রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:১৩ অপরাহ্ন
রিয়াজুল হক, কালের খবর :
এক.
রাশেদ (ছদ্মনাম) এবং তার স্ত্রী দুজনেই বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাদের দেড় বছর বয়সী একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। সকালে অফিসে যাওয়ার পর কাজের বুয়ার উপর দায়িত্ব থাকে একমাত্র কন্যার দেখভাল করার। সমস্ত দিন দুশ্চিন্তায় পার হয় কর্মজীবি এই বাবা-মায়ের। সারাদিন কাজের বুয়াকে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নেয়। এছাড়া আর করার কি আছে? প্রিয়জনের আদর ছাড়াই অবুঝ শিশুটির সকাল থেকে সন্ধ্যা পার হয়।
রাশেদের আরেক ভাই এবং বাবা-মা একসঙ্গে আলাদা থাকেন। বিয়ের পরপরই রাশেদ পরিবার থেকে আলাদা হয়ে গেছে। অথচ বাবা-মা, ভাইয়ের সাথে থাকলে একমাত্র কন্যাকে আদর করার প্রিয়জনের কোন অভাব হত না। দাদা-দাদি, চাচা-চাচি কিংবা প্রায় সমবয়সী একজন চাচাতো বোনকেও পেত। অথচ সবকিছু থাকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ঘটনা এখানে সম্পূর্ণ বিপরীত। আধুনিকতার দোহাই দিয়ে নিঃসঙ্গতাই আমাদের পছন্দ হয়ে দাড়িয়েছে।
দুই.
আমি আমার ছেলেবেলার কথা মনে করে এখনও শান্তি পাই। মায়ের কাছে ছিলাম সকল কাজের কেন্দ্রবিন্দু। দাদা, দাদি, নানা, নানী, চাচা, মামার কোলেই কেটেছে আমার শিশুকাল। বাড়ীর কাজের মানুষ আমায় কোলে নিয়েছে এমন মনে পড়ে না। দাদার কোলের মধ্যে থেকে শুনতাম বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ, বিখ্যাত মানুষদের গল্প। বাসায় সারাদিন হৈ চৈ লেগেই থাকতো। ক্লাস ওয়ানে যখন ভর্তি হলাম, কাকু স্কুলে নিয়ে যেতো। চার বছর বয়সে ক্লাস ওয়ান, ভয় পাই কিনা এজন্য কাকু আমার সাথে ক্লাসের মধ্যেই বসে থাকতেন। কোলে করে বাসায় নিয়ে আসতেন। স্কুল থেকে বাসায় আসলে দাদির খাবারের যন্ত্রনা। বেলা অবেলা নেই। আর সময় মত মায়ের আদর, স্নেহ, শাসন সবই ছিল। যখন মাধ্যমিকে উঠলাম, তখন আব্বুর তদারকিটা বেড়ে গেল।
যদিও কাজের জন্য আব্বু কিছুটা ব্যস্ত থাকতেন, কিন্তু রাতের খাবারের সময় তার সাথে বসতে হতো। সারাদিন কতটুকু পড়া করেছি, বিকেলে কাদের সাথে খেলেছি, দুপুরে ঘুমিয়েছিলাম কিনা ইত্যাদি কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছিল আমার প্রতিদিনের কাজের অংশ । যৌথ পরিবারের কারণে আমার সামান্য অন্যায় করার সুযোগ ছিলনা। ঘরে আমার অনেক অনেক অভিভাবক। এখনও আব্বু প্রতিরাতে আমাদের নিয়ে খেতে বসেন। পরিবারের সকল সমস্যার সমাধান খাবার টেবিলেই হয়ে যায়।
তিন.
আগে আট-দশ ভাই একসাথে থাকত। এক চুলায় পরিবারের সকলের রান্না হত। এখন তো ভাই-বোনের সংখ্যা দুই-তিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বিয়ের পর বোনেরা শ্বশুর বাড়ি চলে চায়। তারপরেও ভাইয়েরা একসাথে থাকতে পারছে না। যে যার মত থাকছে। একই শহরে সবাই যেন সবাই পরবাসী। আমি আমার অন্য একটি লেখায় লিখেছিলাম,পার্থিব সম্পত্তির কারণে ভাইয়ে ভাইয়ে ভুল বোঝাবুঝি হবে, সেটাই মেনে নেওয়া যায় না।
সেখানে মারামারি, খুন, জখমের বিষয়তো কল্পনাতেও আনা উচিত না। অথচ সেটাইএখন হচ্ছে। ভাইদের সমস্যা সমাধানে এলাকায় সালিশ বসাতে হয়। ভাইদের নিজেদের ভুলের বিচার করে গ্রামের মাতুব্বর কিংবা পাড়ার ক্ষমতাশালী ব্যক্তিবর্গ। কতটা বোকা হয়েগিয়েছি আমরা? ভাইয়ে ভাইয়ে অমিল হবে কেন? সামান্য স্বার্থের কারণে এক ভাই অন্যজনের মুখ দেখা বন্ধ করে দেয়। মনে হয়, মৃত্যুর পর কবরে নিয়ে যাবে স্বার্থ সংশ্লিষ্টবিষয়াদি। একটু মেনে নেওয়ার ইচ্ছা যদি প্রতিটা ভাইয়ের মধ্যে থাকত, তবে এসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটত না। কিছু যদি বেশি পায়, তবে সেটাতো আপনার ভাই পেল।
একটু মনেকরার চেষ্টা করুন, ছোট থাকতে এক ভাই অন্যজনের গলা ধরে ঘুমিয়ে থাকতেন। তাহলে বড় হয়ে কেন পারছেন না, বুড়ো হয়ে কেন পারছেন না? সুখে দুঃখে সবচেয়ে কাছেরবন্ধু কিন্তু আপনার ভাই। খুব ছোট থাকতে দেখতাম, যাদের সমসাময়িক দুই/তিন জন ভাই থাকত, তাদের সাথে পাড়ার কেউ মারামারি করতে যেত না। আমরা সবই বুঝি কিন্তু মেনে চলতেই যেন সকল সমস্যার উত্থান।
চার.
সন্তান প্রতিটি বাবা-মায়ের কাছে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। পিতা-মাতা কখনো সন্তানের অমঙ্গল কামনা করেন না, বরং শত দুঃখ-কষ্ট পেলেও সন্তানের জন্য শুভকামনা করেন । মহানবী (সা.) সন্তানদের সুশিক্ষা দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের সন্তানদের স্নেহ করবে এবং তাদের শিষ্টাচার শিক্ষাদান করবে। সন্তানকে সদাচার শিক্ষা দেয়া দান-খয়রাতের চেয়েও উত্তম। তোমাদের সন্তানদের উত্তমরূপে জ্ঞানদান কর।
কেননা তারা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য সৃষ্ট।’ যুগের হাওয়ায় বাবা মায়েরা আজ অনেক ব্যস্ত। সন্তানের জন্য তাদের সময় এখন দুষ্প্রাপ্য। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যেতে যেতে পরিবারের সদস্য সংখ্যা এখন ৩ জন কিংবা ৪ জনে এসে ঠেকেছে। তারপরেও সকলেই ব্যস্ত। এখনও যখন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একান্ত আলাপচারিতা দেখি, অধিকাংশ ব্যক্তিই তাদের একান্নবর্তী পরিবারের স্মৃতিচারণ করেন। পরিপূর্ণ আনন্দ যে ঘরভর্তি মানুষের মধ্যে নিহিত, অবলীলায় সকলেই স্মরণ এবং স্বীকার করেন।
পাঁচ.
বর্তমান পরিবারতন্ত্রের অবস্থা সত্যিই আশংকাজনক। আজকের বাবা-মায়েরা চাকরি, ব্যবসা, পার্টি নিয়ে অনেক অনেক ব্যস্ত। অর্থ বিত্ত আর ক্যারিয়ার নামক আজব নেশায় তাদের পেয়ে বসেছে। সন্তান সঠিকভাবে মানুষ করাও যে ক্যারিয়ারের অংশ সেটা তাদের বুঝাবে কে? শুধু দামি দামি জামা কাপড়, গাড়ি করে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে সন্তানের সব প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়না। প্রয়োজন স্নেহ, ভালোবাসা, শাসন।
ভারতের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এপিজে আব্দুল কালামের মতে,’যদি একটি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত এবং সুন্দর মনের মানুষের জাতি হতে হয়, তাহলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এক্ষেত্রে তিনজন সামাজিক সদস্য পার্থক্য এনে দিতে পারে। তারা হলেন বাবা, মা এবং শিক্ষক।’ বর্তমানে অনেক বাবা মা আত্মীয়-স্বজন থেকে আলাদা থাকার মাধ্যমে নিজেদের গুরুত্ব বাড়িয়ে চলেছেন। কতটা বোকা চিন্তা ভাবনা! আধুনিকতা মানেই নিসঙ্গতা নয়। একা একা যদি বসবাস করতে চান, তবে রবিনসনের মতো নির্জন দ্বীপে বসবাস করেন।
সন্তান পিতামাতার জন্য আল্লাহর সবচেয়ে বড় নিয়ামত। সেই নিয়ামত সঠিকভাবে পরিচর্চা করুন। আজ আপনি অবচেতনভাবে যেভাবে সন্তানদের অবহেলা করছেন, সন্তানও ভবিষ্যতে তাই করবে। অনেকেই সন্তান মানুষ করতে হিমসিম খাচ্ছেন। ঠিক মতো সময় দিতে পারেন না।
তাদের জন্য বলছি, যৌথ পরিবার বজায় রাখেন। আপনার সন্তান কখনও নিজেকে একা মনে করবে না। সন্তানের অতিরিক্ত টেলিভিশন দেখা, মাত্রাতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহার, সঙ্গদোষ এড়ানো, অপরিকল্পিত মোবাইল ফোনের ব্যবহার বন্ধ করতে চাইলে, সব চিকিৎসা বাদ দিয়ে যৌথ পরিবার প্রথায় ফিরে আসুন। সন্তানের পরিচর্চা নিয়ে চিন্তার প্রয়োজন পড়বে না। তাদের মানসিক বিকাশে সহায়তা করুন। স্বনির্ভর পরিবার পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে যৌথ পরিবার।
রিয়াজুল হক: উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
riazul.haque02@gmail.com