মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:০৪ পূর্বাহ্ন
এম আবদুল্লাহ, কালের খবর :
সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন চলছেই। নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকায় ছাত্র-কিশোর বিক্ষোভ চলাকালে দু’দিনে রাজপথে অন্ততঃ ৪০ সাংবাদিক হেলমেট বাহিনীর হাতে নিষ্ঠুরভাবে রক্তাক্ত-নির্যাতিত হয়েছেন। বর্বরোচিত এ হামলার প্রতিবাদে এবং চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের দাবিতে সাংবাদিক সমাজ যখন রাজপথে সংগ্রাম করছে তখন ২৮ আগস্ট রাতে পাবনায় নিজ বাসার সামনে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আনন্দ টিভির জেলা প্রতিনিধি সুবর্ণা আক্তার নদী। তিনি স্থানীয় দৈনিক জাগ্রত বাংলারও সম্পাদক, প্রকাশক। এ নিয়ে চলতি ২০১৮ সালের ৮ মাসে তিনজন সাংবাদিক খুন হলেন।
নদীর আগে চলতি বছর ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে লক্ষীপুরে শাহ মনির পলাশ এবং ৯ মার্চ রাজধানীর যাত্রাবাড়িতে সুমন শিকদার নামে দুই সাংবাদিক ঘাতকদের হাতে হত্যার শিকার হন।
আরেকটু পেছনে তাকালে দেখা যাবে গত দশ বছরে হত্যার শিকার সংবাদকর্মীর সংখ্যা ৩৩। এর মধ্যে ২০০৯ সালে এনটিভির আতিকুল ইসলাম আতিক, পাক্ষিক মুক্তমনের নূরুল ইসলাম রানা, সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক সময়ের এস এম আহসান হাবীব বারী, দৈনিক রূপালী দেশের আবদুল হান্নান ও দৈনিক ইনকিলাবের আবুল হাসান আসিফকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
২০১০ সালে সাপ্তাহিক ২০০০ এর ফতেহ ওসমানী, এটিএন বাংলার শফিকুল ইসলাম টুটুল ও বরিশালের মুলাদী প্রেস ক্লাবের সহ সম্পাদক মনির হোসেন রাঢ়ী খুন হন।
২০১১ সালে দৈনিক জনতার ফরহাদ খাঁ, দৈনিক আজকের প্রত্যাশার মাহবুব টুটুল, সাপ্তাহিক বজ্রকন্ঠের আলতাফ হোসেন ও ভোরের ডাকের ফরিদুল ইসলাম রঞ্জু দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত হন।
সবচেয়ে আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী খুনের ঘটনা ঘটে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। একই বছর আরও খুন হয়েছেন যশোরে গ্রামের কাগজের জামাল উদ্দিন, হবিগঞ্জের দৈনিক বিবিয়ানার জুনায়েদ আহমদ ও নরসিংদী বাণীর তালহাদ আহমদ কাবিদ।
২০১৩ সালে খুন হন ঢাকায় নিউএজের মাহমুদুল হাসান তারেক, সাপ্তাহিক অপরাধ দমনের দুর্জয় চৌধুরী দিপু, সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক ফারুক আহমদ ও দৈনিক ইত্তেফাকের প্রখ্যাত ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমদ। ২০১৪ সালে অপরাধ দমনের শাহ আলম সাগর, দৈনিক সমাচারের দোলোয়ার হোসেন; ২০১৫ সালে সাপ্তাহিক অপরাধ জগতের মুশফিকুর রহমান তুহিন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের মেডিকেল প্রতিনিধি আওরঙ্গজেব সজীব, রংপুরের যুগের আলোর মশিউর রহমান উৎস ও দৈনিক সমকালের আবু সায়েম নিহত হন।
২০১৭ সালে খুন হয়েছেন সমকালের আবদুল হাকিম শিমুল ও যুগান্তরের আবুল কালাম আজাদ। এছাড়া সাংবাদিক নির্যাতন, নিপীড়ন, মামলা-হামলাতো নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
প্রত্যেকটি সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের পর সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাময়িক প্রতিবাদের ঝড় উঠে। বিচার দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম করে সাংবাদিক সংগঠনগুলো। সাংবাদিক হত্যা নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেই সাংবাদিক ইউনিয়ন ও সাংবাদিক নেতাদের সামালোচনা করাও এক ধরনের ফ্যাশন বা বাতিকে পরিণত হয়েছে। ঢালাওভাবে সাংবাদিক নেতাদের চরিত্র হনন করে বলা হয় ‘নেতাদের দালালীর কারণেই সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন বাড়ছে’।
সাংবাদিকদের ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে বরাবরই বহুমাত্রিক প্রতিক্রিয়া ও দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষণীয়। এক শ্রেণির সাংবাদিক ট্রেড ইউনিয়নের তৎপরতাকে স্রেফ ধান্ধাবাজি হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। সুযোগ পেলেই ইউনিয়ন নেতাদের এক হাত নিতে ছাড়েন না। সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতাদের পিণ্ডি চটকান আচ্ছামত।
আবার সাংবাদিকদের আরেকটি শ্রেণি আছেন যারা সাংবাদিক ইউনিয়ন ঠিক অপছন্দ করেন না, কিন্তু ইউনিয়ন নিয়ে বিভেদ-বিভক্তির বিরুদ্ধে তারা। তারা প্রকারান্তরে ইউনিয়নের প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা স্বীকার করে ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়নের প্রত্যাশী।
অপর সাংবাদিক শ্রেণীটি বিভক্ত ইউনিয়নের সঙ্গে নিজেদের অস্তিত্বকে একাকার করে নিয়েছেন। তাদের শয়নে-স্বপনে জাগরণে ইউনিয়ন। এদের অনেকের পেশার প্রতিও ততটা মনযোগ নেই যতটা ইউনিয়ন নিয়ে। নির্বাচন আসলেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। শোচনীয় পরাজয়েও তারা থামেন না। আবার নির্বাচন ও ইউনিয়নকে নিজেদের আখের গোছানোর অবলম্বন হিসেবেও বেছে নিয়েছেন কেউ কেউ। যদিও আমার জানামতে এদের সংখ্যা একেবারে হাতে গোনা।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে কিংবা চকরিচ্যুত হয়ে বা ন্যায্য পাওনা বঞ্চিত হয়ে সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতাদের মুণ্ডুপাত করেন এমন সব সাংবাদিক বন্ধু যারা এক দিনের জন্যও ইউনিয়নের আঙ্গিনা মাড়াননি, কোনো আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণতো দূরস্ত। এদের অনেকে সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিতেও ঘেন্না বোধ করেন, নাক ছিটকান। অথচ যখন বিপদে পড়েন তখন ফেসবুকে স্ট্যাটাস প্রসব করে বলেন-‘ধান্ধাবাজ, চান্দাবাজ সাংবাদিক নেতারা চুপ কেন, তারা কেন কিছুই করছেন না’। নোংরা ভাষায় সাংবাদিক নেতাদের চরিত্রহরণকারিদের অনেককে চিনি যারা কর্মসূচীতে যোগ দেয়াতো দূরের কথা, তাদের মিডিয়াতে সাংবাদিক আন্দোলনের খবরটি স্থান দিতেও অনাগ্রহী।
দীর্ঘ দিন সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে সংগ্রাম করতে গিয়ে এমনও অভিজ্ঞতা রয়েছে, যাদের চাকরিচ্যুতি বা অধিকার বঞ্চনার প্রতিবাদে কর্মসূচি ঘোষণা করে আমরা রাস্তায় দাঁড়ালাম তারাও কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার সময় পাননি। যে আক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আমরা আন্দোলন করছি সেই প্রতিষ্ঠানের একজনও যোগ দেননি এমন উদাহরণও আছে।
অথচ আমাদের কর্মসূচি দিতে যদি একদিন বিলম্ব হয় তা হলে সমালোচনার ঝড় তুলতে ভুল করেন না। এক পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে সিরিজ মামলার প্রতিবাদে বিবৃতি-কর্মসূচি দেওয়ার পর ওই পত্রিকায় সংবাদটি পর্যন্ত প্রকাশ হয়নি।
বুঝতে হবে, সাংবাদিক ইউনিয়ন কোনো গায়েবী শক্তি নিয়ে কাজ করে না। সদস্যরাই ইউনিয়নের শক্তি। যে সংগঠনের সদস্যরা যত সক্রিয় সেটির প্রভাব তত বেশী। তিন হাজার সদস্যের একটি ট্রেড ইউনিয়নের এক বিক্ষোভ মিছিল বা মানববন্ধন করতে ৩০ জন সদস্য যোগাতে যদি নেতাদের হিমশিম খেতে হয় সে ইউনিয়নকে মালিকরা বা সরকার গুরুত্ব দেবে কেন? আর গুরুত্ব না থাকলে বিপদে কার্যকরভাবে পাশে দাঁড়ানোর সুযোগইবা কোথায়? দাবি বা ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য দরকার একটি সংঘ শক্তি। ট্রেড ইউনিয়ন হচ্ছে সেই সংঘ শক্তির অনুমোদিত প্লাটফর্ম। এই সংঘের শক্তি হিসেবে সদস্যরা নেতাদের ডাকে যত বেশী সাড়া দেবেন, সেই সংগঠনের প্রভাব তত বেশী থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
অন্য সকল পেশার ট্রেড ইউনিয়ন বা এসোসিয়েশনের বেলায় দেখা গেছে অধিকারের প্রশ্নে ডাক পড়লে সবাই স্বতঃস্ফুর্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু আমরা সাংবাদিকরা নিজেদের অধিকার ও প্রাপ্যের ব্যাপারে এতটাই উদাসীন যে শীতাতপ কক্ষে বসে অপেক্ষা করি কখন অন্যেরা সুবিধা আদায় করে আনবে।
একটা সময় ছিল সাংবাদিক ইউনিয়নের সঙ্গে প্রেস শ্রমিক ও কর্মচারিরা ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচী পালন করতো। তখন সাংবাদিকের উপস্থিতি কম হলেও প্রেস শ্রমিক ও কর্মচারিদের বিপুল উপস্থিতি কর্মসূচি সফলে সহায়ক হতো। এখনো যেকোনো ইস্যুতে যদি এক হাজার সাংবাদিকও রাস্তায় নামেন এবং সেটা সব মিডিয়া আন্তুরিকভাবে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার-প্রকাশ করে তাহলে মালিক কিংবা সরকারের টনক নড়বেই।
আরও কথা আছে। যারা সাংবাদিক ইউনিয়ন বা নেতাদের দল নিরপেক্ষ দেখতে চান, সরকার বা বিরোধী দলের দালালি থেকে বিরত থাকার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নসিহত করেন তাদেরই অনেককে দেখি একচোখা আচরণ ও দল বিশেষের অন্ধ আনুগত্য করতে। ক্ষমতার চৌহদ্দিতে যে সব সাংবাদিক নেতার পদচারণা তাদের পেছনে ঘুর ঘুর করেন। সাংবাদিক আন্দোলনের খবর পরিবেশনের ক্ষেত্রেও তাদেরই গুরুত্ব দেন। ঐক্যের জন্য মুখে ফেনা তুলেন, অথচ এক সম্পাদকের বিরুদ্ধে সাধারণ মানহানি মামলা হলে প্রতিবাদে সোচ্চার হন, আবার ভিন্নমতের সম্পাদক রক্তাক্ত হলে বিচলিত না হয়ে উল্লসিত হন।
বর্বরতার পক্ষে যুক্তি খুঁজে পেতে তাদের বিবেক বাঁধেনা। কয়েকটি পাঠকপ্রিয়-দর্শকপ্রিয় গণমাধ্যম বন্ধ করে হাজারো সাংবাদিককে বেকার করার পরও যারা টু শব্দটি উচ্চারণ করেন না তারা নিরপেক্ষতার জ্ঞান দিলে তা হাস্যকর ঠেকবেই। তারা ভুলে যান, সাগর-রুনী হত্যার পর দুই ইউনিয়নের মধ্যে গড়ে ওঠা ঐক্যের পিঠে কে ছুরিকাঘাত করেছিলেন।
স্বীকার করি, অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়ন বা পেশাজীবী সংগঠনের মতো সাংবাদিকদের ইউনিয়নেরও দু’চারজন অসৎ, ধান্ধাবাজ আছে। ইউনিয়ন নেতা হওয়ার সুবাদে নানা কমিটিতে অসদুপায় অবলম্বন করে বিত্ত বৈভব গড়েছেন এমনও আছেন বটে। কিন্তু তাদের সংখ্য আঙ্গুলে গোনার মতো।
স্বাধীন বাংলাদেশে চার যুগের সাংবাদিক ইউনিয়নে অতীতে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, বর্তমানে যারা দিচ্ছেন তাদের পঁচানব্বই ভাগই ইউনিয়নের জন্য, সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের জন্য নিবেদিত। অকাতরে ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং করছেন। তারা সহকর্মী, সহযোদ্ধাদের জন্য কিছু করতে পারলে তৃপ্তি লাভ করেন। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে যুগ যুগ ধরে ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে লেগে আছেন এক ধরণের নেশাগ্রস্ত হয়ে। তারা ধান্ধা বুঝেন না, চান্দা তুলতেও অযোগ্য। সংগ্রামী চরিত্রের কারণে সক্রিয় আছেন নিরন্তর। আর সংগঠন পরিচালনার জন্য চাঁদা তোলাতো দোষণীয় নয়। কেবল ইউনিয়ন নয়, সাংবাদিকদের সব সংগঠনই চাঁদা বা অনুদাননির্ভর। তা না হলে সংগঠন পরিচালনায় সদস্যদের মোটা অংকে মাসিক চাঁদা দিতে হবে।
সাংবাদিক ইউনিয়নের গৌরবময় ও সোনালী অতীত যারা দেখেননি বা জানেন না তারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেই পারেন। সাংবাদিকরা এখন যে সুবিধা ভোগ করছেন তার সিংহভাগই সাংবাদিক ইউনিয়নের আন্দোলনের ফসল। আগ্রাসী সরকারের বেপরোয়া দমন-নিপীড়নের মধ্যেও সাংবাদিকদের যেটুকু নিরাপত্তা বা রক্ষাকবচ তা সাংবাদিক ইউনিয়ন বা সংঘ শক্তি আছে বলেই। আর বিভক্তির কারণে সাংবাদিক ইউনিয়ন এখন অনেক দুর্বল, এ কথাও অসত্য নয়। ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। ঐক্যবদ্ধ শক্তিই যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা বা লক্ষ্য অর্জন করতে পারে, এ যুক্তিও অকাট্য। কিন্তু একটি সমাজের সর্বস্তরে যখন বিভক্তির বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে তখন সাংবদিকরা ভিন গ্রহের বাসিন্দা হয়ে রাজনৈতিক বিভেদ বা মতাদর্শগত বিভাজনের উর্ধে থাকা দূরহ।
এবিএম মূসা, নির্মল সেন, আনোয়ার জাহিদের মতো সাংবাদিক নেতারা সরাসরি রাজনীতি ও দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেও সাংবাদিক সমাজের অধিকার আদায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন।
ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক ইউনিয়নেরও যে ব্যর্থতা নেই তা কিন্তু নয়। ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সব সংবাদপত্র যখন এক কলমের খোঁচায় বন্ধ করে দেওয়া হলো তখনও কিন্তু সাংবাদিক ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধ ছিল। ছিল সৎ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। দুর্বিনীত শাসককে মোকাবিলা সহজ হয়নি। ঠেকানো যায়নি হাজার হাজার সাংবাদিককে বেকারত্বের মুখে ঠেলে দেওয়ার সেই কালো অধ্যায়।
তারও আগে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের সংবাদপত্র বন্ধের কালো ধারা কিংবা নিবর্তনমূলক প্রিন্টিং প্রেসেস এন্ড পাবালিকেশন্স অর্ডিন্যান্স ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক ইউনিয়নের সময়েরই। তিয়াত্তর সালের পয়লা জানুয়ারিতে একটি রিপোর্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নামের সঙ্গে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দ ব্যবহার না করায় খ্যাতিমান সাংবাদিক, সাহিত্যিক দৈনিক বাংলার তৎকালীন সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি হাসান হাফিজুর রহমান ও সম্পাদক আবদুল তোয়াব খানের চাকরিচ্যুতি ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়ন ঠেকাতে পারেনি।
তারও আগে বাহাত্তর সালের ১৫ মর্চে ‘দ্য সুপ্রীম টেস্ট’ শিরোনামে সাহসী সম্পাদকীয়র জন্য বরখাস্ত হওয়া বাংলাদেশ অবজাভারের পথিকৃত সম্পাদক আবদুস সালামকে অবিভক্ত ইউনিয়ন পুনর্বহাল করতে পারেনি। রোধ করা যায়নি গণকন্ঠ সম্পাদক আল-মাহমুদ ও হলিডে সম্পাদক এ জেড এম এনায়েতুল্লাহ খানের অন্যায় গ্রেফতার ও দুঃসহ কারাজীবন।
স্বৈরশাসক এরশাদের ৯ বছরে সংবাদপত্র ও সাংবাদিক দলন, নিপীড়ন, কথায় কথায় সংবাদপত্র বন্ধ করা, কঠিন সেন্সরশীপের সময় সাংবাদিক ইউনিয়ন বিভাজিত ছিল না। প্রতিহত করা যায়নি। অবশ্য বাহাত্তর সালে দৈনিক গণকন্ঠ বন্ধ করে দিলে সাংবাদিক ইউনিয়ন ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়ে জিতেছিল। সারা দেশের সব সংবাদপত্র ৮ দিন বন্ধ রেখে স্বৈরাচারী এরশাদের চূড়ান্ত পতন ঘন্টা বাজাতে পেরেছিল সাংবাদিক ইউনিয়ন। এসব নিঃসন্দেহে ঐক্যের সুফল।
ঐক্যের জোরে দৈনিক দেশ, বাংলার বাণী, খবর, যায় যায় দিন, বিচিন্তা প্রভৃতি বন্ধ করে দেওয়া পত্রিকা দেরিতে হলেও পুনঃপ্রকাশ সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন দুই ইউনিয়ন এক সঙ্গে সংবাদমাধ্যমে লাগাতার ধর্মঘট ডাকলে তা কি বাস্তবায়ন সম্ভব? সরকারের কাছ থেকে সুবিধাভোগী নতজানু মালিকদের মতের বাইরে কতজন সাংবাদিক বন্ধু ইউনিয়নের সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাকে একাত্ম হতে পারবেন? চেয়ার হারানোর ঝুঁকি নিতে পারবেন? কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষায় গড়ে উঠা মিডিয়া হাউজে চাকরি করে কতটা প্রতিবাদী হতে পারবেন? বিশেষ জায়গার ফোনে প্রতিদিন কত সংবাদ কিল করছেন, ব্ল্যাক আউট করছেন তা ভেবে দেখেছেন? সত্য ও স্পষ্ট উচ্চারণের কারণে মহল বিশেষের নির্দেশে কত গুণী ব্যক্তিকে টকশো’তে কালোতালিকাভূক্ত করেছেন তার হিসেব কষেছেন?
সব দোষ নন্দঘোষ সাংবাদিক ইউনিয়ন ও নেতাদের দিয়ে কী লাভ? আসুন, প্রত্যেকে যার যার জায়গা থেকে সাহস সঞ্চয় করে অন্যায়, অবিচার, অবৈধ হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি, রুখে দাঁড়াই। নতজানু না হয়ে শির উঁচু করে একবার গর্জন করি। তবেই মুক্তি।
লেখক : এম আবদুল্লাহ, সাংবাদিক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে