গোটা বিশ্বে এখন মহামারীকাল চলছে। মানুষ খুবই অসহায়। মানুষ সাহায্য চাইছে। মানুষ মানুষের হাতের দিকে তাকাচ্ছে। এই সময়েও পুরো বিশ্বে চলছে অন্য ধরনের মহড়া। ফোর্বস ম্যাগাজিন জানাচ্ছে, এই প্যানডেমিক বছরে বিশ্বে নতুন ৫০০ বিলিয়নিয়ারের জন্ম হয়েছে! এদের প্রত্যেকের গড় বয়স ৫৪ বছর।
মজার কথা হচ্ছে, এদের অনেকেই প্যানডেমিক রিলেটেড আইটেম বানিয়ে, বাজারজাত করে, মুনাফা করে এই বিলিয়নিয়ার বনে গেছেন রাতারাতি। আর আমেরিকার বিলিয়নিয়াররা ৪৪ শতাংশ বেশি ধনবান হয়েছেন এই সময়ে! না, বিশ্বের ধন-সম্পত্তি নিয়ে কথা বলা আমার আজকের লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমি বলতে চাইছি এই সময়ের সাংবাদিকতা নিয়ে।
২০২০ সালের মার্চ মাসে প্যানডেমিকের কারণে যখন ঘরবন্দি হই তখন টিভি দেখেছি খুব বেশি। এই সময়ে একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি, বড় চ্যানেলগুলোর নিউজগুলো থাকত খুবই টান টান! যেন মনে হতো- এই বুঝি সবকিছু ভেঙে পড়ল! এটা যে সংবাদ ট্যাকনিক, তা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু মিথ্যে বলা যাবে না, প্রতারণা করা যাবে না, এটা বিশ্বের সকল বড় মিডিয়া মোগলরা জানেন এবং মানেন।
কিছুদিন আগে ভারতের একটি অনলাইন টিভিতে একজন অধ্যাপকের যৌন কেলেঙ্কারি নিয়ে একটি নিউজ দেখছিলাম। সেখানে এক মিনিটের মাঝে সাতবার ওই অধ্যাপকের নামই শুধু নেয়া হচ্ছিল! যেন মনে হচ্ছিল, খুন করার চেয়েও কোনো জঘন্য ঘটনার লাইভ দেখছি। বিষয়টি তেমন কিছুই ছিল না।
দু’লাইনের নিউজ হতে পারে বড়জোর। তাহলে এমন ভুয়া ‘সংবাদ কসরত’ করা হচ্ছে কেন? কারণ হচ্ছে- দৃষ্টি আকর্ষণ! এই সময়ে ব্যাঙের ছাতার মতো বেড়ে ওঠা ‘হ্যান্ডমিডিয়া’গুলো নিজেদের প্রচার চায়। লাইক চায়। শেয়ার চায়। ইউটিউবে প্রচার চালিয়ে টুপাইস কামাতে চায়! মিথ্যে গসিপ বানিয়ে এমন অর্জন যে বৈধ নয় তা তারা জানে।
তারপরেও দাপট দেখাচ্ছে। নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিচ্ছে। নিজের হাতে মিডিয়া আছে, এমন ভয় দেখাচ্ছে ভুক্তভোগী মানুষকে। হাতে রাখা একটি মোবাইল ফোন দিয়ে ছবি তোলা যাচ্ছে। লাইভ করা যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দুলাইন লিখে তা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে। ভাইরাল হওয়া যাচ্ছে। এই কাজগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে কারা? এবং কেন করছে?
ইউরোপ আমেরিকায় নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের এমপ্লয়ি জার্নালিস্টদের পরিচয়পত্র দেয়া হয়। এই পরিচয়পত্রে লেখা থাকে, ‘আমাদের সাংবাদিককে তার পেশাগত কাজে সহযোগিতা করুন।’ যদি পুলিশ ব্যারিকেড অতিক্রম কিংবা বিশেষ নিরাপত্তা বেষ্টিত সেমিনার, মিটিং কভার করার দরকার হয়, তাহলে পুলিশের অধিদফতর থেকে পাস আনতে হয়। সেটাও ওই সংস্থাটি আনিয়ে দিয়ে থাকেন।
এবার আসা যাক নাগরিক সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে। আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েড যখন আক্রান্ত হন- তখন পথচারীরাই তাদের মোবাইল ফোনে তা ধারণ করে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এটা নৈতিক এবং মানবিক কারণ। এমনটি করা যেতেই পারে। কিন্তু মোবাইল ফোনে কারও অনৈতিক ভিডিও ধারণ করে তা দিয়ে তাকে জিম্মি করা চরম অনৈতিক অপরাধ।
এসব কাজ সাধারণত অশিক্ষিত, বর্বরতম কোনো রাষ্ট্রেই সাধিত হয়ে থাকে! যেসব কাজ আজকের বাংলাদেশে হচ্ছে দেদার। একজন লোক অবৈধ মোটর সাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। তারা তিনজন একই বাইকে। মাথায় হেলমেট নেই। বাইকের বৈধ কাগজ নেই। তার নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। অথচ বাইকে স্টিকার লাগানো- ‘সাংবাদিক’।
পুলিশ তাকে আটকালে, তিনি হুংকার দিয়ে বলছেন আমি সাংবাদিক! আচ্ছা, সাংবাদিক কি ওসব অবৈধ কাজগুলো করতে পারেন? তাকে এমন বৈধতা কোন আইন দিয়েছে?
বাংলাদেশে ছবি তুলে, মানুষকে বিভিন্নভাবে টোপ দিয়ে টাকা কামানোর ধান্দা এখন খুবই বেড়েছে। এদের ঠেকানো দরকার। আরেকটি বিষয় আজকাল বলা হয়ে থাকে, সোর্সের মাধ্যম! কে সেই সোর্স ? কি সত্যতা থাকে এসব সোর্সের? এই বিষয়ে কিছু আন্তর্জাতিক মতামত এখানে তুলে ধরা যেতে পারে।
সোর্সকে বলা হয়ে থাকে ‘হুইসেলব্লোয়ার’। এখনকার সাংবাদিকরা হুইসেলব্লোয়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বিভিন্ন সংকেতে। কখনো চ্যাটিং অ্যাপে। কিংবা তথ্য বিনিময় করেন ড্রপবক্সে। তাদেরকে এখন প্রত্যন্ত মাঠে যেতে হয় না। প্রযুক্তির এই পরিবর্তনের কারণে সাংবাদিক ও সোর্সের মধ্যে বোঝাপড়ার শর্ত কেমন হবে, এ নিয়েও বেশ অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। ২০১৯ সালে ইতালির পেরুজিয়া শহরে এ নিয়ে একটি বৈঠক হয় সংবাদবেত্তাদের।
এতে বলা হয়েছে- “আলোড়ন তৈরি করার মতো অনেক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ডিজিটাল যুগ। স্নোডেন ফাইলস বা পানামা পেপার্স তারই প্রমাণ। শক্তিশালী ডিজিটাল সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকায় হুইসেলবেøায়াররা এখন জনস্বার্থে বিপুল পরিমাণ তথ্য ফাঁস করতে পারে। একই সুবিধা আবার নিরাপত্তা বাহিনীও পাচ্ছে।
হুইসেলব্লোয়ারদের খুঁজে বের করতে কিংবা আটকের জন্য তাদের কাছেও অভূতপূর্ব ক্ষমতা রয়েছে। এই লড়াইটা মোটেও সমতার নয়, বিশেষ করে সরকারি নিরাপত্তা সংস্থা যখন আপনার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।” এক্ষেত্রে সাংবাদিকের কৌশল হবে ডিজিটাল আর মানবিক, দুইয়ের সমন্বয়ে। সঠিক সময়ে সঠিক টুলটি ব্যবহারের মতো দূরদর্শিতা থাকতে হবে।
সেই সঙ্গে যতটা পারা যায় তথ্য ফাঁসের ঝুঁকি হ্রাসের প্রত্যয় থাকতে হবে। পেরুজিয়া নীতিমালায় মোট ১২টি বিষয় রয়েছে। প্রথমত, সোর্সকে নিরাপদ রাখুন। অনুরোধ করলে, তার নাম প্রকাশ থেকে বিরত থাকুন। এই নিয়মাবলিতে বলা হয়েছে- “কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া গোপন সোর্স বা হুইসেলব্লোয়ারের নাম প্রকাশ থেকে বিরত থাকবেন (ব্যতিক্রম: যখন কোনোভাবেই পরিচয় লুকানো সম্ভব হচ্ছে না এবং মানুষের প্রাণহানি এড়ানোর জন্যে নাম প্রকাশ জরুরি)- এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই।
বিভিন্ন দেশের আইনেও এই সুরক্ষা দেয়া হয়েছে।” দ্বিতীয়ত- সোর্স যাতে আপনার সাথে নিজ থেকে যোগাযোগ করতে পারে সেজন্য নিরাপদ ব্যবস্থা রাখুন। “আপনার সাথে নিরাপদে যোগাযোগের পদ্ধতি এমনভাবে প্রচার করুন, যাতে হুইসেলব্লোয়াররা পরিচয় লুকিয়ে এবং এনক্রিপ্টেড চ্যানেলের মাধ্যমে তথ্য দিতে পারে”- বলা হয়েছে নীতিমালায়।
তৃতীয়ত, গোপন তথ্য ফাঁসের কারণে হুইসেলব্লোয়ারের কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে তা চিহ্নিত করুন। প্রতিবেদনটি যখন প্রকাশ হবে, তখন তারা কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দেবেন, তা নিয়ে আগে থেকেই তাদেরকে চিন্তা করতে বলুন।
চতুর্থত, জনস্বার্থের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার নিরিখে হুইসেলব্লোয়ারের দেয়া তথ্য যাচাই করুন; তার মতাদর্শ বা আচরণ সম্পর্কে আপনার ব্যক্তিগত মূল্যায়নের ভিত্তিতে নয়। পঞ্চমত, নিজেই নিজের ডিজিটাল সুরক্ষা নিশ্চিত করুন এবং এনক্রিপশন ব্যবহার করুন। এনক্রিপশন শতভাগ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয় না, কিন্তু এটাই সুরক্ষার প্রথম ধাপ।
মনে রাখতে হবে সোর্স ও হুইসেলব্লোয়ারের সাথে সাংবাদিকের নিরাপদ ডিজিটাল যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে এনক্রিপশন, যা ভ‚মিকা রাখছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায়ও। এটি গোপনীয়তা বজায় রাখার প্রাথমিক মানদণ্ড, কিন্তু তারপরও নিরাপত্তার শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারে না।
যেমন- সোর্সের সঙ্গে মুখোমুখি আলাপের সময় মোবাইল ফোনের ডিজিটাল ডাটা অনুসরণ করে তার ভৌগোলিক অবস্থান বের করা সম্ভব। ষষ্ঠত, আপনি এবং আপনার সোর্সের সম্ভাব্য বড় হুমকিগুলো কী, দুজনই নিরাপদ থাকার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায় সেগুলো খুঁজে বের করুন।
সপ্তমত, ডিজিটাল মাধ্যমের সম্ভাব্য ঝুঁকি আপনার সোর্সকে ব্যাখ্যা করুন। সংবেদনশীল প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিন। অষ্ঠমত, সংবাদ ঘটনার স্বার্থেই ডাটাসেট প্রকাশ জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। তাই সম্ভব হলে কিংবা নিরাপদ মনে করলে প্রতিবেদনের প্রয়োজন মাফিক মূল ডকুমেন্ট এবং ডাটাসেট প্রকাশ করুন।
নবমত, সোর্স চাইলে, গোপনীয়তার স্বার্থে তার দেয়া ডাটা নিরাপদ উপায়ে মুছে ফেলুন। তবে সেটি যেন নৈতিকতা, আইন ও নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। দশমত, ঝুঁকিপূর্ণ তথ্য এবং সোর্স বা হুইসেলব্লোয়ারের নাম পরিচয় গোপন রাখতে চাইলে ড্রপবক্স ব্যবহার করুন। এটি নিরাপত্তার দিক থেকে বেশ কার্যকর।
এগারোতম, গোপন সোর্স ও হুইসেলব্লোয়ারের নিরাপত্তায় রাষ্ট্রীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে জানুন। বারোতম, সাংবাদিক, সোর্স এবং সংরক্ষিত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানেরও দায়িত্ব। উৎসাহ দিন, যেন তারা কর্মী-প্রশিক্ষণ এবং নীতিমালা তৈরির মাধ্যমে, সেই দায়িত্ব পালন করে।
আপনি প্রতিষ্ঠানের মালিক হলে, আপনার প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল নিরাপত্তায় যথাযথ কৌশল নিয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করুন। তাতে সোর্স ও হুইসেলব্লোয়ারের সঙ্গে গোপন যোগাযোগের বিষয়টি যেন অন্তর্ভুক্ত থাকে। অ্যানালগ সুরক্ষা, ডিজিটাল নিরাপত্তা, আইনি কাঠামো এবং প্রশিক্ষণ- সব কিছুর সমন্বয় ঘটাতে হবে।
আপনি যদি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হন তাহলে সহযোগিতার জন্য এই বিষয় নিয়ে কাজ করা ট্রেড ইউনিয়ন অথবা এনজিওগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আজকের সময়ে এসব বিষয় জানা এবং মানা খুবই দরকারী। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যে ডিজিটাল আইন রয়েছে, এর কার্যকারিতা ও প্রয়োগ দুটোই সাংবাদিক এবং প্রশাসনকে জানতে হবে, মানতে হবে।
আমি প্রস্তাব করি, বাংলাদেশের প্রত্যেকটি প্রেসক্লাবে যে সংবাদ সম্মেলন হয়, এর লাইভ প্রচার নিষিদ্ধ করতে হবে। তা নিরুৎসাহিত করতে হবে। বাংলাদেশে ‘জার্নালিস্টস জুডিসিয়াল সার্কেল’ গঠন করা সময়ের দাবি। এই জুডিসিয়াল সার্কেলে প্রেসক্লাব, অনলাইন প্রেসক্লাব, ইউটিউব চ্যানেল প্রতিনিধিদের দ্বারা একটি শক্তিশালী কমিটি থাকবে। যারা আদালতে যাওয়ার আগে, বিষয়গুলো নিষ্পত্তির চেষ্টা করবেন।
তারা সাংবাদিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। বিশ্বের জার্নালিজমের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে শিক্ষানবিসদের পাঠদান করবেন। সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। এটাকে কলুষিত হতে দেয়া যায় না। তাই সকল মিডিয়া ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বকে এ বিষয়ে সচেতন ও মনোযোগী হতে হবে। রাষ্ট্রে সাংবাদিকতার নীতিমালা আছে। তা মানতে হবে সবাইকেই। তা না হলে এই মহান পেশার প্রতি মানুষের বিশ্বাসহীনতা দেখা দেবে দিনে দিনে।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট।