রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৯ অপরাহ্ন
মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী, কালের খবর :
প্রখ্যাত ইসলামী দার্শনিক ও মনীষী শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বলেন, ‘ইসলামের দৃষ্টিতে ইলম ও জ্ঞান একটি একক ও অবিভাজ্য বস্তু। যা ধর্মীয় ও জাগতিক সব জ্ঞানকেই অন্তর্ভুক্ত করে।
ফলে ইলম ও জ্ঞানকে ধর্মীয় ও জাগতিক এবং নতুন ও পুরনো ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত করা ঠিক নয়। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে জ্ঞান তাকেই বলা হবে যা আল্লাহর নামে পঠিত হবে এবং মানুষের উভয় জগতে কল্যাণকর হবে। এর মধ্যে ধর্মীয়, জাগতিক এবং নতুন ও পুরনো সব জ্ঞানই অন্তর্ভুক্ত। তবে শর্ত হল, তা আল্লাহর নামে পঠিত হতে হবে এবং কল্যাণকর হতে হবে।’
পবিত্র কোরআন এ কথাই বলেছে, পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আলাক, আয়াত ১)। সুতরাং এই শর্তের বাইরে যেসব জ্ঞান আছে তাকে ইসলামের দৃষ্টিতে ইলম বা জ্ঞান বলা হবে না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে জাগতিক সব জ্ঞানই ইসলামী জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হবে যদি তা আল্লাহর নামে পঠিত হয় এবং দুই জগতে কল্যাণকর হয়। কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী হজরত আদম (আ.) কে ভূ-পৃষ্ঠের খেলাফত প্রদান করা হয়েছিল সৃষ্টি সম্পর্কীয় জ্ঞানের কারণেই।
সুতরাং আমরা বলতে পারি, দ্বীনি ও জাগতিক দুই ধরনের জ্ঞান জীবন নামক গাড়ির দুটি চাকার মতো। যার একটা বিকল হয়ে গেলে গাড়িটি আর সামনে চলতে পারবে না।
তেমনি মানুষ যদি দ্বীনি জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়ে যায় তাহলে দুনিয়া ও পরকাল দুই জগতে সে বিরাট ক্ষতিতে পড়বে, আর যদি জাগতিক জ্ঞান থেকে দূরে সরে যায় তাহলে পৃথিবীর নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে।
নবুওতের যুগ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বে ইসলামী ও সমসাময়িক জ্ঞানের সমন্বয়ে সার্বজনীন ইসলামী একক শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যেমন হাফেজ, আলেম, মুফতি, ইমাম ও খতিব বের হয়েছেন, তেমনি ইতিহাসবিদ, ভূগোলবিদ, রসায়নবিদ, গণিতবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, শাসক ও সেনাবাহিনীও বের হয়েছে।
হিজরি ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় মুসলিম উম্মাহই ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতি, তথ্য-প্রযুক্তি ও সমরশক্তির দিক দিয়ে সবচেয়ে উন্নত ও অগ্রসর।
এ সময়ে মুসলিম উম্মাহকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমন কোনো শক্তির অভ্যুদয় ঘটেনি। তখন পর্যন্ত দ্বীন ও দুনিয়া তথা ধর্ম ও জাগতিক জ্ঞানের ধারায় কোনো পার্থক্য ও বিভাজন ছিল না। তখন কোরআন-হাদিস, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন ও পদার্থ বিদ্যাকে আলাদাভাবে দেখা হয়নি, বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখাকেই ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রয়োজনীয় মনে করা হয়েছে এবং সেগুলো আল্লাহর নামে শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
জাগতিক জীবন পরিচালনার জন্য যেসব জ্ঞান ও বিজ্ঞানের প্রয়োজন ছিল তার সবকিছুই মুসলমান আবিষ্কার-উদ্ভাবন ও উৎকর্ষ সাধন করেছিল। এ সময়ের মধ্যে ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের উদ্ভাবন হয়েছে। উলামায়ে কিরাম ও দ্বীনদার শ্রেণীর হাতেই ছিল তার নেতৃত্ব।
ইসলাম সবসময় জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা করায় সে যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞান সর্বোচ্চ উৎকর্ষতা লাভ করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী দুনিয়ার কোনো জাতিগোষ্ঠী মুসলমানদের মোকাবেলা করতে পারেনি।
বর্তমানের ইউরোপ তথা পাশ্চাত্য সভ্যতার আজকের এই উত্থান মুসলমানদের সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানেরই ফসল। যুগ পরম্পরায় জ্ঞানের প্রতি মুসলমানদের উদাসীনতা ও অতিরিক্ত দুনিয়াদারির সুযোগে জ্ঞানের এই মূলধারায় ইউরোপীয়রা আধিপত্য বিস্তার করেছে। মুসলিম উম্মাহ বিভক্ত হয়ে দ্বীনি ও দুনিয়াবি শিক্ষা নামে দুই ধারায় বয়ে চলেছে।
সেই ধারাবাহিকতায় আজ আমাদের প্রচলিত ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন নেই সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞান, তেমনি সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় নেই আল্লাহর নাম ও নৈতিকতা। সেখানে আল্লাহর নামে শিক্ষা দেয়া হয় না। এই বিভক্তি সমাজ ও জাতীয় জীবনেও বিভক্তি ও বিভাজন সৃষ্টি করেছে।
ফলে একদিকে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থায় আধুনিক যুগ-চাহিদার প্রতি দৃষ্টি না দেয়ার কারণে যেমন উলামায়ে কিরাম ক্রমেই দেশ ও জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন এবং মসজিদ-মাদ্রাসার চৌহদ্দির মধ্যে সীমিত থেকে সীমিততর হয়ে যাচ্ছেন, তেমনি সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় আল্লাহর নাম ও নৈতিকতা অনুপস্থিত থাকায় সাধারণ শিক্ষিত শ্রেণীর চিন্তা ও মন-মননে এক ধরনের বিভ্রান্তি ও বিকৃতির সৃষ্টি হচ্ছে।
তৈরি হচ্ছে নাস্তিক শ্রেণীর। সৃষ্টি হচ্ছে ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মারামারি ও হানাহানিতে ভরা অশ্লীল সমাজের। এর একমাত্র কারণ সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় নেই আল্লাহর নাম যেটুকু আছে সেটুকু মানুষের নৈতিকতা গঠনে কল্যাণকর ও সহায়কও নয়।
এই অশ্লীল সমাজ সৃষ্টির দায় অনেকটা উলামায়ে কিরামের ওপরও বর্তায়। কারণ উলামায়ে কিরাম ইসলামী শিক্ষা সিলেবাসকে সার্বজনীন, সমন্বিত ও সহজ করতে পারেননি।
সেখান থেকে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্য ব্যক্তিবর্গ গড়ে তুলতে পারনেনি। কারণ সেখানে একদিকে যেমন নেই সমকালীন দর্শন, অন্যদিকে এ সিলেবাসের ভাষা অত্যন্ত জটিল ও কঠিন।
যার কারণে এ শিক্ষার শিক্ষার্থীরাও যেমন তা পুরোপুরি আয়ত্ত করতে পারছে না, অন্যদিকে আধুনিক শিক্ষিত সমাজ উলামাদের জটিল দরসি ভাষা বুঝতে অক্ষম। আর এ জটিলতাই মাদ্রাসা ও ইসলামী প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ অনেক উদ্দেশ্য পেছনে ঠেলছে। কারণ ইলম শেখার আসল উদ্দেশ্য মানবতার সামনে তাদের ভাষা ও বুঝ অনুযায়ী সমকালীন পদ্ধতিতে দ্বীনকে পৌঁছানো।
আমাদের নতুন প্রজন্ম পশ্চিমা চিন্তা-দর্শন ও ধ্যান-ধারণার সামনে পরাজয় বরণ করছে। এজন্য আধুনিক চিন্তা-দর্শন ও ইসলামের আধুনিক দাওয়াত পদ্ধতিতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে না পারলে আমাদের প্রতিটি কদমই পরাজয়ের দিকে এগিয়ে যাবে।
শুধু দ্বীনি ও ইংরেজি ভাষা শেখাই যথেষ্ট নয়, বরং বিশ্বের জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের মেধা ও সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী পারস্পরিক ডায়ালগ ও আলোচনার উপযুক্ত প্রতিনিধি হওয়ার জন্য সেসব জ্ঞান-বিজ্ঞানেও ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে হবে যেগুলোর সম্পর্ক জাতিগোষ্ঠীর মনস্তত্ত্ব ও অভিরুচি জড়িত।
ইসলামী ও সমকালীন জ্ঞানের সব শাখায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করা ছাড়া ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা সম্ভব নয়। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে পেছনে ঠেলে দিয়ে ইসলামের শিক্ষা ও দাওয়াত তুলে ধরার অর্থই দ্বীন ও ইসলামকে লাঞ্ছিত করা। হাজার বছর আগে যখন প্রাচীন দর্শন তার থাবা গেড়ে বসেছিল, তখন তাতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করাকে যুগের দাবি সাব্যস্ত করা হয়েছিল।
উলামায়ে কিরাম ইসলামী জ্ঞানের পাশাপাশি গ্রিক দর্শনে ব্যুৎপত্তি অর্জন করাকেও জরুরি করেছিলেন। সে যুগের উলামায়ে কিরাম গ্রিক দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে গ্রিকদের থেকেও বেশি ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। এখন সময়ের পরিবর্তন হয়েছে।
যুগ বহুদূর অগ্রসর হয়ে গেছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষ মানুষের চিন্তাশক্তিকেও নিতান্ত অসহায় করে দিয়েছে। পাশ্চাত্য এই বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সাহায্যে মুসলিম বিশ্বের ওপর রক্তাক্ত থাবা বিস্তার করেছে।
কিন্তু আমাদের মাদ্রাসাগুলো এখনও হাজার বছর পুরনো দর্শনের কালো থাবা থেকে বের হতে পারেনি। মনে রাখতে হবে, বর্তমান যুগে ইসলামী রেনেসাঁ ও পুনর্জাগরণের জন্য ‘তাফাক্কুহ ফিদ-দ্বীন’-এর পাশাপাশি সমকালীন সব মতবাদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তা-দর্শন জ্ঞান অর্জন করা সময়ের দাবি।
লেখক : মহাপরিচালক, শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বিরুলিয়া, ঢাকা।