সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৪ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক, কেরানীগঞ্জ, কালের খবর :
‘এই যে সীমানা পিলার দেখতাছেন, এইখান থিকা সব জমি সরকারের, মানে বুড়িগঙ্গা নদীর। কিন্তু দখলে আছেন স্থানীয় রফিক মিয়া।
আমি তিন বছরের চুক্তিতে এককালীন দুই লাখ টাকা অগ্রিম দিয়া ভাড়া নিয়া ব্যবসা করতাছি। মাসে ১০ হাজার টাকা দিই। হুনছি এ জায়গার সব কিছু সরকার বুলডোজার দিয়া গুঁড়াইয়া দিবো। তাইলে অগ্রিম দেওয়া আমার টাকার কী অইবো?’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন ‘আল্লার দান হোটেল’ নামে খাবার হোটেলের মালিক বয়োজ্যেষ্ঠ বশির উদ্দিন। বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জের খোলামোড় খেয়াঘাট এলাকায় রবিবার সকালে এই হোটেল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়।
কেরানীগঞ্জের খোলামোড় ঘাটসংলগ্ন বুড়িগঙ্গাঘেঁষা নওয়াবের চর, রায়ের চর, কাঁচের চর, কুলচর, বালুচর ও মধ্যচর এলাকায় সরকারি জমির বেশির ভাগটাই এখন স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে। সেখান থেকে নদী পার হয়ে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় গিয়েও দেখা যায়, ছোট দোকানের পাশাপাশি অনেক বহুতল ভবন নদীর জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
আর বুড়িগঙ্গা দখল হতে হতে সরু খালের রূপ নিয়েছে।
বুড়িগঙ্গার তীর দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে একের পর এক স্থাপনা। এর মধ্যে ৯০৬টি অবৈধ স্থাপনা শনাক্ত করে সেগুলো উচ্ছেদে অভিযান শুরু করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ)। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টানা তিন দিনে নদীতীরে গড়ে তোলা প্রায় ৪৫০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খোলামোড় খেয়াঘাট এলাকায় বুড়িগঙ্গার জমি দখল করে একটি বাজারের অর্ধেক অংশে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। বাজারের একটি জায়গায় বিআইডাব্লিউটিএর সীমানা পিলারের সামনের জায়গা দখল করে আছেন স্থানীয় প্রভাবশালী মজনু সরদার। সেখানে একটি নার্সারি রয়েছে। তিনি সবুজ নামে একজনের কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা অগ্রিম নিয়ে ওই জায়গা ভাড়া দিয়েছেন। পাশেই রয়েছে নিমাইয়ের কামারঘর, জুয়েলের চায়ের দোকান, মোতালেবের গোখাদ্য দোকান। এই দোকানের বিপরীত পাশে রয়েছে রেজাউল মিয়ার বাখরখানির দোকান। ওই এলাকায় বহুতল ভবনসহ এমন কয়েক শ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলোর অবস্থান বুড়িগঙ্গার সীমানার ভেতর।
রেজাউল মিয়া জানালেন, দেলু মিয়া নামে স্থানীয় একজনের কাছ থেকে ছয় বছরের চুক্তিতে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে তিনি দোকানটি ভাড়া নিয়েছেন। মাসে চার হাজার টাকা ভাড়া দেন তিনি। কয়েক দিন আগে বিআইডাব্লিউটিএর লোকজন মাইকিং করে জানিয়ে দিয়েছে যে শিগগিরই তাঁর দোকানসহ সীমানা পিলারের পরের অংশ থেকে উচ্ছেদ করা হবে।
পাশের চায়ের দোকানদার ইউসুফ বলেন, ‘আমার এই দোকানের মালিক দুজন। একজনের নাম দেলু মিয়া, অন্যজন কবির। এক বছরের চুক্তিতে তাঁদের ৭৫ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে দোকানটি ভাড়া নিয়েছি। প্রতি মাসে ভাড়া দিচ্ছি পাঁচ হাজার টাকা। এখন দোকান তো সরকার ভেঙে দিল। এই অগ্রিম টাকাটা কিভাবে পাব, তা নিয়ে ভাবনায় আছি।’
বাজার থেকে একটু এগোতেই দেখা যায়, নদীর জমি দখল করে ইট রেখে বিক্রি করা হচ্ছে। তার সামনেই বুুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষা জমি দখল করে স্থানীয় শামীম মেম্বার নামের একজন গড়ে তুলেছিলেন একতলাবিশিষ্ট সাতটি পাকা স্থাপনা। আর ওই সব অবৈধ স্থাপনায় ছিল সরিষার তেলের মিল, সেলুন, চা ও লাকড়ির দোকান। মঙ্গলবার উচ্ছেদ অভিযানের সময় তাঁর দোকানগুলোও ভেঙে ফেলা হয়।
শনিবার দুপুর ১টার দিকে দেখা যায়, ওই জমির ওপর মুখ কালো বসে আছেন লাকড়ি ব্যবসায়ী মো. হানিফ। তিনি বলেন, মাসে এক হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে শামীমের কাছ থেকে দোকান নিয়ে ব্যবসা করছিলেন তিনি। কিছু অগ্রিমও দিয়েছিলেন। উপস্থিত চায়ের দোকানদার শাহাবুদ্দিন জানান, ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে তিন বছরের জন্য শামীমের কাছ থেকে দোকানটি ভাড়া নেন তিনি।
পাশেই দেখা গেল একটি একতলা ভবনের ইট-পাথরের ভাঙা অংশ পড়ে আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এখানে স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার অর্থাৎ সাবেক এক এমপির সিমেন্টের গুদাম ছিল। এটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে। এর আগে বিএনপির শাসনামলে সাবেক এক রাজনৈতিক নেতার দখলে ছিল এই জমি ও আশপাশের বুড়িগঙ্গা তীর।
মঙ্গলবারের উচ্ছেদ অভিযানে এই ভবনের পাশের একটি চারতলা ভবনও ভেঙে দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। ভবনটির দোতলার বারান্দায় এদিনও একটি সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা যায়। তাতে লেখা রয়েছে—‘এই ভবনটি ন্যাশনাল ব্যাংক লি. খোলাপাড়া শাখার কাছে দায়বদ্ধ’। বাড়িটির ভাড়াটিয়া রফিকুল ইসলাম জানালেন, বাড়ির মালিকের নাম আতিকুল আলম স্বপন। উচ্ছেদের সময় বাড়ির অনেকাংশই ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ভাড়াটেদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার।
তবে স্বপনের বাবা আব্দুল আজিজ কালের খবরকে বলেন, ‘এই জমির মালিক আমি। আমার বাপ-দাদার সময় থেকে এই জমির বৈধ কাগজ রয়েছে। আমার দখলে রয়েছে এই জায়গা।’
জমির লাইন ধরে কিছুটা দূরে বিশাল জায়গাজুড়ে রয়েছে মশার কয়েল তৈরির কারখানা। কারখানাটির নিরাপত্তা কর্মী চান মিয়া জানান, জমির মালিকের নাম মোজ্জাম্মেল হোসেন জনি। তিনি বিদেশে থাকেন। এই ভবন লাগোয়া নদীর সীমানা প্রাচীর থাকলেও বিআইডব্লিউটিএ ভবনটি ভাঙেনি।
ঢাকা নদী বন্দর বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন কালের খবরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে নদী দখলমুক্ত করা হচ্ছে। যেকোনো মূল্যে নদীকে দখলমুক্ত করা হবে। নদীর পারে ছোট বা বড় এমনকি ২০ তলা ভবন থাকলেও তা ভেঙে ফেলার নির্দেশনা রয়েছে। নদীতীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে শুরু হওয়া অভিযান ১১ দিন চলবে। ইতিমধ্যে ছোট-বড় মিলে মোট নয়শ’ ছয়টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এগুলো উচ্ছেদ করা হবে।’
জানা গেছে, মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের তৈলঘাট এলাকা থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ। প্রথম দিনেই কেরানীগঞ্জ মডেল থানার খোলামোড়া পর্যন্ত উচ্ছেদ করা হয় দুটি সাততলা, দুটি পাঁচতলা, তিনটি দোতলা ও চারটি একতলা ভবনসহ ১৬৪টি অবৈধ স্থাপনা। বুধবার অভিযানের দ্বিতীয় দিনে ১৫০টি এবং বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানী লিমিটেডের (বিটিসিএল) কামরাঙ্গীরচর এক্সচেঞ্জের দ্বিতল ভবন, বেশ কয়েকটি স’মিল ও মিল-কারখানাসহ প্রায় ১৩০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়।