের লাইসেন্স করতে আসা জুবায়ের বলেন, আমি মোটর বাইকের লাইসেন্সের জন্য সবকিছু জমা দিয়েছি। একদিন পর শিক্ষানবিশ লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এতে মেয়াদ দেয়া আছে অক্টোবর পর্যন্ত। এখন দেখি আমার মূল লাইসেন্স পাওয়ার জন্য পরীক্ষার তারিখ দেয়া হয়েছে আগামী বছরের মে মাস পর্যন্ত। এই অসঙ্গতির মূলে আমি ঘুষ দেইনি।
সঠিকভাবে লাইসেন্স নিতে ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় লাগবে। কিন্তু মাহবুব (ছদ্মনাম) এক মাসেই ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছেন। অল্প সময়ে লাইসেন্স পাওয়ার রহস্য সম্পর্কে তিনি বলেন, যেখানে যে সেবা (অতিরিক্ত টাকা) দিতে হয় সেখানে তাই দিয়েছি। বিনা ভোগান্তিতে সহজে লাইসেন্স পেয়েছি। শুধু ড্রাইভিং লাইসেন্স শাখা নয়।
বিআরটিএর সব শাখার একই চিত্র। অনিয়ম আর ঘুষই হচ্ছে বড় নিয়ম। টাকা হলেই পাওয়া যায় সব ধরনের সনদ।
সেবাগ্রহীতা গাড়ি মালিক আলী হোসেন (ছদ্মনাম) অভিযোগ করেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঘুষ দিয়ে ফিটনেস সনদ নিতে হয়। পরীক্ষা না করে ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিয়ে গাড়ির ফিটনেস সনদ সংগ্রহ করা হয়।
বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মাসুদ আলম কালের খবরকে বলেন, ফিটনেস পরীক্ষার জন্য মিরপুরেই কেন্দ্র আছে, আর কোথাও নেই। অন্যত্র স্থাপন করার জন্য প্রক্রিয়া চলছে। আমাদের এখানে বা অন্য কোথাও ঘুষ বা অন্যান্য অনিয়ম যারা করে, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও অন্যান্য শাস্থি দেয়া হয়।
বিআরটিএর এই ঘুষ আর অনিয়মের কথা অস্বীকার করেছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান মশিউর রহমান। তিনি কালের খবরকে বলেন, এখানে কোনো ঘুষ-বাণিজ্য নেই। যদি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে শাস্থির আওতায় আসতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া হয় না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ঢাকার বাইরে দ্রুততম সময়ে লাইসেন্স দেই। ঢাকায় বেশি সময় লাগে। তবে আমরা ৩ মাসের জন্য শিক্ষানবিশ কার্ড দিয়ে থাকি। এর মধ্যেই তার পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।