রবিবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২২ অপরাহ্ন
অবৈধ পন্থায় অঢেল সম্পদ ২
ওসি মোস্তফা কামালের সম্পদের পাহাড়
সাভারে দেড় কোটি টাকায় কিনেছেন ১৫ কাঠা জমি * আশুলিয়ার কাঁইচাবাড়িতে কোটি টাকায় কেনা জমিতে বাড়ি করে ভাড়া * নবাবগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া ও মুকসুদপুরে সাধারণ মানুষের দাবি- সঠিক তদন্ত হলে মিলবে আরও গোপন সম্পদ
কালের খবর রিপোর্ট ঃ
ঢাকার নবাবগঞ্জের সর্বত্রই এখন আলোচনার বিষয় ওসি মোস্তফা কামাল। প্রায় দুই বছর ৭ মাস পার হলেও একই থানায় আছেন বহাল তবিয়তে। তার অবৈধ সম্পদের হিসাব দাবি করেছেন নবাবগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া ও মুকসুদপুরের সাধারণ মানুষ।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে অবৈধ সম্পদের নানান চমকপ্রদ তথ্য। তারা দাবি করেন, সঠিক তদন্ত করলে মিলবে আরও গোপন সম্পদ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মন্তব্য- সঠিক তদন্ত করলে ওসি মোস্তফা কামালের থলে থেকে আরও বিড়াল (অবৈধ সম্পদ) বেরিয়ে আসবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওসি মোস্তফা কামাল সাভার থানায় থাকাকালে সেখানেও তিনি অবৈধ অর্থ উপার্জনের বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। ২০০০ সালে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে যোগদান করেই তিনি পুলিশের পোশাককে অবৈধ অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন। তার এমন কর্মকাণ্ড পুলিশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করেছে বলে মনে করেন ঢাকা জেলার একজন পুলিশ কর্মকর্তা।
সাভারের ব্যাংক কলোনি এলাকার এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করে কালের খবরকে বলেন, ওসি কামালের দাপটে অনেকে নীরবে চোখের জল ফেলেছে। দুদকের উচিত তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করে বিচারের আওতায় আনা। সাধারণ একজন পুলিশ কর্মকর্তার চাকরি করে এত অর্থবিত্তের মালিক হলেন কী করে, তা বোধগম্য নয়।
পুলিশের ওসি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মোস্তফা কামাল দু’হাতে টাকা উপার্জন করেন। তার অবৈধ উপার্জনের পরিমাণ প্রায় শতকোটি টাকা বলে ধারণা করছি।
সরকারি দলের একজন সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রীর (গোপালগঞ্জের) দোহাই দিয়েই তিনি সব অপকর্ম জায়েজ করে নিচ্ছেন। ওসি মোস্তফা কামালের বেতন স্কেল ৩৫ থেকে ৪২ হাজারের মধ্যে। অথচ তিনি ও তার পরিবার ঢাকা শহরে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দামি গাড়িতেও।
মঙ্গলবার ওসি কামালের অবৈধ সম্পদ অর্জন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর, ঢাকার সাভার, আশুলিয়া ও রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ ফোন করে কালের খবরকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। অনুসন্ধান করে তার অবৈধ সম্পদের তথ্য দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার জন্যও তারা অনুরোধ জানান।
সাভারের নিরিবিলি এলাকার এক জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তৎকালীন সময়ে এসআই হিসেবে মোস্তফা কামাল সাভারের অলিগলি চষে বেড়ান। কোথায় কীভাবে অবৈধ অর্থ আদায় করা যায়- এটাই ছিল তার একমাত্র নেশা।
একটি বিশেষ জেলায় (গোপালগঞ্জ) তার বাড়ি- সাধারণ মানুষকে এ ভয় দেখিয়ে তিনি ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করেছেন। সাভার থাকাকালীন নিরিবিলি এলাকায় নিজের নামে ১৫ কাঠা জমি কেনেন। যার মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। একজন সাধারণ পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি এত টাকা কোথায় পেলেন- এমন প্রশ্নও রয়েছে এলাকাবাসীর মনে।
এ ছাড়া ২০১৫ সালের দিকে আশুলিয়া থানার ওসি হিসেবে যোগদান করেই কাঁইচাবাড়ি এলাকায় কোটি টাকা মূল্যের ৮ কাঠা জমি কেনেন। যেখানে একটি বাড়ি করে ভাড়া দিয়েছেন। নানা অজুহাতে মানুষকে ধরে টাকা আদায় করেন মোস্তফা কামাল। তার চাচাতো ভাইখ্যাত বাবুলের মাধ্যমে তিনি মানুষের কাছ থেকে ঘুষের টাকা লেনদেন করেন বলেও জনশ্রুতি আছে।
সাভার ও আশুলিয়ার বাড়ি-জমি বাবুল দেখভাল করেন। বাবুলকে সব সময় থানায় ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। অনেকেই তাকে থানা পুলিশের সদস্য মনে করে ভুল করেন।
ওসি মোস্তফা কামাল নবাবগঞ্জে যোগ দেয়ার পর সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন উপায়ে মামলার ভয় দেখিয়ে গড়ে তুলেছেন নিজের বিশাল সাম্রাজ্য। ঢাকার বেশ কয়েকটি স্থানে তার নিজ নামে, স্ত্রী ও স্বজনদের নামে কিনেছেন ফ্ল্যাট, গাড়ি ও জমি। যার বর্তমান বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা। এ ছাড়া নামে-বেনামে রয়েছে ব্যাংক লেনদেন।
রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বরে পুলিশ লাইনের কাছে ইব্রাহীমপুর এলাকায় বসবাস করেন আলিশান ফ্ল্যাটে। সেটিও তার নিজের কেনা বলে জানা গেছে। রয়েছে একটি প্রাইভেট কারও। ঢাকার নামিদামি স্কুলে পড়ালেখা করে দুই সন্তান।
নবাবগঞ্জের কয়েকটি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতারাও ওসির কাছে নানাভাবে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। গত শুক্রবার ওসি তার অফিসকক্ষে ডেকে একটি জমির সালিশ মীমাংসা করেন।
সেখানেও তিনি একজন নেতাকে হুমকি-ধমকি দেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আওয়ামী লীগ নেতা কালের খবরকে বলেন, ‘আমার জমির বিষয়ে থানায় সালিশ ডেকে অর্থের বিনিময়ে প্রতিপক্ষকে জিতিয়ে দেন ওসি মোস্তফা কামাল।’ এভাবে তিনি হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। নেতাদের তিনি নানাভাবে গালমন্দ করতেও দ্বিধা করেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের অপর এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওসি কামালের মন্তব্য, ‘আমার কাছে কোনো নেতার সময় নেই। আমার বাড়ি প্রধানমন্ত্রীর এলাকায়। কেউ ভাব দেখাবেন না। নেতা গোনার সময় নেই।’ ওসির এমন দম্ভোক্তির বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না।
নবাবগঞ্জ থানার ওসিসহ পুলিশের অবৈধ লেনদেন এখন অনেকটাই বিকাশের মাধ্যমে হয় বলে জানা গেছে। থানার গেটে বসানো হয়েছে একটি বিকাশের দোকান। এটি নাকি শুধু পুলিশের লেনদেনের জন্যই বসানো হয়েছে- এমনটাই দাবি এক পুলিশ সদস্যের। ‘জিসান বিজনেস সেন্টার’ নামের ওই দোকানের বিকাশ এজেন্ট নম্বর ০১৭৪৪২২৪০৭২ খতিয়ে দেখলেই অনেক পুলিশ কর্মকর্তার অবৈধ লেনদেনের থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে পারে বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য নবাবগঞ্জ থানার ওসি মোস্তফা কামালের মুঠোফোনে পরিচয় দেয়ার পর তিনি সংযোগ কেটে দেন। এরপর খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।