শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৭ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের খবর :
ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে জামিন দেননি হাইকোর্ট। তার জামিনের আবেদন উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করেছেন।
বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খিজির হায়াতের আদালত মঙ্গলবার এ আদেশ দেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় সাইবার ট্রাইব্যুনাল জামিনের আবেদন খারিজ করায় হাইকোর্টে জামিন আবেদন করা হয়। আজ আদালতে মোয়াজ্জেম হোসেনের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. আহসান উল্লাহ ও অ্যাডভোকেট সালমা সুলতানা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রেজাউল করিম। এসময় মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে মামলাকারী ব্যারিষ্টার সায়েদুল হক সুমনও উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে আজ শুনানিকালে আদালত ওসির কার্যক্রমে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, সবার কথা বলছি না। কিছু কিছু ওসি, ডিসি আছেন যারা নিজেদের জমিদার মনে করেন।
কানে কম শুনলে ওসি থাকে কি করে?
শুনানির শুরুতে মোয়াজ্জেম হোসেনের আইনজীবী বলেন, উনার (মোয়াজ্জেম হোসেন) বিরুদ্ধে যে মামলা, তা জামিনযোগ্য। তাতে সাজা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন নয় যে, তাকে জামিন দেওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, এটি একটি ভিত্তিহীন মামলা। তাছাড়া দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে সে ভিডিও করেছে। তার বয়স হয়েছে, হার্টেও সমস্যা আছে। তাই জামিন চাচ্ছি।
এসময় আদালত বলেন, আপিনি কি ভিডিও’র (যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছিল) কথাগুলো শুনেছেন? জবাবে আইনজীবী বলেন, ওসি মোয়াজ্জেমেরে কান খারাপ। কানে সমস্যা আছে। উনার কানের চিকিৎসা হচ্ছে। আদালত বলেন, কানে কম শুনলে ওসি পদে থাকে কি করে?
সাংবাদিকরা সমাজের দর্পন
আইনজীবী বলেন, তিনি কোনো অপরাধ করেননি। তার কাছ থেকে ভিডিওটি নিয়ে সজল নামের একজন সাংবাদিকের হাতে যায়। সেখান থেকেই ভিডিওটি ছড়িয়েছে বলে আশঙ্কা। এসময় আদালত বলেন, যে আশঙ্কা করছেন, ওটা সাংবাদিকদের হাতে গেলে আগেই প্রকাশ পেত। সবাই সচেতন হয়ে গেলে মেয়েটিকে আর মরতে হত না।
আইনজীবী বলেন, সাংবাদিকরাতো এখন তেলাপিয়া মাছের মত। তখন যদি ভিডিও(নুসরাতের বক্তব্য) না করে মামলা নিত তাহলে এদের (সাংবাদিকদের) কেউ কেউ প্রশ্ন করত কত টাকা খেয়ে প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
এসময় আদালত বলেন, এই ঘটনার পেছনে সাংবাদিকরা যদি শুরু থেকেই লেগে থাকত তাহলে এই ঘটনা (নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া) হয়তো ঘটত না।
আদালত আরো বলেন, সাংবাদিকরা সমাজের দর্পন। তারা না থাকলে সমাজের এইসব ঘটনা এইভাবে প্রকাশ পেত না। আমরাও জানতে পারতাম না। তারা আছেন বলেই দেশের মানুষ এসব জানতে পারছে। এসময় আইনজীবী বলেন, শর্সের মধ্যেও ভূত আছে।
কিছু কিছু ওসি, ডিসি আছেন যারা নিজেদের জমিদার মনে করেন
এরপর জামিনের বিরোধতা করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এটি একটি বানিং ইস্যু। নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেছেন, আবার ভাইরালও করেছেন। উনাকে জামিন দেওয়া হলে সমাজের কাছে ম্যাসেজটা কী যাবে? এসময় আদালত তার কাছে জানতে চান, ওসি মোয়াজ্জেম কতদিন ধরে কারাগারে আছেন। জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মাস খানেক।
মোয়াজ্জেম হোসেনের শারীরিক অবস্থা আদালত জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তার শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। মামলাটি কী পর্যায়ে আছে আদালত জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, অভিযোগ আমলে নিয়েছে। বুধবার অভিযোগ গঠনের শুনানি। একজন পুলিশ অফিসারের এমন দায়িত্বহীন কাজ মেনে নেওয়া যায় না
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এই ভিডিওতে অশ্লীলতা আছে। একজন পুলিশ অফিসার এমন প্রশ্ন করে? এসব প্রশ্ন করা কতটা ঠিক! আবার অনুমতি ছাড়া ভিডিও করে! এভাবেই ভিডিও করে তা ভাইরাল করে দেওয়া হয়েছে। একজন পুলিশ অফিসারের এমন দায়িত্বহীন কাজ মেনে নেওয়া যায় না।
এসময় আদালত বলেন, সবার কথা বলছি না। কিছু কিছু ওসি, ডিসি আছেন যারা নিজেদের জমিদার মনে করেন। তারাই অল ইন অল (নিজেই সব)। অন্যান্য দেশেও যে নেই, তা না। তবে আমাদের দেশে এগুলো বেশি হয়। দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে তার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিও সমান দায়ী
নুসরাত কেন থানায় গিয়েছিল আদালত তা জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, নিরাপত্তার জন্য হয়ত। এফআইআর বা অভিযোগ করতে হয়ত গিয়েছিল। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মেয়েটাকে অবান্তর প্রশ্ন করা হল। মজা করল, ভিডিও করল, এভাবে মজা করার কী সুযোগ আছে? তারপর সেটা ভাইরালও করে দিল। কতটা দায়িত্বহীন। সে বলতে পারত, তোমার লিখিত বক্তব্য দিয়ে যাও।
এসময় আদালত বলেন, দেখলাম মামলা হওয়ার পরও পুলিশ কিছুই করছে না। তখন যদি নিরাপত্তা দিতো বা অ্যাকশন নিতো তাহলে হয়ত এই ঘটনা ঘটত না। আদালত বলেন, দায়িত্ব বা ক্ষমতা থাকার পরও সে দায়িত্ব পালন না করার কারণে যদি কোনো দুর্ঘটনা বা অপরাধ ঘটে তবে তার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই ব্যক্তিও সমান দায়ী। এসময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীতে যারা আছেন তাদের এরকম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এ পর্যায়ে ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী আদালতকে বলেন, মোয়াজ্জেম হোসেন খুবই দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি যে ভিডিওটি করেছেন, সেখানে তার মা-ভাই ও একজন নারী পুলিশের উপস্থিতিতে বক্তব্য দিয়েছে। ওসি তাকে মা সম্বোধন করেছে। এসময় তিনি ভিডিও রেকর্ডের বক্তব্য পড়ে শুনাতে থাকলে আদালত বলেন, এসব প্রশ্ন করে পুলিশ? সবই যদি পুলিশই করবে, তাহলে আদালত কী করবে? আপনি-আপনারা কী করবেন? আদালত বলেন, আমরা জামিন দেব না।
মোয়াজ্জেমের আইনজীবী বলেন, পুলিশকে হেয় করার জন্যই এরকম উদ্ভট একটি মামলা করা হয়েছে। এসময় আদালত বলেন, এটা পুলিশ নয়, একজন ব্যক্তি জড়িত। পরে জামিন আবেদন উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করেন আদালত।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে গত ১৬ জুন হাইকোর্টে হাজির হন মোয়াজ্জেম হোসেন। এরপর তার আগাম জামিনের আবেদন করা হয়। এই আবেদনের ওপর বিচারপতি মো. মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানির অনুমতি চেয়ে আবেদন জানানো হয়। আদালত পরদিন শুনানির জন্য রাখার আদেশ দেন। এরপরই ওইদিন তাকে হাইকোর্ট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন ১৭ জুন তাকে সাইবার ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে আদালত তার জামিনের আবেদন খারিজ করে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। সেই থেকে তিনি কারাবন্দি।
ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে তার মা ২৭ মার্চ থানায় অভিযোগ দাখিল করেন। এরপর ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন নুসরাতকে থানায় ডেকে নিয়ে তার জবানবন্দী রেকর্ড করেন এবং তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন। পরবর্তীতে গত ৬ এপ্রিল নুসরাতে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১০ এপ্রিল মারা যান নুসরাত। এ ঘটনায় পৃথক একটি মামলায় তদন্ত শেষে ১৬ জনের বিরুদ্ধে ২৯ মে ফেনীর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন(পিবিআই)।
নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার পরই নুসরাতের জবানবন্দীর(ওসির কাছে দেওয়া) বিষয়টি সকলের সামনে আসে। এ অবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিষ্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ঢাকার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে গত ১৫ এপ্রিল মামলা করেন। ট্রাইব্যুনাল বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৬, ২৯ ও ৩১ নম্বর ধারা লংঘনের অভিযোগ আনা হয় ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে। এই প্রতিবেদন পাবার পর গত ২৭ মে সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এরপর পলাতক অবস্থায় আগাম জামিনের জন্য গত ২৯ মে হাইকোর্টের অবকাশকালীন বেঞ্চে আবেদন করেছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন। ওই জামিন আবেদনের ওপর আর শুনানি করেননি আইনজীবী। এরপর নিয়মিত বেঞ্চে জামিনের আবেদন করেন। কিন্তু শুনানির আগেই পুলিশ তাকে ১৬ জুন গ্রেপ্তার করে।