সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:২৭ পূর্বাহ্ন
এম আই ফারুক আহমেদ, কালের খবর :
প্রয়োজনেই ফিল্টার পানির ওপর নির্ভরতা বেড়েছে রাজধানীবাসীর। যে কারণে জারের পানির ব্যবসা এখন রমরমা।
চা-রুটির ছোট্ট দোকান থেকে শুরু করে সব ধরনের অফিস-আদালতে খাওয়া হচ্ছে ফিল্টার পানি। ওয়াসার পাইপে বাসাবাড়ি বা অফিস-আদালতে আসা খাওয়ার অনুপযোগী পানি থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখতে এই পানি ব্যবহার করে ভোক্তারা। আর ভেজাল পানির বিক্রেতারা প্রয়োজনীয়তার এই সুযোগকে অপব্যবহার করে সেই ওয়াসার অনিরাপদ পানিই জারে ভরে ‘নিরাপদে’ পৌঁছে দিচ্ছে ভোক্তাদের ঘরে ঘরে।
রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সরেজমিন ঘুরে, সাধারণ ভোক্তা, পানি ব্যবসায়ী, বিএসটিআই ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কলিফর্মের মতো মলের জীবাণুসহ নানা ধরনের জীবাণু পাওয়া যাচ্ছে ফিল্টার পানিতে। এর প্রধান কারণ সঠিক প্রক্রিয়ায় পানি পরিশোধন না করা। কেউ কেউ সরাসরি ওয়াসার পানি জারে ভরে ভোক্তার হাতে পৌঁছে দিচ্ছে। আবার কারও পরিশোধনের সব ধরনের যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও সেটা ব্যবহার না করে শুধু নামমাত্র ফিল্টারিং করে পানি বাজারজাত করছে।
এর পেছনে বড় একটি কারণ হলো ‘মুনাফা’। কোনো মতে ফিল্টারিং করে একটি জারের পানি বাজারজাত করা হলে তার উত্পাদন খরচ পড়ে মাত্র তিন-পাঁচ টাকা।
আর কেউ যদি সরাসরি ওয়াসার পানি বাজারজাত করে তবে কোনো খরচই পড়ে না। সেখানে খরচ বলতে শুধু বিদ্যুৎ ও পানির বিল। জানা গেছে, এসব পানির উত্পাদনকারীরা ডিলারদের কাছে জারপ্রতি সাত টাকা বা তারও কম দামে পানি দেওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতেছে। ডিলাররা প্রতিটি জার ভোক্তার কাছে বিক্রি করছে ৬০-৮০ টাকার মধ্যে।
নাম-ঠিকানাবিহীন একটি অ্যাসোসিয়েশন হলো ‘ওয়াটার ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (ডাব্লিউআইডিএ)। ’ সরেজমিনে ভাটারা থানার কোকো-কোলার ঢালিবাড়ী রোডের ক্রিস্টাল ড্রিংকিং ওয়াটার নামের একটি কারখানা ঘুরে দেখার সময় অ্যাসোসিয়েশনটির একটি ব্যানার চোখে পড়ে। এতে নোটিশে লেখা রয়েছে, ‘সকল পানি উত্পাদনকারী ফ্যাক্টরির মালিকদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, ডিলারদের কাছে প্রতি জার পানি সর্বনিম্ন সাত টাকা দরে বিক্রি করতে হবে। কোনো প্রকার ফ্রি বা মাসিক ছাড়া দেওয়া যাবে না। এই সিদ্ধান্ত অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে বিএসটিআই, এফবিসিসিআই, পিউর ড্রিংকিং ওয়াটার ম্যানুফেকচারিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কেউই এই অ্যাসোসিয়েশনের অস্তিত্বের কথা জানাতে পারেনি। পিউর ড্রিংকিং ওয়াটার ম্যানুফেকচারিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মো. আওলাদ হোসাইন রাজিব কালের খবরকে বলেন, ‘জারের পানি সাত টাকায় বিক্রি করা অসম্ভব। কারণ নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে পানি উত্পাদন করলে সর্বনিম্ন খরচ হবে ৩৫ টাকা। এরপর যদি কেউ মানোন্নয়ন করতে চায় তবে ৫০ টাকা পর্যন্ত খরচ করা সম্ভব। ’ তিনি ডাব্লিউআইডিএ নামের অ্যাসোসিয়েশনের আদৌ কোনো অস্তিত্ব রয়েছে কি না জানেন না। ঢাকা শহরে এ ধরনের প্রচুরসংখ্যক অবৈধ কারখানার কার্যক্রমের কারণে ভালো ব্যবসায়ীদের চাপের মধ্যে থাকতে হচ্ছে এবং পানি বিক্রি করাই দুরূহ হয়ে উঠেছে বলে জানান এ ব্যবসায়ী নেতা।
পানি নিয়ে নিয়মিত কাজ করা বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক রিয়াজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে বলে শুনিনি কখনো। তবে বিভিন্ন অভিযানে গিয়ে দেখেছি অনেক কারখানা সাত টাকারও কম মূল্যে ডিলারকে পানি দিচ্ছে। যেটা কখনোই মানসম্পন্ন পানি হতে পারে না। বিশুদ্ধ করতে ৩৫-৪০ টাকার কমে হবে না। এসব কম্পানির বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত ব্যবস্থা নিচ্ছি। ’
কাকরাইল মোড়ের চা-রুটি-কলা বিক্রেতা আনোয়ার মিয়া জানান, প্রতি গ্লাস ফিল্টার পানি বিক্রি করেন এক টাকায়। প্রতি জার কিনতে ৫৫-৬৫ টাকা লাগে। প্রতিটি জারে প্রায় ১৯ লিটার পানি থাকে। সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দোকানে বিক্রি চলে। প্রতি লিটারে যদি চার গ্লাস করে পানি হয় তবে তিনি অন্তত ৩০০ গ্লাস পানি বিক্রি করেন। ঢাকার প্রতিটি অলিতে-গলিতে হাজার হাজার দোকান, রেস্তোরাঁ, অফিস-আদালত এমনকি বাসাবাড়িতে লোকজন নিয়মিত জারের পানি খায়। ফলে অনিরাপদ এই পানি তাদের স্বাস্থ্যের জন্য বড় ঝুঁকি হয়ে উঠছে।
বিএসটিআই ও র্যাব নিয়মিত ঢাকায় এসব অবৈধ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। অবৈধভাবে পানি বাজারজাত করায় অনেককে জেল-জরিমানা ও কম্পানি সিলগালা করে দেওয়া হচ্ছে।
র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম কালের খবরকে বলেন, ‘নিয়মিত এ ধরনের পানি খেতে থাকলে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকার সব জারের পানিতে মলের জীবাণু কলিফর্মের উপস্থিতি আছে। এটা খুবই খারাপ একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ’ তিনি বলেন, ‘আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। যে খারাপ পানি বিক্রি করছে তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং নিয়মিত অভিযান চলবে যতক্ষণ এটা পুরোপুটি বন্ধ না হয়। ’
মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় সোফিয়া ড্রিংকিং ওয়াটার ঘুরে দেখা গেছে, পানি প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য কয়েকটি ধাপে পানি বিশুদ্ধ করা হয়। প্রাথমিক ফিল্টারিং, সল্টনার ট্যাংক, অ্যাকটিভ কার্বন ট্যাংক, আয়রন রিমোভাল ট্যাংক, মাল্টিমিডিয়া ট্যাংক, রিভার্স ওসমোসিস ট্যাংক, পিউরিফায়েড ওয়াটার ট্যাংক এবং ড্রোজিন পাম্পসহ অনেক ধাপে পানি পরিশোধন করা হয়। তখনই সেটা বিশুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তার পরও প্রতিদিনই ওই পানি ল্যাবে পরীক্ষা করার নিয়ম রয়েছে। এই কারখানায় সব যন্ত্রপাতি থাকলেও তারা তার সঠিক ব্যবহার না করার কারণে সম্প্রতি দুই লাখ টাকা জরিমানা গুনেছে। নতুন করে লাইসেন্স না নেওয়া পর্যন্ত কারখানা সিলগালা করা হয়ছে।
বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা জানান, ভোক্তাসাধারণকে পানির জার কেনার আগে কয়েকটি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। প্রথমে দেখা উচিত জারের ওপরে নির্ধারিত লেভেলে উত্পাদন, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ রয়েছে কি না। এরপর জারটি ফুডগ্রেড কি না সেটাও খেয়াল করতে হবে। ফুডগ্রেড জার অনেক স্বচ্ছ এবং বেশ হালকা হয়। সাধারণত নীল রঙের যে জারগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলো ফুডগ্রেড নয়। এই জারের পানি ব্যবহার করাও অনিরাপদ।
রাজধানীতে বিশুদ্ধ পানি সহজলভ্য না হওয়ায় নানা ধরনের পানির রমরমা ব্যবসা চলছে। ফিল্টার পানির পাশাপাশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানি বাজারে রয়েছে। যেগুলো তুলনামূলক ভালো মনে করা হয়। অনেক কম্পানি আবার পানি বিশুদ্ধ করার নানা যন্ত্রপাতি বাজারজাত করছে। যেগুলো এখন শুধু ঢাকাতেই নয়, গ্রামগঞ্জেও ব্যবহার হচ্ছে। তবে এগুলো কতটা নিরাপদ তা বোঝার কোনো উপায় নেই। কম্পানিগুলোর মার্কেটিং বিভাগের কথার ওপর বিশ্বাস রেখেই সেগুলো ব্যবহার করছে ক্রেতারা।
বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু পানি ফিল্টারের যন্ত্রগুলো মানুষ তাদের ঘরে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করে সেখানে বিএসটিআইয়ের কাজ করার সুযোগ নেই। তবে এগুলো বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হলে সেখানে কাজ করার সুযোগ থাকত। ’
কালের খবর -/২২/৩/১৮