রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:০৮ অপরাহ্ন
কালের খবর (আপেল মাহমুদ): আদিয়াবাদ, আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের আর দশটা গ্রামের মতোই। চারদিকে গাছগাছালি, ফলমূলের বাগান, সবুজ ধানক্ষেত।
আছে পাখির কলরব। তবে গ্রামটিতে একটি সম্পদ রয়েছে, যা অন্যান্য জনপদ থেকে এটিকে আলাদা করেছে। এনে দিয়েছে বিশেষ পরিচিতি।নরসিংদী জেলা শহরের আরশীনগর থেকে স্কুটার কিংবা ব্যাটারিচালিত অটোয় চড়ে খানেবাড়ী রেলস্টেশন এবং সেখান থেকে রিকশায় চেপে পৌঁছানো যায় আদিয়াবাদে। গ্রামটির সিকদারপাড়ার দারোগাবাড়িতে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আদিয়াবাদ সাহিত্য ভবন ও ভাষাতত্ত্ব কেন্দ্র। প্রায় ৬৫ বছরে প্রতিষ্ঠানটি হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়েছে অনেকদূর। বৈশিষ্ট্যগুণে এরই মধ্যে এটি স্থানীয়ভাবে ‘মিনি শান্তিনিকেতন’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
আদিয়াবাদ সাহিত্য ভবন ও ভাষাতত্ত্ব কেন্দ্রে দেখা হলো অশীতিপর জ্ঞানবৃক্ষ প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামানের সঙ্গে। ভাষাতত্ত্বের শিক্ষক হিসেবে তিনি প্রায় কিংবদন্তিতুল্য।
একুশে পদক, বাংলা একাডেমিসহ আরো অনেক পুরস্কারে ভূষিত এই ব্যক্তিত্ব। ১৯৫৪ সালে তিনি নিজ হাতে গড়ে তোলেন সাহিত্য ভবন ও ভাষাতত্ত্ব কেন্দ্রটি। মানুষ গড়ার সেই কারিগর এখন বেশির ভাগ সময় কাটান সারা জীবনে অর্জিত প্রায় ১৫-১৬ হাজার দুষ্প্রাপ্য বই, পত্র-পত্রিকা ও জার্নাল নিয়ে। এসবের একেকটি অসাধারণ প্রকাশনা। মূলত গবেষক ও এমফিল ডিগ্রি অর্জনে আগ্রহীদের উপযোগী বই-পুস্তক আর জার্নাল দিয়ে তিনি কেন্দ্রটি সাজিয়েছেন।
ভাষাতত্ত্বের বিভিন্ন প্রকাশনার পাশাপাশি শতাধিক লেখকের অভিধানগ্রন্থেরও বিশাল সংগ্রহ রয়েছে তাঁর। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত আঞ্চলিক অভিধান, সুবল চন্দ্র মিত্রের বাংলা অভিধান, ফারসি বাংলা অভিধান ও ঐতিহাসিক অভিধানসহ দেশি-বিদেশি প্রায় দুই শ লেখকের লেখা অভিধানগ্রন্থ রয়েছে এখানে। রয়েছে কয়েক হাজার পুরনো পত্রিকা-জার্নাল, জীবনীগ্রন্থ, বাংলা সাহিত্য ও সমালোচনা গ্রন্থ। লোকসাহিত্য, বাউল সাহিত্য, মধ্যযুগের আলাউল, দৌলত কাজী ও মীর ফয়জুল্লাহর বই থেকে শুরু করে ইবনে খালদুনের আল মুকাদ্দিমা কিংবা নীহার রঞ্জন রায়ের বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা কেন্দ্রের তাকে থরে থরে সাজানো রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিম থেকে শুরু করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও অধ্যাপক ড. আবদুল হাইয়ের মতো বিদগ্ধ লেখকের বইয়েরও কমতি নেই।
ড. মনিরুজ্জামান সংগৃহীত বই-পুস্তক আর পত্রিকা-জার্নালের গায়ে লেগে থাকা ধুলার আস্তরণ মুছছিলেন নিবিষ্ট মনে। কেন্দ্রে বসেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। দীর্ঘ আলাপচারিতায় অনেক বিষয়ই উঠে আসে।
জানা গেল, ড. মনিরুজ্জামানের বাবা নাদিরুজ্জামান ব্রিটিশ শাসনামলে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে চাকরি করেন। কলকাতায় থাকার সময়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি শাহাদাৎ হোসেন প্রমুখের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তখন তিনি ভারতবর্ষ, মোহাম্মদী, সওগাতসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি তখন কলকাতা ও দিল্লির পাশাপাশি লন্ডন থেকেও বিভিন্ন ইংরেজি বই এনে পড়তেন; যার বিশাল একটি সংগ্রহ ড. মনিরুজ্জামানের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য ভবন ও ভাষাতত্ত্ব কেন্দ্রকে সমৃদ্ধ করেছে।
ড. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বাবার বই সংগ্রহ থেকেই বই-পুস্তককে ভালোবাসতে শিখি। সেটা আমার অস্থি-মজ্জায় বাসা বেঁধে আছে। মা মোসাম্মাৎ ফরিদান্নেসা খুব একটা পড়াশোনা করেননি। তবে তিনি পুরো এলাকায় নারীশিক্ষা, মেয়েদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। তাঁর কল্যাণেই আমি দেশ-বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা ও বিভিন্ন ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষকতা, গবেষণা এবং বেশ কিছু বই-পুস্তক লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। শেষ জীবনে সাহিত্য ভবন ও ভাষাতত্ত্ব কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এরই শেষ পরিণতি। ’
সাহিত্য ভবনের বিরল প্রকাশনার টানে দেশি-বিদেশি অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তি, কবি-সাহিত্যিক সেখানে ছুটে গেছেন। তাঁদের একজন ব্রিটিশ গবেষক ও কবি উইলিয়াম। বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি আদিয়াবাদে একাধিকবার এসেছেন। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসেছেন একবার। তিনি ছিলেন ড. মনিরুজ্জামানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন এবং চট্টগ্রাম কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী। এ ছাড়া ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ধ্বনিতত্ত্ববিদ ড. আবদুল হাই, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মঞ্জুরে মাওলাসহ আরো অনেক গুণীজন এসেছেন এখানে। এর মধ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন তাঁর বিয়ের কাজি এবং অধ্যাপক ড. আবদুল হাই তাঁর শ্বশুর।
নিরহংকারী ও প্রচারবিমুখ এই অধ্যাপক শিক্ষকতাজীবনের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছেন চট্টগ্রামে। মাঝে অল্প সময়ের জন্য ঢাকামুখী হলেও পরবর্তী সময়ে আবার চট্টগ্রামে ফিরে গেছেন। আর জীবনের অনেক কাজই করে গেছেন নিভৃতচারীর মতো। মেধা-মননে অন্য অনেকের চেয়ে এগিয়ে থেকেও যোগ্য সম্মান-স্বীকৃতি না পাওয়া এর একটা কারণ বটে। যদিও এ নিয়ে এই জ্ঞানবৃক্ষের মধ্যে কোনো ক্ষোভ, ক্লেশ বা গ্লানি নেই। অবসরে যাওয়ার পর থেকে নিজের গড়া প্রতিষ্ঠানটি নিয়েই আছেন। দেশি-বিদেশি অনেক গবেষক এই সংগ্রহশালা থেকে উপকৃত হচ্ছেন—এটাকে জীবনের বড় সার্থকতা বলে মনে করেন তিনি।
কালের খবরকে ড. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ভাবছি, আমি মরে গেলে প্রতিষ্ঠানটি কে দেখবে। বইয়ের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠেকে সেটা বলতে পারছি না। স্ত্রী বয়সের ভারে নুব্জ। একমাত্র ছেলে সস্ত্রীক যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। আইটি বিজ্ঞানী হিসেবে বইয়ের পরিবর্তে পিসি-সফটওয়্যার কিংবা গ্রাফিকস এনিমেশন নিয়েই সময় কাটে তার। প্রতিদিনই উইয়ের পেটে চলে যাচ্ছে দুষ্প্রাপ্য অনেক বই-পুস্তক। যত্নের অভাবে বেশ কিছু মূল্যবান প্রকাশনা নষ্ট হয়ে গেছে। বয়সের কারণে ঠিকমতো দেখাশোনাও করতে পারি না। সারা জীবনে অর্জিত যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখা বই-পুস্তক আর প্রতিষ্ঠানটির উত্তরাধিকার পাচ্ছি না। ’
আদিয়াবাদেই কথা হলো ড. মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে। তিনি নরসিংদী প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং একজন সাহিত্যপ্রেমী। তিনি বলেন, “প্রায়ই স্যারের (ড. মনিরুজ্জামান) কাছে আসি। তিনি ঢাকায় থাকলেও সময় পেলেই নিজের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য ভবনে চলে আসেন। এ প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে তাঁর অনেক পরিকল্পনা। এখান থেকে ‘নিসর্গ বার্তা’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। তিনি বাংলা ভাষাভাষী গবেষক আর জ্ঞানপিপাসুদের জন্য সাহিত্য ভবন ও ভাষাতত্ত্ব কেন্দ্রের একটি স্থায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য কাজ করছেন। তাঁর অনেক দুষ্প্রাপ্য এবং প্রয়োজনীয় বই-পুস্তক চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেগুলো একত্র করে তিনি নিজ বাড়িতে একটি ‘মিনি শান্তিনিকেতন’ গড়ে তুলে জীবনের অবসান চান। ”
দৈনিক কালের খবর /২৩/৪/১৮